১৮ বছর যিনি বসবাস করেছেন বিমানবন্দরে

বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য টার্মিনাল’–এর কাহিনি বিমানবন্দরে আটকে পড়া এক ব্যক্তিকে নিয়ে। কোনো দেশই তাঁকে আশ্রয় দেয়নি। জীবনের বড় একটা অংশ তাঁকে কাটাতে হয়েছে বিমানবন্দরে। তিনি কি সিনেমার কারণে বিখ্যাত হয়েছিলেন? নাকি তাঁর জীবনী থেকে অনুপ্রাণিত ‘দ্য টার্মিনাল’ সবার মনযোগ কেড়েছে? দর্শকদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বিমানবন্দরে আটকে পড়া এই মানুষটির গল্প বহুদিন ধরে পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। বহু মানুষ তাঁর জন্য সমবেদনা অনুভব করেছেন। সাহায্য করতে চেয়েছেন অনেকেই।

দ্য টার্মিনাল সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন টম হ্যাংকস। সিনেমাটির পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ। তিনি যে গল্প বলেছেন, বিমানবন্দরের টার্মিনালে আটকে পড়া মানুষটির জীবন তার থেকে আলাদা।

লোকটির নাম মেহরান করিমি নাসেরি। নিজেকে পরিচয় দিতেন স্যার আলফ্রেড মেহরান নামে। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে বিমানবন্দরে আটকে ছিলেন ১৯৪৬ সালে জন্মানো এই ইরানি উদ্বাস্তু। ফ্রান্সের চার্লস দে গল বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ বহির্গমন লাউঞ্জে ১৯৮৮ সালের ২৬ আগস্ট থেকে জুলাই ২০০৬ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত আটকে ছিলেন নাসেরি। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর জীবনীনির্ভর বই ‘দ্য টার্মিনাল ম্যান’। নাসেরির বিমানবন্দরে আটকে থাকার গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একই বছর তৈরি হয় ‘দ্য টার্মিনাল’ সিনেমা।

নাসেরি দাবি করেন, তখনকার ইরানের ক্ষমতাসীন শাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তাঁকে ১৯৭৭ সালে ইরান থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর শরণার্থীর মর্যাদা পেতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চলিয়েছেন। আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন বিভিন্ন দেশে। একসময় বেলজিয়ামে জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনার তাঁকে শরণার্থী মর্যাদা প্রদান করেন। এই অধিকারবলে ইউরোপের সব দেশে তাঁর বসবাস করতে পারার কথা ছিল। কিন্তু এই দাবি নিয়ে পরে বিতর্ক তৈরি হয়। তদন্তে দেখা গেছে, নাসেরিকে কখনই ইরান থেকে বহিষ্কার করা হয়নি।

সিনেমা ও বাস্তবে

নাসেরির বাবা ছিলেন একজন ইরানি চিকিৎসক। মা স্কটিশ নার্স। ১৯৭৩ সালে ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যুক্তরাজ্যে আসেন নাসেরি। মায়ের কারণে তিনি যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর মতে, ১৯৮৮ সালে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার সময় কাগজপত্র হারিয়ে যায়। চুরি হয়ে যায় ব্রিফকেস। কিন্তু কিছু সূত্র ইঙ্গিত করে, নাসেরি ব্রিটেনে ফেরি পারাপারের সময় ব্রাসেলসে নথিপত্র কুরিয়ার করেছিলেন। সেগুলো চুরি হওয়ার বিষয়টি সঠিক না।

টার্মিনালে আটকে পড়ার আগে তিনি ফ্রান্স থেকে লন্ডনের বিমানে উঠেছিলেন। লন্ডনে যাওয়ার পর ব্রিটিশ অভিবাসন কর্মকর্তাদের কাছে পাসপোর্ট দেখাতে পারেননি। তাই তাঁকে ফ্রান্সে ফেরত পাঠানো হয়। প্রথমে ফরাসি পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তারপর বাধ্য হয়ে ছেড়ে দেয়। কারণ, বিমানবন্দরে তাঁর প্রবেশ বেআইনি ছিল না। পরে ফ্রান্স থেকে আর কোনো দেশে ফেরত পাঠানো হয়নি। এভাবে টার্মিনাল-১–এ তাঁর বাসবাসের শুরু। ১৮ বছর পর হার্ট অ্যাটাকের কারণে হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত এখানেই ছিলেন নাসেরি।

আরও পড়ুন

টার্মিনাল ১-এ নাসেরির জীবন শুরু হয়েছিল। সেসময় ক্রিশ্চিয়ান বোরগেট নামের একজন ফরাসি মানবাধিকার আইনজীবী তাঁর মামলা নিতে রাজি হন। ১৯৯২ সালে একটি ফরাসি আদালত রায় দেন, তাঁকে ফেরত পাঠানো যাবে না। কারণ, তিনি আইন মেনে দেশে প্রবেশ করেছিলেন। যদিও আদালতের রায় বিমানবন্দর পেরিয়ে ফ্রান্সে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি নাসেরিকে। তাঁর আইনজীবী তখন বেলজিয়াম থেকে জারি করা ভ্রমণ নথি জোগারের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্রাসেলসের কর্তৃপক্ষ বলেছিল, নাসেরি যদি নিজে উপস্থিত হন, তখনই তাঁকে বেলজিয়ামে ঢুকতে দেওয়া হবে। ১৯৯৫ সালে নাসেরিকে বেলজিয়ামে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে শর্ত ছিল তিনি একজন সমাজকর্মীর তত্ত্বাবধানে থাকবেন। নাসেরি এই প্রস্তাবে রাজি হননি। তিনি যুক্তরাজ্যে যেতে চান। শুরুতে তাঁর পরিকল্পনা যেমন ছিল।

এরপর ফ্রান্স নাসেরিকে বসবাসের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নাসেরি সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করতে রাজি হননি। কারণ, কতৃপক্ষ তাঁকে ইরানি নাগরিক হিসেবে দেখিয়েছে। তিনি ব্রিটিশ হতে চেয়েছিলেন এবং ‘স্যার আলফ্রেড’ নামে ব্রিটেনে যেতে চেয়েছিলেন। বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সে বসবাসের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় হতাশ হয়ে পড়েন নাসেরির আইনজীবী বোরগেট। কেন তিনি প্রস্তাব গ্রহণ করেননি এমন প্রশ্ন করা হলে আইনজীবী জানান, নাসেরি যেমন চান, তেমন জীবনযাপনই করছেন।

নাসেরি বিমানবন্দর ছাড়েন ২০০৬ সালের জুলাই মাসে। হার্ট অ্যাটাকের কারণে পরের বছর জানুয়ারি পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ফরাসি রেডক্রসের এক অফিস তাঁর দেখাশোনা করে। প্রথমে বিমানবন্দরের কাছে একটি হোটেলে তাঁকে রাখা হয়। এরপর নেওয়া হয় প্যারিসের একটি দাতব্য অভ্যর্থনাকেন্দ্রে।

বিমানবন্দরে ১৮ বছর থাকার সময় নাসেরির লাগেজ তাঁর পাশে ছিল। বিমানবন্দরের কর্মীরা তাঁকে খাবার এবং পড়ার জন্য বই সরবরাহ করতেন।

২০০৩ সালে নাসেরির সঙ্গে যোগাযোগ করে স্টিভেন স্পিলবার্গের প্রযোজনা সংস্থা ড্রিমওয়ার্কস। নাসেরি তাঁর গল্পের কপিরাইটের জন্য দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার ডলার পান। স্টিভেন স্পিলবার্গ নাসেরির গল্প সরাসরি ব্যবহার করেননি। তবে ‘দ্য টার্মিনাল’ সিনেমা নাসেরির গল্প থেকে অনুপ্রাণিত। ২০২২ সালে মারা যান নাসেরি।