আজব এক লিলিপুট সাম্রাজ্য
প্রায় ১ হাজার ৬০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে খুদে মানুষের সমাহার। কেউ স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছে, কেউ ট্রাফিক জ্যামে বসে সবুজ বাতির অপেক্ষা করছে, কেউ আবার নভোচারীর পোশাক পরে চাঁদের দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত লিলিপুটদের দেখছে গালিভারের মতো সাধারণ উচ্চতার মানুষ। তবে ভয় নেই, জোনাথন সুইফটের ‘গালিভার ট্রাভেলস’–এর মতো এরা গালিভারকে বেঁধে ফেলবে না। কারণ, ২৬৫ মিলিয়ন লিলিপুটের সবাই আসলে প্লাস্টিকের মডেল। ব্যস্ত লিলিপুট সাম্রাজ্য দেখে মনে হয় যেন ম্যানিকুইন চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়েছে। কাজ করতে করতে হঠাৎ থমকে গেছে সবাই।
জার্মান ভাষায় এই লিলিপুট সাম্রাজ্যের নাম ‘মিনিয়াটুয়া উন্ডাল্যান্ড’। জুরিখ শহরে এক মডেল রেলগাড়ি দেখে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মডেল রেলওয়ে বানানোর স্বপ্ন দেখেন উদ্যোক্তা ফেড্রিক ব্রন। কিছুদিন পর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে যমজ ভাই গেরি ও বন্ধু হার্জের সাহায্যে জার্মানির ওয়্যারহাউসখ্যাত হ্যামবুর্গ শহরে গড়ে তোলেন পৃথিবীর অন্যতম বড় মিনিয়েচার ওয়ান্ডারল্যান্ড।
প্রথম ধাপের কাজ শেষে ২০০১ সালে ওয়ান্ডারল্যান্ডের শুভ উদ্বোধন হয়। ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি—এই তিন দেশে ছুটে চলে ওয়ান্ডারল্যান্ডের মিনিট্রেন। কিন্তু লিলিপুট সাম্রাজ্যের স্থপতিদের স্বপ্ন ছিল আরও বড়। এরপর যুক্ত হয় অস্ট্রিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, সাউথ আমেরিকাসহ আরও কয়েকটি দেশের মিনিয়েচার মডেল। বর্তমানে ১৩টি সেকশনে ১ হাজার ১০০–এর বেশি মিনিট্রেন এই লিলিপুট–জগতে চলাচল করে। প্রায় ১৬ হাজার মিটার মডেল রেলওয়েটি এর মধ্যে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছে।
মডেল ট্রেন ছাড়াও লিলিপুটদের শহরে ছুটে চলে অসংখ্য মিনিকার। আড়াই শতাধিক মিনি মডেল কার একসঙ্গে খুদে সাম্রাজ্যের রাস্তায় চলতে পারে। এ ছাড়া উত্তর বাল্টিক সাগরে ৩০ হাজার লিটার পানির বেসিনে নিয়মিত চলাচল করে মিনি জাহাজ।
বাস্তব ও কাল্পনিক জগতের প্রায় সবকিছুরই ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখা যায় মিনিয়েচার ওয়ান্ডারল্যান্ডে। রূপকথার রাজা-রানি থেকে শুরু করে ডিসি কমিকসের বিভিন্ন চরিত্র, ইউরোপের উৎসব ও সংস্কৃতি, ভিসুভিয়াসের গলিত লাভা, অ্যারিজোনার গিরিখাদ, বরফে ঢাকা আল্পস পর্বত, উত্তর বাল্টিক সাগর—সবকিছুর দেখা মেলে এক ছাদের নিচে। শুধু তা–ই নয়, এন্টারটেইনিং অ্যাকশন বোতাম চাপলেই ম্যানিকুইন চ্যালেঞ্জ ভেঙে শুরু হয় সৈন্যদের তলোয়ার যুদ্ধ, চালু হয় চকলেট ফ্যাক্টরির মেশিন বা অ্যামিউজমেন্ট পার্কের মেরি-গো-রাউন্ড।
ওয়ান্ডারল্যান্ডের এত কিছু দেখাশোনা করেন ৩৬০ জন দক্ষ কর্মী। তাঁদের নিরলস পরিশ্রমে লিলিপুটদের সবকিছু নিয়মমতো চলে।
এ ছাড়া এখানে আছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখানো আরেক চমক ‘ক্নুফিঙ্গেন’ শহর। পৃথিবীর মানচিত্রে ক্নুফিঙ্গেনের অস্তিত্ব না থাকলেও ওয়ান্ডারল্যান্ডের প্রায় ছয় হাজার লিলিপুট এ শহরে বসবাস করে। সম্পূর্ণ কম্পিউটার–নিয়ন্ত্রিত কাল্পনিক শহরটিতে আছে হ্যামবুর্গ এয়ারপোর্টের আদলে গড়া ক্নুফিঙ্গেন এয়ারপোর্ট, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিনিয়েচার এয়ারপোর্ট। বোর্ডিং লাউঞ্জে অপেক্ষারত লিলিপুট স্ট্যাচুদের সঙ্গে গালিভাররা বা সাধারণ দর্শকেরা এখানে দেখতে পায় ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিখ্যাত কনকর্ড, স্টার ওয়ার্সের মিলিনিয়াম ফ্যালকন, বোয়িং ৭৪৭ ও এয়ারবাসের ওঠানামা।
লিলিপুটদের সাম্রাজ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে দ্য গ্র্যান্ড প্রিক্স অব মোনাকো। মোনাকো শহরের বিখ্যাত কার রেসিং এখন লিলিপুট–জগতেও চলবে। রেস চলাকালে ২২ মিটার ট্র্যাকিং এরিয়ার চারপাশে দেখা যাবে মোনাকোর ঐতিহ্য ও জীবনযাত্রা।
ওয়ান্ডারল্যান্ডের এত কিছু দেখাশোনা করেন ৩৬০ জন দক্ষ কর্মী। তাঁদের নিরলস পরিশ্রমে লিলিপুটদের সবকিছু নিয়মমতো চলে।
লিলিপুট–দুনিয়ায় দিন–রাতের দৈর্ঘ্য তাদের মতোই ছোট। মাত্র ১৫ মিনিটের ঝকঝকে দিন শেষে নেমে আসে আলো ঝলমলে ১৫ মিনিটের রাত, অর্থাৎ তাদের এক দিন আমাদের মাত্র ৩০ মিনিটের সমান!
পুরো সাম্রাজ্য ঘুরে দেখতে গালিভারদের সময় লাগে তিন ঘণ্টার মতো। তবে প্রতিনিয়ত মিনিয়েচার ওয়ান্ডারল্যান্ডের দৈর্ঘ্য বাড়ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে শিগগিরই যুক্ত হবে ক্যারিবীয় দীপপুঞ্জ, এশিয়া মহাদেশ ও গ্রেট ব্রিটেনের মিনিয়েচার মডেল। তখন হয়তো আমরা লিলিপুট সাম্রাজ্যের মিনিট্রেন বে অব বেঙ্গলের পাশেও চলতে দেখব!
তথ্যসূত্র: মিনিয়েচার ওয়ান্ডারল্যান্ড ডটকম