সামুদ্রিক কচ্ছপের চলাফেরা খুব বিস্ময়কর। এরা মহাসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে হাজারো মাইল পেরিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে পারে। খাদ্য সংগ্রহের জায়গা বা প্রজনন মৌসুমে বাসা বানানোর সৈকত, ঘুরে ঘুরে ঠিকঠাক চলে আসে। এই চলাচলে এরা সবসময় সোজা পথ ব্যবহার করে না। কম সাঁতরে যাওয়া যাবে, এমন দিকও অনুসরণ করে না। তবে শেষ পর্যন্ত ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
গবেষকেরা বহু বছর ধরে এই চলাচল নিয়ে বিস্মিত হয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জানা গেছে, সামুদ্রিক কচ্ছপ পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে দিক নির্ণয় করে। এটি এমন এক ব্যবস্থা, যেন কচ্ছপের শরীরের ভেতরেই আছে একটি জিপিএস ব্যবস্থা। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেননি, ঠিক কীভাবে কচ্ছপ চৌম্বক ক্ষেত্রের সাহায্যে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে।
একটি নতুন গবেষণা থেকে এই আচরণ নিয়ে আরও ভালো ধারণা পাওয়া গেছে। নেচার জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, বাচ্চা লগারহেড কচ্ছপ নির্দিষ্ট চৌম্বকীয় সংকেত শনাক্ত করতে পারে।
এই গবেষণার সহ-লেখক ক্যাথরিন লোম্যান ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা অ্যাট চ্যাপেল হিলের একজন প্রাণীবিজ্ঞানী। তিনি বলেছেন, ‘এটা সত্যিই আশ্চর্যজনক যে সামুদ্রিক কচ্ছপেরা অদৃশ্য তরঙ্গের তথ্যের বিশাল ভাণ্ডার ব্যবহার করতে পারে। এই তথ্য দিয়ে এরা এমনভাবে দিকনির্ণয় করে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না’।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষকরা একই ধরনের ফলাফল পান যখন কচ্ছপদের কিউবা, ডেলাওয়ার, মেইন, ফ্লোরিডা এবং অন্যান্য স্থানের চৌম্বকীয় সংকেতের সংস্পর্শে কচ্ছপদের রেখেছেন।
এই গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, লগারহেড কচ্ছপদের দুটি ভিন্ন চৌম্বকীয় অনুভূতি রয়েছে। একটিকে এরা কম্পাসের মতো ব্যবহার করে। যা এদের সাধারণ দিকনির্দেশনা দেয়। অন্যটি মানচিত্রের মতো ব্যবহার করে। এটি নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানীদের মতে, এই নতুন আবিষ্কার দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, কেন সামুদ্রিক কচ্ছপ দিক নির্ণয়ে এত দক্ষ।
সামুদ্রিক কচ্ছপের দিকনির্ণয়ের রহস্য উন্মোচনের জন্য গবেষকরা আটক অবস্থায় থাকা বাচ্চা কচ্ছপ পর্যবেক্ষণ করেছেন। যখন বাচ্চা লগারহেড কচ্ছপ বুঝতে পারে খাবার আসছে, তখন এরা আনন্দে নাচে। এর মানে খাবার আসার সময় এরা পানির ওপরে মাথা তোলে। পাখনাগুলো নাড়ায় এবং প্রায়ই চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।
গবেষকরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই অভ্যাসকে পর্যবেক্ষণ করে লগারহেড কচ্ছপের সঙ্গে চৌম্বক ক্ষেত্রের সম্পর্ক বোঝার পরীক্ষা করতে পারবেন। তাঁরা কচ্ছপদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেন, যেন নির্দিষ্ট একটি চৌম্বকীয় ক্ষেত্র খাবারের সঙ্গে যুক্ত হয়। রুশ প্রাণীবিজ্ঞানী ইভান পাভলভের বিখ্যাত কুকুর ও ঘণ্টার পরীক্ষার মতো।
পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র সবখানে একরকম না। এটি স্থানভেদে পরিবর্তন হয়। এর মানে, প্রত্যেক জায়গায় আলাদা চৌম্বকীয় সংকেত রয়েছে। গবেষকেরা ভেবেছিলেন, কচ্ছপের খাবারের নাচ প্রতিক্রিয়া ব্যবহার করে প্রমাণ করা সম্ভব হবে যে লগারহেড কচ্ছপ নির্দিষ্ট চৌম্বকীয় সংকেত শনাক্ত করতে পারে।
এটি প্রমাণের জন্য তাঁরা একটি বাচ্চা কচ্ছপকে পানির ট্যাঙ্কে রাখেন। যেটির চারপাশে কয়েল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সংকেত তৈরি করা হয়। একটি পরীক্ষায় মেক্সিকো উপসাগরের একটি স্থানের চৌম্বকীয় সংকেত তৈরি করে কচ্ছপদের খাবার দেওয়া হলো। আরেক পরীক্ষায় নিউ হ্যাম্পশায়ারের কাছের একটি স্থানের চৌম্বকীয় সংকেত তৈরি করলেন, কিন্তু সেখানে খাবার দিলেন না। গবেষকেরা দুই মাস ধরে একই সময় ধরে কচ্ছপদের এই দুই ধরনের চৌম্বকীয় সংকেতের সংস্পর্শে রাখলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাচ্চা কচ্ছপেরা খাবার ও মেক্সিকো উপসাগরের চৌম্বকীয় সংকেতের সংযোগ বুঝতে পেরেছে এবং নাচতে শুরু করেছে।
পরবর্তীতে কয়েক দিনের ব্যবধানে গবেষকেরা কচ্ছপদের আবার সেই একই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে রাখেন, তবে এবার কোনো খাবার দেননি। তবুও কচ্ছপেরা নাচতে থাকে। এটি দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে এরা নির্দিষ্ট চৌম্বকীয় সংকেতকে খাবারের সঙ্গে সম্পর্কিত করে চিনতে পারে। এমনকি চার মাস পরেও কিছু কচ্ছপ মেক্সিকো উপসাগরের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে রাখায় নেচেছে।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষকরা একই ধরনের ফলাফল পান যখন কচ্ছপদের কিউবা, ডেলাওয়ার, মেইন, ফ্লোরিডা এবং অন্যান্য স্থানের চৌম্বকীয় সংকেতের সংস্পর্শে কচ্ছপদের রেখেছেন।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সামুদ্রিক কচ্ছপ দীর্ঘ বছর ধরে চৌম্বকীয় স্থানাঙ্ক মনে রাখতে পারে। এটি এদের ভয়ংকর ও বিপজ্জনক মহাসাগরীয় পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে।
একইরকম আরেকটি পরীক্ষায় গবেষকেরা কচ্ছপদের ওপর রেডিওতরঙ্গ প্রয়োগ করেছেন। রেডিওতরঙ্গ মোবাইল ফোন ও রেডিও ট্রান্সমিটারে ব্যবহৃত হয়। এই তরঙ্গ দেখার জন্য যে এতে কোনো প্রভাব পড়ে কিনা। বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই ধারণা করেছিলেন, প্রাণীরা নিজেদের দেহে সংঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করতে পারে। তরঙ্গগুলো এই প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, রেডিও তরঙ্গের মধ্যে কচ্ছপ চৌম্বকীয় সংকেত শনাক্ত করতে পারলেও দিক নির্ধারণের ক্ষমতা বা দেহের ভেতরের প্রাকৃতিক কম্পাস ব্যবস্থার কার্যকারিতা বিঘ্নিত হয়। এটি ইঙ্গিত দেয়, সামুদ্রিক কচ্ছপদের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র উপলব্ধির জন্য দুটি পৃথক অনুভূতি রয়েছে।
চৌম্বকীয় মানচিত্রের অনুভূতি নিজের অবস্থান বোঝার জন্য জিপিএসের মতো কাজ করে। আর কম্পাসের অনুভূতি বলে দেয়, কোন দিকে যেতে হবে। সম্ভবত এই পদ্ধতিতেই কচ্ছপ গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত স্থান, যেমন খাদ্য সংগ্রহের জায়গা এবং বাসা বানানোর জায়গায় ফিরে যেতে পারে।
যদিও এই গবেষণা সামুদ্রিক কচ্ছপের দিকনির্ণয়ের বিষয়ে নতুন ধারণা দিয়েছে। তবু এখনও অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখনো কচ্ছপের দেহের ভেতরের সেই অংশটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, যা কচ্ছপকে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
প্রাণীর দেখার জন্য চোখ আছে, গন্ধ বোঝার জন্য নাক আছে। শোনার জন্য আছে কান। কিন্তু কচ্ছপের এখনো চৌম্বকীয় অনুভূতির জন্য কোনো নির্দিষ্ট গ্রহণযন্ত্র (রিসেপ্টর) শনাক্ত করা যায়নি। এটি নিয়ে গবেষকেরা এখন অনুসন্ধান করছেন।
সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন, নিউ সায়েন্টিস্ট