৮০ দিনে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ

জুলভার্নের ৮০ দিনে বিশ্বভ্রমণ বইয়ের কথা মনে আছে? কীভাবে কয়েকজন ভ্রমণপিপাসু লোক মাত্র ৮০ দিনে পুরো পৃথিবী ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন, বইটিতে তারই জমজমাট বর্ণনা করেছেন জুলভার্ন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, ৪৭ দিনে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের কথা তোমরা কেউ আগে শোনোনি। এমনই এক কীর্তি গড়েছেন ২৩ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান নেড ব্রকম্যান। আর এই ভ্রমণে তিনি সাহায্য নেননি কোনো যানবাহনের, দৌড়েই ঘুরে ফেলেছেন পুরো অস্ট্রেলিয়া!

নেড ব্রকম্যানের জন্ম অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে। ছোটবেলা থেকেই দৌড়াতে খুব একটা পছন্দ করতেন না তিনি। ফলে কখনো দৌড়ানো বা খেলাধুলার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না তাঁর। দৌড়ের প্রতি ব্রকম্যানের আগ্রহ জন্মায় কোভিড-১৯ মহামারির লকডাউনের সময়। লম্বা একটা সময় ধরে লকডাউন থাকায় বাসায় বসে বসে যারপরনাই বিরক্ত লাগছিল নেডের। বিরক্তি কাটানোর অনেক উপায় ভেবে ঠিক করলেন, কিছুক্ষণ বাইরে দৌড়ে এলে কেমন হয়? কয়েক দিন পর উপলব্ধি করলেন, দৌড়াতে তাঁর বেশ ভালোই লাগছে! নিউ সাউথ ওয়েলসে জন্ম হলেও নেড ব্রকম্যান মা–বাবার সঙ্গে থাকেন সিডনিতে। বাসায় ঘোষণা দিয়ে বসলেন, সিডনি থেকে দৌড়ে তিনি যাবেন ফোর্বসে, তাঁদের ফার্মহাউসে। দূরত্বটাও কম নয়, প্রায় ৬০ কিলোমিটার! মা–বাবারও কোনো আপত্তি ছিল না তাতে। ফলে একদিন সকালে বেরিয়ে পড়লেন ব্রকম্যান। সঙ্গে গাড়িতে করে চললেন তাঁর মা-ও।

সেদিনের শুরুটা ভালোই হয় ব্রকম্যানের। কিন্তু প্রায় অর্ধেক পথ দৌড়ানোর পর বুঝলেন, যত কঠিন ভেবেছিলেন, কাজটি তার থেকেও কঠিন। তবু হাল ছাড়েননি, থামাননি দৌড়ও। কিন্তু প্রায় ৫০ কিলোমিটার যাওয়ার পর আর কিছুতেই পারছিলেন না তিনি। যখন প্রায় ধরেই নিচ্ছিলেন যে তাঁর পক্ষে এই দৌড় শেষ করা সম্ভব নয়, তখন উৎসাহ দিলেন তাঁর মা কাইলি ব্রকম্যান। এত দূর আসার পরে হাল ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না—মায়ের মুখ থেকে এই কথা শুনে নতুন উদ্যম ফিরে পান নেড ব্রকম্যান। এরপর আর থামতে হয়নি, ঠিকই পৌঁছে যান কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

ওই ৬০ কিলোমিটার দৌড়ানোর পর বড় বড় দাতব্য ম্যারাথনগুলোতে অংশ নেওয়ার আত্মবিশ্বাস পান ব্রকম্যান। আর পরবর্তী ৫০ দিনে তিনি অংশ নেন ৫০টি দাতব্য ম্যারাথনে, যার মাধ্যমে সংগ্রহ করেন প্রায় ১ লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলারের চেয়ে বেশি।

এবার লক্ষ্যটা আরও বড় করেন ব্রকম্যান। তিনি ভাবলেন, অস্ট্রেলিয়ার গৃহহীন মানুষদের জন্য কিছু করবেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, দৌড়ে বেড়াবেন পুরো অস্ট্রেলিয়া। পরিকল্পনা নিয়ে ব্রকম্যান যোগাযোগ করেন মোবিলাইজ নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সব ঠিকঠাক করে পার্থের স্কটেসলো বিচ থেকে সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ দৌড় শুরু করেন ব্রকম্যান। মা তো ছিলেনই, এবার আরও যোগ দেন বাবা ইয়ান ব্রকম্যান, বান্ধবী জেমা গ্রিফিন এবং ফটোগ্রাফার ব্র্যাডলি ফারলে। এর পাশাপাশি ব্রকম্যানের স্পনসর এবং ডাক্তার তো ছিলেনই।

অস্ট্রেলিয়াতে এমন দৌড়ানোর ঘটনা এটাই কিন্তু প্রথম নয়। ২০০৫ সালে আকিম হিউকিমিস নামের এক জার্মান পুরো অস্ট্রেলিয়া দৌড়েছিলেন মাত্র ৪৩ দিনে। ব্রকম্যান ঠিক করেছিলেন, এই রেকর্ডটি তিনি নিজের করে নেবেন। অর্থাৎ এর চেয়েও কম সময়ে পুরো অস্ট্রেলিয়া দৌড়াবেন তিনি। কিন্তু দৌড় শুরু করার ১২ দিনের মাথায় চোটে পড়েন তিনি। ফলে দুই দিন বিশ্রামে থাকার পাশাপাশি দুই দিন দৌড়ানোর বদলে শুধু হাঁটতে হয় তাঁকে। ফলে রেকর্ডট আর ভাঙা হয়ে ওঠে না তাঁর। গোটা পথ শেষ করতে তাঁর সময় লেগে যায় ৪৭ দিন। আর এ সময় তিনি দৌড়ে পাড়ি দেন প্রায় ৩ হাজার ৯৫২ কিলোমটার!

কিন্তু রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও অভাবনীয় সাফল্য পান তিনি। প্রায় দেড় মাসের মতো দৌড়ে সংগ্রহ করেন ১৪ লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলার! এত বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে হতভম্ব হয়ে যান স্বয়ং মোবিলাইজের প্রতিষ্ঠাতা নোয়াহ ইয়াং। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ব্রকম্যানের প্রতি অস্ট্রেলিয়ানদের ভালোবাসার কথা জানান তিনি, ‘ব্রকম্যানের ওপর সব সময়ই আমাদের বিশ্বাস ছিল। আমরা জানতাম, ব্রকম্যানকে একবার দেখলেই অস্ট্রেলিয়ানরা ওর প্রেমে পড়তে বাধ্য হবে। টাকার অঙ্কটা দেখুন, সেটিই হয়েছে।’

নোয়াহ জানান, ব্রকম্যানের সংগ্রহ করা টাকা নিয়ে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে মোবিলাইজ। স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে সিডনি, মেলবোর্ন ও ক্যানবেরার গৃহহীন মানুষের একটি তালিকা তৈরি করে কীভাবে তাঁদের সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটি নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা সবাই। এই টাকা দিয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক গৃহহীনকে একটি স্থায়ী নিবাস এবং চাকরির ব্যবস্থা করাই এখন প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য।

নেড ব্রকম্যানের এমন অর্জনে বেশ গর্বিত তাঁর মা–বাবা। গর্বিত তিনি নিজেও। সামনের দিনগুলোয় আরও বিভিন্নভাবে মানুষকে সাহায্য করতে পারবেন, এমনটাই আশা ব্রকম্যানের।