ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসেছে রাফি। বাড়ির পাশের পুকুরপাড়ে বসে আছে এখন। শীতের বিকেল। চারপাশে গাছের পাতাগুলো সোনালি রোদে ঝলমল করছে। পুকুরের পানিতে কী সুন্দর চকচক করছে রোদ! রাফির হাতে ওর স্মার্টফোন। মুঠোফোনের ক্যামেরায় এই সুন্দর দৃশ্য সে ধরে রাখতে চায়। ক্লিক!
ছবি উঠে গেল। রাফি খেয়াল করল, পুকুরে প্রতিফলিত রোদের আলো আর গাছের ছায়াটা ছবিতে একদম নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। বাস্তবের প্রতিচ্ছবি!
মনে মনে রাফি ভাবল, কীভাবে এ রকম ছবি তোলে ক্যামেরা? এই ক্যামেরা কি ওর চোখের মতোই কাজ করে? ঘরে ফিরে সে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে ছোট মামাকে। মামা একটু বিজ্ঞানী ধরনের মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই বলতে পারবেন ক্যামেরার রহস্য।
রাতে খেতে বসে মামাকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেই ফেলল। ‘ক্যামেরা কীভাবে কাজ করে, মামা? তুমি জানো?’
একচামচ ডাল নিয়ে ভাত মাখাচ্ছেন মামা। মুরগির ঝোল আর ডাল মিলে সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। ওরা সব মামাতো-ফুফাতো ভাইবোনেরা একসঙ্গেই বসেছে খেতে। অন্যরা বোধ হয় খানিকটা বিরক্ত হলো। মামা একটু সময় নিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন, ‘সে তো অনেক ব্যাপার! ওসব হাবিজাবি বললে শিউলি পরে তোকে মারই দেবে।’
শিউলি ওর বড় মামার মেয়ে। সে এ কথা শুনে মুখ বাঁকাল। কিছু বলার আগেই ছোট মামা বললেন, ‘ক্যামেরার ইতিহাসটা কিন্তু বেশ মজার। গল্পটা তোদের সবারই ভালো লাগবে।
এখানে একটা সমস্যা আছে কিন্তু। সেটা কি বুঝতে পারছিস? এই যে ভিউফাইন্ডার, এটা আছে ফিল্মের ওপরে। যেহেতু কোণের মান সমান না, কাজেই ভিউফাইন্ডারে যেটা চোখে দেখা যাচ্ছে, ক্যামেরা কিন্তু ঠিক সেটা দেখতে পাচ্ছে না।’
‘এককালে মানুষ ছবি তুলতে পারত না, এটুকু তো বুঝতেই পারিস। তখন মানুষ ছবি আঁকত। জিনিসটা একধরনের হাইব্রিড ব্যাপার! সে সময় গোটা একটা ঘর ব্যবহার করত মানুষ যন্ত্র হিসেবে।’
‘মানে কী!’ প্রশ্ন করল শিউলির ছোট বোন মিলি।
মামা; মানে মিলির চাচা হাসলেন। বললেন, ‘বলছি। এ জন্য দুটো আয়নার সাহায্য লাগত ওদের। কল্পনা কর, একটা অন্ধকার ঘর। ঘরের মাঝখানে ছোট্ট একটা কাচ বসানো টেবিল। ঘরের একপাশে একটা ছোট্ট ছিদ্র। সেই ছিদ্র দিয়ে দিয়ে আলো এসে পড়বে টেবিলের নিচে রাখা একটা আয়নায়। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে রাখা সেই আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে ছবিটি গিয়ে পড়বে টেবিলের কাচে। সেই কাচে আলো-ছায়ার খেলার মধ্যে যে জিনিসের ছবি আঁকা প্রয়োজন, তার প্রতিকৃতি ফুটে উঠবে উল্টোভাবে! এই হলো ক্যামেরা।
‘এই ক্যামেরার ছবি কিন্তু ধরে রাখার উপায় ছিল না। মানে, ছবিটা আসলে তোলা হলো না। তখন তো আর ফিল্ম বা তোদের মুঠোফোনের মতো মেমোরি ছিল না।
‘তখন হতো কী, কাচের নিচ দিয়ে ভেসে আসা আলোয় যার ছবি আঁকা হবে, তার ছাপ বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠত। কাজেই, আঁকিয়ে কাচের ওপরে কাগজ রেখে, ছাপ দেখে দেখে ছবি আঁকতেন। তোরা এভাবে জীববিজ্ঞানের ব্যবহারিকে ছবি আঁকিসনি?’
‘হ্যাঁ, আমি এঁকেছি!’ শিউলি দশম শ্রেণিতে পড়ে। ও-ই বলল কথাটা। নিজের হাতে প্রাচীন ক্যামেরার কাজ-কারবার করে ফেলেছে, ওর মুখে তাই যুদ্ধ জয়ের হাসি।
রাফি জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে ছবি ধরল কীভাবে মানুষ?’
মামা হাসলেন। সবার কৌতূহলী চোখ এখন তাঁর ওপর। বললেন, ‘একেবারে দৌড়ানো যায় না। প্রথমে হাঁটতে শিখতে হয়। মানুষও তা–ই করল। পরের ধাপে তারা এ প্রক্রিয়াকে আরেকটু উন্নত করল।
‘প্রায় অন্ধকার ঘরে আলো আসবে মাথার ওপর দিয়ে। ভেতরের কলকবজা বলতে দুটো কাচ। প্রতিটি কাচে দুইবার পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি করে নব্বই ডিগ্রি বাঁকবে আলো। সমতলের সমান্তরাল আলো নিচে নামবে খাড়াভাবে। সেই আলো দেখে আবার ছবি আঁকা। এই ক্যামেরার একটা গালভারী নামও আছে। ক্যামেরা অবস্কিউরা।
‘এই যে বুদ্ধি, এটা কিন্তু অনেক আগে থেকেই মানুষ জানত, বুঝলি? প্রাচীন গ্রিসে অ্যারিস্টটল নামে এক বিজ্ঞানী ছিলেন। আর এদিকে চীনে ছিলেন “মো জি” নামের এক দার্শনিক। ওনারা প্রথম এই ধারণা দেন। সেটা অনেক অনেক আগের কথা, যিশু খ্রিষ্টের ৪০০ বছর আগের। পরে এক আরব বিজ্ঞানী এই ক্যামেরার কারিকুরি ব্যাখ্যা করেন। এই বিজ্ঞানীর নাম আল হাজেন। ওনার আরবি নাম ইবনে আল হাইসাম। তোরা জানিস তো, আমরা কীভাবে দেখি?’
‘হ্যাঁ, মামা, জানি। কোনো কিছু থেকে আলো আমাদের চোখে এসে পড়লে আমরা সেই জিনিসকে দেখি।’ রাফি বলল।
‘ঠিক বলেছিস,’ মামা বললেন। ‘এ কথা প্রথম আল হাজেনই বলেছিলেন। সেটা এগারো শতকের কথা। আর এটাই আধুনিক ক্যামেরা বিজ্ঞানের ভিত্তি।
‘এরপর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে দুটো উল্লেখযোগ্য বিপ্লব ঘটে গেল ক্যামেরার জগতে। ক্যামেরার পুরো প্রযুক্তিটাকে একটা বাক্সের ভেতর পুরে ফেলল মানুষ। আর তৈরি হলো ফিল্ম।’ মামা একটু থামলেন। তারপর বললেন, ‘একটু কঠিন শব্দ বললে তোরা ভয় পাবি না তো?’
‘না, বলো। আমরা এত বোকা নাকি!’
মামা বললেন, ‘ফিল্ম হলো রাসায়নিকভাবে তৈরি আলোকসংবেদী ফিল্ম। মানে, ফিল্মে আলো এসে পড়লেই সে আলোকে আটকে ফেলবে। তখন যে বস্তুর ছবি তোলা প্রয়োজন, সেটার ছাপ পড়ে যাবে ফিল্মে। এই ফিল্মকে পরে সিলভার হ্যালাইড নামের একধরনের রাসায়নিক দ্রবণে ডুবিয়ে ফটোগ্রাফ বা ছবি তৈরি করা হতো। তোরা কেউ পুরোনো দিনের মুভি দেখেছিস? শার্লক হোমস?’
সব কটা মাথা ওপর-নিচে নড়তে শুরু করল আগ্রহী ভঙ্গিতে। শিউলি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল, মামা চোখের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলেন। ছোট মামা গল্প বলার বুদ্ধি ভালোই জানেন। তিনি বলে চললেন, ‘সেখানে এ ধরনের ক্যামেরা দেখা যায়। তবে এই ক্যামেরা আমরা যেমন দেখি, ঠিক সে রকম নয়। কোনো বাটন ছিল না এই ক্যামেরায়, বুঝলি? তার ওপর লেন্স ছিল দুটো! পুরো কাজটাই করতে হতো আসলে ম্যানুয়ালি।
‘দুটো লেন্সের একটা মূলত যে বস্তুর ছবি তোলা হবে, সেটার অবস্থা আর অবস্থান দেখার জন্য ব্যবহৃত হতো। আজকের দিনে আমরা এটাকে বলি ভিউফাইন্ডার। ওই যে ডিজিটাল ক্যামেরায় একটা ছোট্ট চারকোণা অংশ থাকে না স্ক্রিনের ওপর, যেটায় চোখ রেখে বাইরের ছবিটা দেখা যায়? সে রকম। আরেকটা বাটনের কাজ হলো ছবি তোলা।
‘কিন্তু লেন্স দুটো কেন? আসলে, যে লেন্সে ছবি তোলা হবে, তার ভেতরের মাথায় লাগানো আছে সেই আলোকসংবেদী ফিল্ম। আর বাইরের মুখ ঢাকনা দিয়ে বন্ধ। সেটা দিয়ে দেখতে হলে ঢাকনা খুলতে হবে। কিন্তু ঢাকনা খুললেই ছবি উঠে যাবে ফিল্মে! সে জন্যই, যার ছবি তোলা হবে, তাকে ঠিকঠাক করে বসিয়ে, ইংরেজি মুভির ক্যামেরাম্যান গম্ভীর মুখে বলে, স্মাইল!’
কথার ঢঙে সবাই হেসে ফেলল। মামা আবার হাত দিয়ে অভিনয় করে দেখালেন, যেন ক্যামেরা ধরে আছেন। তারপর বললেন, ‘হাসার সঙ্গে সঙ্গেই সে হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় লেন্সের ঢাকনা। ক্লিক!
‘এই দুই লেন্সের ক্যামেরা পরে আরেকটু উন্নত হলো। লেন্সের ঢাকনা আর হাত দিয়ে সরাতে হয় না, বোতামে চাপ দিলেই ছবি উঠে যায় ফিল্মে। সেখান থেকেই সত্যিকারের আধুনিক ক্যামেরার গল্পের শুরু। এই ফিল্ম নিয়ে একটা মজার ব্যাপার আছে। বড় ভাইয়ার একটা কোডাক ক্যামেরা আছে, তোরা দেখেছিস?’
শিউলি আর মিলি মাথা নেড়ে সায় দিল। রাফিসহ অন্যরা না-বোধক মাথা নাড়ল; দেখেনি।
মামা বললেন, ‘খেয়ে উঠে তোদের দেখাব। ১৮৮৮ সালে জর্জ ইস্টম্যান নামের এক ভদ্রলোক এই ক্যামেরা তৈরি করেন। এগুলোতেই মূলত ফিল্ম ব্যবহৃত হতো তখন। রঙিন ছবি অবশ্য এসেছে আরও কয়েক দশক পরে। যাহোক, তোদের একটা জিনিস দেখাই।’
বাঁ হাতে কায়দা করে মুঠোফোনটা পকেট থেকে বের করে নিলেন ছোট মামা। গুগল করে ওদের একটা ক্যামেরার ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘এই হলো টিএলআর বা টু লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরা। এই ক্যামেরা দিয়েই মূলত আধুনিক ক্যামেরার যাত্রা শুরু। এর ভেতরের কারিকুরিটা শুনলেও তোরা মজা পাবি। শুনবি?’
রাফি বলল, ‘বলো, বলো।’
‘এই যে দেখ’ বলে গুগলে আরেকটা ছবি বের করলেন ছোট মামা, ‘এটা একটা টিএলআর ক্যামেরার ভেতরের গঠন। একেবারে ভেতরের দিকের সরু রেখাটা হলো সেন্সর বা ফিল্ম। ছবি ওঠে এই ফিল্মে। এর সামনে থাকে ঢাকনা বা শাটার। আর, এদের ওপরে থাকে ভিউফাইন্ডার।
এখানে একটা সমস্যা আছে কিন্তু। সেটা কি বুঝতে পারছিস? এই যে ভিউফাইন্ডার, এটা আছে ফিল্মের ওপরে। যেহেতু কোণের মান সমান না, কাজেই ভিউফাইন্ডারে যেটা চোখে দেখা যাচ্ছে, ক্যামেরা কিন্তু ঠিক সেটা দেখতে পাচ্ছে না।’
‘মামা, তুমি কিন্তু জটিল করে ফেলছ! কী বলছ, বুঝতে পারছি না তো।’
শিউলির কথার জবাবে মামা বললেন, ‘একদম সহজ করে বললে, এই ভিউফাইন্ডারে দেখে সোজা ক্লিক করে দিলে যার ছবি তোলা হচ্ছে, তার মাথা কাটা পড়বে! এই হলো কাহিনি, বুঝলি? এ জন্য ক্যামেরাম্যানকে অনেক দক্ষ হতে হতো। বুঝতে হতো, ক্যামেরা ঠিক কতটুকু ওপরে সরালে পুরো জিনিসটার ছবি ঠিকঠাক পাওয়া যাবে। তারপর বোতামে চাপ দিলে সরে যাবে শাটার। ছবি উঠে যাবে ফিল্মে।’
রাফি জানতে চাইল, ‘এখনো তো ক্যামেরা এভাবেই কাজ করে, নাকি?’
ছোট মামা বললেন, ‘এখন অত জটিলতা নেই। এসব জটিলতা বহু আগেই সেরে গেছে। এসএলআর নামে একধরনের ক্যামেরা আছে। তোরা তো আজকের দিনের ডিএসএলআর ক্যামেরা চিনিস, এই ক্যামেরা হলো ওটার ছোট ভাই! ক্যামেরাটা কেমন, সেটা কিন্তু নামের পুরোটা শুনলেই বুঝতে পারবি। এসএলআর মানে হলো সিঙ্গেল লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরা।
‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস, এখানে লেন্স একটাই। আসলে, ফিল্ম আর শাটারের সামনে এখানে একটা আয়না রাখা আছে। লেন্স থেকে আলো এসে এই আয়নায় পড়ে। তারপর সেটা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে বেঁকে যায়, উঠে যায় ওপরের দিকে। সেখানে রাখা আছে একটা প্রিজম। তোরা প্রিজম চিনিস?’
এবারও জবাব দিল শিউলি। ‘হ্যাঁ, ক্লাসে আমাদের নিউটনের প্রিজমের পরীক্ষা পড়িয়েছে তো! ওই যে প্রিজমের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো গেলে রংধনুর সাত আলোয় ভাগ হয়ে যায়, সেটা না?’
‘হ্যাঁ, ওটাই প্রিজম।’ মামা বললেন, ‘কিন্তু ক্যামেরার ভেতরের প্রিজমটা ও রকম নয়। তুই যেটার কথা বললি, সেটার তিনটা তল। কিন্তু ক্যামেরার এই প্রিজম হলো পেন্টাপ্রিজম, মানে পাঁচটা তলের প্রিজম। এই প্রিজমে আলো ঢুকলে কী হবে, বলতে পারিস?’
কেউ কিছু বলল না। মামা রাফিকে বললেন, ‘ডালের বাটিটা ওদিকে রেখেছিস কেন? আমাকে দে।’
রাফি মাঝখানে বাটিটা বাঁদিকে সরিয়ে রেখেছিল, আবার ওটা মামাকে এগিয়ে দিল।
সবার নীরবতার মুখে উত্তরটা মামাই দিলেন, ‘তোরা হয়তো পদার্থবিজ্ঞানে বিষয়টা পড়েছিস। এর নাম পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদের পড়িয়েছে, ভুলে গিয়েছিলাম।’ শিউলি বলল।
মিলি বলল, ‘আমি পড়িনি তো! আমাকে বলো।’ ও এবার পঞ্চম শ্রেণিতে। বিষয়টা তাই একটু খুলে বললেন মামা।
‘আয়নায় আলো পড়লে প্রতিফলিত হয়, জানিসই তো। কিন্তু কিছু আলো প্রতিফলিত না হয়ে নানাদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। এখন একটু বুদ্ধি করে তুই যদি চারটা আয়নার একটা বাক্স বানিয়ে ফেলিস, কী হবে, বল তো? আলোটা প্রতিফলিত হয়ে হয়ে বাক্সের ভেতর ছোটাছুটি করতে থাকবে, তাই না?’
সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
মামা বললেন, ‘বুঝতেই পারছিস, তখন আলোটা আর বাইরে বেরোতে পারবে না। এটাই পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন। কিন্তু চারটা তলের বাক্সের বদলে যদি পাঁচটা তলের প্রিজম হয়, তাহলে খুব মজার একটা ঘটনা ঘটবে। প্রতিফলিত হয়ে হয়ে আলোটা পুরো একপাক ঘুরে ভিউফাইন্ডারের সমতল বরাবর ছুট দেবে, গিয়ে পড়বে তোর চোখে।
‘কিন্তু ছবিটা উঠবে কীভাবে? কেবল শাটার সরালেই তো হচ্ছে না, সেই সঙ্গে আয়নাটাও তো সরাতে হবে। এখানে কারিকুরিটা খুব সরল। আসলে আয়নার মাথায় বসানো আছে একটা কবজা। বোতামে চাপ দিলে আয়নাটা সেই কবজায় ভর দিয়ে ওপরের দিকে উঠে যাবে। সেই সঙ্গে সরে যাবে শাটার। সব বাধা সরে গেলে লেন্সের আলো সোজা এসে পড়বে ফিল্মে। ব্যস!’
রাফি বলল, ‘ফিল্মের কথাই তো শুধু বলছ, মামা। কিন্তু এখন তো আর আমরা ফিল্ম ব্যবহার করি না।’
‘প্রায় অন্ধকার ঘরে আলো আসবে মাথার ওপর দিয়ে। ভেতরের কলকবজা বলতে দুটো কাচ। প্রতিটি কাচে দুইবার পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি করে নব্বই ডিগ্রি বাঁকবে আলো। সমতলের সমান্তরাল আলো নিচে নামবে খাড়াভাবে। সেই আলো দেখে আবার ছবি আঁকা। এই ক্যামেরার একটা গালভারী নামও আছে। ক্যামেরা অবিস্কিউরা।
মামা বললেন, ‘ঠিকই বলেছিস। এর কারণ, ফিল্মে অনেক হ্যাপা। ছবি তোলো, ডেভেলপ করো, আবার সে জন্য সিলভার হ্যালাইডে ডুবিয়ে বসে থাকো। এসব ঝামেলা সমাধান করতেই পরে বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রনিক্যাল সেন্সর বানালেন। আলো পেলেই সে এ ব্যাপারে সব তথ্য গ্রহণ করে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে ফেলে। আর বোতাম চাপলে গ্রহণ করা তথ্য জমা হয়ে যায় সোজা মেমোরি কার্ডে! বোতাম না চাপলেও সমস্যা নেই। ভিউফাইন্ডারেই দেখা যায় সেই ছবি।
‘এবারে তোদের একটা মজার বিষয় বলি। ওই যে এসএলআর বললাম, সেটা তো রাসায়নিক ফিল্মে চলত। এখন তো সব হয়ে গেছে ডিজিটাল। সে জন্যই নামের সামনে “ডি” বসে এসএলআর হয়ে গেছে ডিএসএলআর। মানে, ডিজিটাল সিঙ্গেল লেন্স রিফ্লেকশন ক্যামেরা।’
‘এই তাহলে ব্যাপার!’
‘হ্যাঁ,’ রাফির দিকে তাকিয়ে মামা হাসলেন। ‘কিন্তু এই ক্যামেরার অনেক কাহিনি। ডিসপ্লেতেই কত বিচিত্র জিনিস! এগুলোর প্রতিটার কাজ আছে, ব্যাখ্যা আছে। সঙ্গে আছে একেকটা গল্প, ইতিহাস।’
‘মুঠোফোনের বিষয়টা তো বললে না, ছোট মামা!’ রাফি ধরে বসল।
মামা বললেন, ‘আসল ঘটনা তো ওই একই। ক্যামেরায় একটা ছোট্ট লেন্স আছে। লেন্সটা বাইরের আলো ধরে এনে একটা সেন্সরে ফেলবে। আর সেই সেন্সর আলোর কণাগুলো ধরে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে ফেলবে। আগের দিনের ক্যামেরাগুলোয় যে সেন্সর ব্যবহার করা হতো, সেটাকে বলত সিসিডি সেন্সর। এখন সেন্সর অনেক উন্নত হয়েছে। বেশির ভাগ ডিজিটাল ক্যামেরা আর মুঠোফোনে সিএমওএস নামে একধরনের সেন্সর ব্যবহার করে।
‘আর এটার সবচেয়ে বড় সুবিধাটা তো বুঝতেই পারছিস, ছবি তুললেই তুই ফোনের পর্দায় সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পারিস!’
মামার খাওয়া শেষ। বাকিদেরও খাওয়া শেষ মোটামুটি। ওদের সবাইকে একবার দেখে নিয়ে মামা বললেন, ‘আরও ব্যাপার আছে। ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল লেন্স, টেলিফটো লেন্স, ম্যাক্রোলেন্স—এ রকম অনেক কিছু। এগুলোর কাহিনি পরে কখনো বলব, ঠিক আছে? তবে ক্যামেরার মূল বিষয় আসলে এটুকুই।’
পাশ থেকে ছোট্ট মিলি বলল, ‘যাক, বাবা। এখন তুমি আমাদের একটা ভূতের গল্প বলো!’