সোমালিয়ার উপকূলের কাছে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ পথ। এই পথে মূলত তেল সরবরাহ করা হয় আরব দেশগুলো থেকে। এই জাহাজগুলোকে জিম্মি করে সোমালি জলদস্যুরা। তারা স্পিডবোট ব্যবহার করে দ্রুত চলাচল করে। তবে ঘন ঘন জাহাজ দস্যুদের কবলে পড়ায় প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ জলদস্যুদের ঠেকাতে পারে না? তারা কি এতই শক্তিশালী? শতকোটি ডলারের সম্পদ রক্ষা করতে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? এর উত্তর, পৃথিবীর ৭০ শতাংশ এলাকাই সমুদ্র। বিশাল সমুদ্রের বিরাট এলাকাজুড়ে কোনো দেশই পাহারা দিতে চায় না।
ন্যাটো এবং মার্কিন নৌবাহিনী বলে, তারা পুরো সমুদ্রে পাহারা দিতে পারে না। তারা জাহাজগুলোকে প্রাইভেট সিকিউরিটির ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করে। গত কয়েক দশকে সোমালিয়ার কাছে টহলরত যুদ্ধজাহাজ কিছু জলদস্যুর হামলা বন্ধ করতে সফল হয়েছে। কিন্তু একটি জাহাজ যখন জলদস্যুদের আক্রমণে পড়ে, তখন জাহাজ উদ্ধারে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সেনাবাহিনী অভিযান পরিচালনা করে না জাহাজের ক্রুদের নিরাপত্তার স্বার্থে। যেহেতু তারা ছোট ছোট স্পিডবোটে দ্রুতগতিতে আসে, বিশাল জাহাজ বা বিমান থেকে বিস্তীর্ণ জলরাশিতে তাদের দেখা সহজ না। তাদের আটক করাও কঠিন।
জলদস্যুরা এই সুযোগ বারবার নিয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের দুটি জাহাজ দখলে নিয়েছে তারা। একটি জাহাজ ১০০ দিন পরে মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল কবির গ্রুপের জাহাজ এমভি জাহান মণি। ওই সময় জাহাজটিতে ২৫ জন নাবিক-ক্রু ও প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রী ছিলেন। অপহরণের ১০০ দিন পরে, ২০১১ সালের ১৩ মার্চ ভোরে জলদস্যুরা বন্দীদের মুক্তি দেয়। অন্য জাহাজটি এখন আলোচনার শীর্ষে। সম্প্রতি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর। এর ২৩ নাবিক ও ক্রু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
জাহাজগুলো সোমালিয়ার উপকূল এড়িয়ে চলে না কেন? এর উত্তর হলো, জলদস্যুরা তাদের উপকূল ছাড়িয়ে কয়েক শ মাইল দূরে চলে যায়। এমনকি ভারত মহাসাগরে ভারতের কাছাকাছি এসে দস্যুতা করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ আদায় করা। জাহাজ ও নাবিকদের আটকে রেখে মুক্তিপণ উদ্ধারে এরা দর–কষাকষি করে।
বাংলাদেশের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে রক্ষার জন্য কোনো প্রাইভেট নিরাপত্তারক্ষী দল ছিল না। জাহাজশিল্পের অনেকেই নিরাপত্তারক্ষী রাখতে অনিচ্ছুক। কারণ, তাঁরা মনে করেন, সশস্ত্র রক্ষীদের ভয়ে জলদস্যুদের সহিংসতা বেড়ে যাবে। এখন পর্যন্ত সোমালীয় জলদস্যুদের সহিংসতা কম হয়েছে। সুসংগঠিত জলদস্যুরা প্রায় কখনোই জিম্মিদের ক্ষতি করেনি। খুব কম কার্গো চুরি করেছে। এরা সাধারণত মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়।
সোমালিয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে কোনো স্থিতিশীল সরকার নেই। তারা প্রতিবছর অনেকগুলো জাহাজ আক্রমণ করে। ২০০৮ সালে তারা ৯০টি জাহাজ আক্রমণ করেছিল। এর মধ্যে ৩৬টি জাহাজ সফলভাবে আটক করেছে। পাম তেল এবং রাসায়নিক মালবাহী জাহাজ থেকে শুরু করে থেকে বিলাসবহুল ইয়ট পর্যন্ত তারা আটক করেছিল। এরপর লাখ লাখ ডলার মুক্তিপণ আদায় করে। তাদের উপকূলে শক্তিশালী ঘাঁটি আছে। সেখানে জাহাজগুলো আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য আলোচনা করে।
সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন, ছিনতাইপ্রবণ এলাকা ২৫ লাখ বর্গমাইল সমুদ্রজুড়ে। এত বড় জায়গায় কার্যকরভাবে টহল দেওয়া অসম্ভব। জলদস্যুরা বড় একটি মাদার শিপ ব্যবহার করে দ্রুত চলতে পারে এমন ছোট বোট দিয়ে আক্রমণ করে। কয়েক শ মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তারা এই আক্রমণ করে। সমস্যা হলো, এই মাদার শিপগুলোও হাইজ্যাক করা। এগুলো মাছ ধরার জাহাজ। মাছ ধরা জাহাজের ক্রু জেলে থেকে জলদস্যু হয়ে উঠেছে। সত্যিকার মাছ ধরা হাজার হাজার জাহাজের মধ্য থেকে দস্যুদের মাদার শিপ খুঁজে বের করাও অসম্ভব।
সামরিক রাডার জলদস্যুদের চিহ্নিত করার কাজ করে। ভারত মহাসাগর ও ইয়েমেনের মধ্যবর্তী এডেন উপসাগরে চলাচলকারী জাহাজকে সতর্ক করে। তবে ভারত মহাসাগর বা এডেন উপসাগর বিস্তীর্ণ এলাকা। খুব বড় অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ দিয়ে প্রতিটি জাহাজকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হয় না। সোমালিয়া ও ইয়েমেনের মধ্যবর্তী এডেন উপসাগরে বছরে প্রায় ২০ হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে যায়। এটিই এশিয়া থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় যাওয়ার দ্রুততম পথ। এ সুযোগ নেয় সোমালিয়ার দস্যুরা। এই পথ ব্যবহার না করলে পুরো আফ্রিকা ঘুরে জাহাজগুলোকে চলাচল করতে হবে। এই পথ অনুসরণ করাও সম্ভব না। জাহাজের খরচ অসম্ভব বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে তেলের দাম।
জলদস্যুরা সাধারণত ছোট স্পিডবোট দিয়ে আক্রমণ করে। দড়ি ও মই ব্যবহার করে জাহাজে ওঠে এবং ক্রুদের জিম্মি করে। এমভি আবদুল্লাহের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। সাধারণত এসব দলে ২০ থেকে ৫০ জন সদস্য থাকে। চারদিক থেকে তারা জাহাজ আক্রমণ করে। জলদস্যুরা প্রত্যেকেই প্রশিক্ষিত যোদ্ধা। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং রকেটচালিত গ্রেনেড দিয়ে সজ্জিত। মেশিনগানের মতো ভারী অস্ত্র থাকে বলে জাহাজের ক্রু তাদের ঠেকানোর কোনো সুযোগ থাকে না। তাই এখন বাংলাদেশি নাবিক ও ক্রুদের দ্রুত নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা নেওয়াই মূল কাজ। বাকিটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।