মানুষ নয়, বন্যপ্রাণীর পারাপারের জন্য তৈরি হয়েছে দৃষ্টিনন্দন এই সেতুগুলো
রাস্তাঘাটে পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য নির্দিষ্ট ব্যবধানে থাকে জেব্রা ক্রসিং, ওভারপাস, আন্ডারপাস, ফ্লাইওভার ইত্যাদি। ঠিক সে রকমই বন্য প্রাণীদের নিরাপদে চলাচলের জন্য নেদারল্যান্ডস, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সেতু। এসব দেশের অনেক সড়ক ন্যাশনাল পার্ক কিংবা ন্যাশনাল রিজার্ভ বনের মধ্যে অবস্থিত। এসব রাস্তার প্রশস্ততা ছয় থেকে আট লেনের। বিভিন্ন দেশের মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের গতিসীমা ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১৪০ কিলোমিটারের মধ্যে নির্ধারিত থাকে। কিন্তু এসব বন্য প্রাণী চলাচলের এলাকায় যানবাহনের গতি কিছুটা কমানো হলেও প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। বন্য হরিণ, ক্যাঙ্গারু, বাইসন, বন্য মহিষ, সরীসৃপজাতীয় প্রাণী, রেইন ডিয়ার, বন্য শূকর, ভাল্লুক, নেকড়ে, শিয়াল, পাহাড়ি বাঘ প্রায়ই যানবাহনের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যায়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রতিদিন প্রায় এক মিলিয়ন বন্য প্রাণী নিহত হয়। শুধু যে বন্য প্রাণী নিহত হচ্ছে এমন নয়, এর পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে মানুষেরও।
শুরুর দিকে বন্য প্রাণীদের দুর্ঘটনা এড়াতে সড়কের পাশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হলেও তা আসলে কোনো কাজে আসেনি। ফলে এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের লক্ষ্যে নিরাপদে বন্য প্রাণী চলাচল ও পারাপারে এ ধরনের সেতুর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। যার ফলে সেই সব দেশের বন্য প্রাণী মৃত্যুর হার ও মানুষের ক্ষতির হার অনেকাংশে কমে এসেছে।
বন্য প্রাণীদের জন্য তৈরি এসব সেতু শুরুর দিকে প্রাণীদের কাছে কিছুটা অদ্ভুত ও ভীতিকর লাগে। তবে সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নেয় এরা। বন্য প্রাণীদের জন্য এ ধরনের সেতু নির্মাণের ইতিহাস তেমন পুরোনো নয়। ধারণাটি প্রথমে ১৯৫০-এর দশকে ফ্রান্সে বাস্তবায়ন করা হয়। এই প্রকল্প হলে নেদারল্যান্ডস এ ধারণার বাস্তবায়ন করে। নেদারল্যান্ডসে বন্য প্রাণীদের জন্য ছয় শতাধিক সেতু ইতিমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসে বন্য প্রাণীর জন্য নির্মিত সেতুগুলোয় ‘ইকো-ডাক্ট’ বা সড়কের ওপর সেতুতে বন্য পরিবেশ বজায় থাকে, যা বন্য প্রাণীদের আকর্ষণ করে এবং তাদের চলাচলে সাহায্য করে।
কানাডা বানফ ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত ওভারপাস এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ার কোটেনে ন্যাশনাল পার্কের আন্ডারপাস সে দেশের বন্য প্রাণী রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ই-১০ আন্ডারপাস, কালভার্ট সে দেশের অ্যালিগেটর, ইগুয়ানা, সালামানডার্স, ভেড়া, কচ্ছপ, ফ্লোরিডার প্যানথার, পাইথন রক্ষায় কাজ করছে। ভারত মহাসাগরে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিসমাস দ্বীপে লাল কাঁকড়া বছরের একটা সময় ঝাঁকে ঝাঁকে দ্বীপের জঙ্গল থেকে সাগর সৈকতে গিয়ে ডিম দিয়ে আবার ফিরে আসে। আগে এদের চলাচলের সময় পুরো দ্বীপের যান চলাচল বন্ধ রাখা হতো। এখন লাল কাঁকড়াদের রাস্তা পারাপারের জন্য ওভারপাস তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সম্প্রতি মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে মহাবিপন্ন উল্লুকের অবাধ চলাচলের সুবিধার্থে বানানো হয়েছে পাঁচটি ক্যানোপি ব্রিজ। এ ছাড়া চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে চালু হয়েছে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম হাতির ওভারপাস, যেটির নিচে দিয়ে ট্রেন চলবে এবং ওপরে পারাপার হবে বন্য হাতি।
নগরায়ণের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। বন উজাড়, অবৈধ শিকার ও দূষণের ফলে বন্য প্রাণীদের বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে। এ অবস্থায় বন্য প্রাণীদের জন্য নিরাপদ রাস্তা নির্মাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর ফলে বন্য প্রাণী মৃত্যুর হার ও মানুষের জানমালের ক্ষতির হার অনেকাংশেই কমে আসছে।
বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন গবেষণা পর্যবেক্ষণ করে বন্য প্রাণীদের চলাচলের পথ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেয়েছেন প্রকৌশলীরা। সে অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে প্রাণীদের চলাচলের জন্য বিভিন্ন ধরনের পথ। সরীসৃপ প্রাণী, যারা বুকে ভর দিয়ে চলে, তাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে আন্ডারপাস টানেল বা সুড়ঙ্গ। স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন বানর, কাঠবিড়ালি, স্লথ প্রভৃতি গাছ থেকে নেমে রাস্তা পার হয়, যা তাদের জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে গাছের ডালে ডালে নির্মাণ করা হয়েছে ক্যানোপি ব্রিজ। এ ছাড়া হরিণ, ভাল্লুক, গন্ডার, বন্য মহিষ, হাতি, বন্য শূকর ইত্যাদি বন্য প্রাণীর জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ওভারপাস, গ্রিন ব্রিজ, ল্যান্ড ব্রিজ ইত্যাদি। বন্য প্রাণী পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই বন্য প্রাণী রক্ষায় বিভিন্ন দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ করে। এভাবে সবাই সচেতন হলে রক্ষা পাবে বন্য প্রাণী।