রক্তের গ্রুপের কি পরিবর্তন হতে পারে?
কিশোর আলোর স্বেচ্ছাসেবক আবদুল ইলা সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হয়েছেন সপ্তাহখানেক আগে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেছেন, পায়ের একটি হাড় ভেঙেছে। অস্ত্রোপচার করতে হবে। অস্ত্রোপচারের আগে জোগাড় করে রাখতে হবে একজন রক্তদাতা। ছোটবেলা থেকেই ইলা জেনে এসেছেন যে তাঁর রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ। সে অনুযায়ী রক্ত দিতে ইচ্ছুক একজন ডোনারের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। ডোনার রক্ত দিতে হাসপাতালেও চলে এসেছেন। তবে চিকিৎসক রক্ত সংগ্রহের আগে ইলার রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে দেখতে বললেন। দেখা গেল, ইলার রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ, বি পজিটিভ নয়।
ইলার রক্তের গ্রুপ কি বদলে গেল? নাকি ইলা ভুল জানতেন এত দিন? ভুলই হবে। তবে রক্তের গ্রুপ বদলে যেতে পারে কি না, এ প্রশ্ন থেকেই যায়। এ প্রশ্ন নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বহু বছর ধরে বিভ্রান্তি ছিল। কেউ বলেন, রক্তের গ্রুপের পরিবর্তন হওয়া সম্ভব। কারও মতে, এটি অসম্ভব। আসলে কোনটি? পরিবর্তন হতে পারে, নাকি না?
রক্তের গ্রুপ নির্ধারিত হয় লোহিত রক্তকণিকায় নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন উপস্থিত থাকা না–থাকা দিয়ে। রক্তের চারটি প্রধান গ্রুপ এ, বি, এবি এবং ও। এদের প্রতিটিতে লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন (প্রোটিন) আছে বা নেই, এভাবে নির্ধারিত হয়।
রক্তের গ্রুপ নির্ধারণ করা জরুরি। কারণ, গ্রুপ নির্ধারণ করা থাকলে নিরাপদে রক্ত আদান–প্রদান করা যায়। যেমন যার রক্তের গ্রুপ এ, সে নিরাপদে এ বা ও রক্তের গ্রুপের কারও কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু বি বা এবি গ্রুপের কারও কাছ থেকে রক্ত নিতে পারবে না। জরুরি রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হলে রক্তের গ্রুপ জানা থাকতেই হবে। এই সাধারণ তথ্য জরুরি প্রয়োজনে জীবন বাঁচিয়ে দিতে সাহায্য করে।
আমি কি আমার রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন করতে পারব?
আগেই বলেছি, তোমার রক্তের লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি দিয়ে গ্রুপ নির্ধারিত হয়। এই অ্যান্টিজেন আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পাই মাতা–পিতার কাছ থেকে। কিছু রক্তের গ্রুপ অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। যেমন বি পজিটিভ। অন্যান্য গ্রুপের তুলনায় বেশি সাধারণ। কিন্তু সাধারণ হোক বা দুর্লভ হোক, রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন করা অসম্ভব। কারও যদি রক্তের প্রয়োজন হয়, তাহলে তার গ্রুপের রক্তই তাকে দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে অন্য গ্রুপের রক্ত সরবরাহ করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে এটি শুধু তখনই করা হয়, যখন অন্য কোনো বিকল্প পাওয়া যায় না এবং তার জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
রক্তের গ্রুপ পরিবর্তিত হওয়া দুর্লভ ঘটনা। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পর রক্তের ধরন পরিবর্তনের উদাহরণ আছে। অস্থিমজ্জা থেকে তৈরি হয় লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা। লিউকেমিয়ার মতো কিছু রোগে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। অসুস্থ রোগীর অস্থিমজ্জা সুস্থ দাতার মজ্জা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হতে পারে। যদি রোগী আর দাতার রক্তের ধরন ভিন্ন হয়, তাহলে একটি সফল অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পর দাতার রক্তের গ্রুপ পরিবর্তিত হতে পারে।
আবার কারও প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে যদি তার দেহে প্রচুর রক্ত সঞ্চালন করা হয়, তাহলে অস্থায়ীভাবে একটি ভিন্ন রক্তের গ্রুপ দেখা দিতে পারে। একজন এবি রোগীকে যথেষ্ট পরিমাণ ও গ্রুপের রক্ত দিলে প্রায় সব লোহিত কণিকাকে ও গ্রুপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যে অবশ্য রোগীর অস্থিমজ্জা নিজ গ্রুপের রক্ত তৈরি করে দাতার গ্রুপকে পরিবর্তিত করে ফেলতে পারে।
আরেক ক্ষেত্রে এ গ্রুপের মধ্যে রক্তের গ্রুপ পরিবর্তনের খুব অস্বাভাবিক ও বিরল ঘটনা ঘটে যখন অন্ত্রে একটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটিয়ে একটি এনজাইম তৈরি করে। এই এনজাইম এ গ্রুপের রক্তের অণুকে বি গ্রুপের রক্তের অণুর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ করে তোলে। সাধারণত কোলন ক্যানসার, অন্ত্রে সংক্রমণ বা সেপসিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটতে পারে। তবে খুবই বিরল।
রক্তের গ্রুপ কি পজিটিভ থেকে নেগেটিভ হতে পারে?
রক্তের গ্রুপ পজিটিভ থেকে নেগেটিভ হয়েছে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তবে কিছু লোক এমন দাবি করেন। নিয়মিত রক্ত দান করেন এমন কেউ কেউ দাবি করেন যে তাঁরা বেশ কবার রক্ত দেওয়ার পর রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে দেখেছেন, আগে তাঁদের যে গ্রুপ ছিল বলে জানতেন, তার পরিবর্তন হয়ে গেছে। মনে করা হয় যে রক্তের গ্রুপ যাচাইয়ের পরীক্ষায় ভুলে এমন হতে পারে। তবে এমন হওয়া সম্ভব যে কিছু মানুষের রক্তের ধরন সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে।
রক্তের গ্রুপ পজিটিভ থেকে নেগেটিভ হতে পারে কি না, তা নির্ধারণের জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। কিছু বিরল ঘটনা আছে যেখানে একজনের রক্তের গ্রুপ পজিটিভ থেকে নেগেটিভ বা উল্টোটা হয়েছে। এমন ঘটনা এবি রক্তের গ্রুপ ও রক্তের ধরন নির্ধারণ করে এমন জিনের মিউটেশনের কারণে ঘটে।
বয়সের সঙ্গে রক্তের গ্রুপ কি পরিবর্তিত হতে পারে?
প্রচলিত ভুল ধারণা হলো, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রক্তের গ্রুপের পরিবর্তন হতে পারে। এ ধারণা সঠিক নয়। তোমার রক্তের গ্রুপের পরিবর্তন হতে পারে না, কিছু বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া। তবে একজন ব্যক্তির দুইটি ভিন্ন রক্তের গ্রুপ থাকা সম্ভব। এটি কাইমেরিজম নামে পরিচিত। সাধারণত এ ঘটনা ঘটে যখন একজন ব্যক্তির রক্ত বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয় অন্য দুজন দাতা থেকে। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন রক্তের গ্রুপ একই ব্যক্তির মধ্যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করেই সহাবস্থান করতে পারে।
খাবার, অসুস্থতা, ওষুধসহ অনেক কারণে মানুষের রক্তের গ্রুপ প্রভাবিত হতে পারে। তবে রক্তের গ্রুপের পরিবর্তন একটি দুর্লভ ঘটনা।