মার্ক টোয়েনের লাইব্রেরিখানা নাকি দেখার মতো ছিল। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বই, বই, শুধুই বই! এমনকি কার্পেটের ওপরও গাদা গাদা বই স্তূপাকারে পড়ে থাকত। পা ফেলা ভার। এক বন্ধু তাই মার্ক টোয়েনকে বললেন, ‘বইগুলো নষ্ট হচ্ছে, গোটাকয়েক শেলফ জোগাড় করছ না কেন?’
মার্ক টোয়েন খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে বললেন, ‘ভাই, বলেছ ঠিকই, কিন্তু লাইব্রেরিটা যে কায়দায় গড়ে তুলেছি, শেলফ তো আর সে কায়দায় জোগাড় করতে পারি না। শেলফ তো আর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার চাওয়া যায় না।’
মজার ব্যাপার হলেও সত্যি, অনেকেই আছেন, যাঁরা মার্ক টোয়েনের এই নীতিতে বিশ্বাসী। ধার করে বই নেওয়ার পর আর ফেরত না দেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা একেবারে ওস্তাদ। এভাবে তো কেউ কেউ নিজের বাড়িতে ছোটখাটো এক লাইব্রেরিও বানিয়ে ফেলেন।
কিন্তু সুইডিশদের বেলায় বোধ হয় এমনটা খাটে না৷ কারণ, ‘পাঠক কখনো বই চুরি করে না, আর চোর কখনো বই পড়ে না’ তারা হয়তো এমন নীতিতে বিশ্বাসী! ঘটনাটা ঘটেছিল ৪ নভেম্বর সুইডেনের গোথেনবার্গ সিটি লাইব্ররিতে। রোজকার মতোই সেদিনও লাইব্রেরিতে আসা লোকজন কেউ কেউ দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। কেউ বা শিশুদের আলাদা সেকশনে পরিবার নিয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন। আবার কেউ কেউ কম্পিউটারে কাঙ্ক্ষিত বইটি খুঁজে দেখছিলেন। সবকিছুই যখন স্বাভাবিকভাবে চলছিল, নিশ্চয়ই ভাবছ, তাহলে সমস্যাটা কোথায়। আসলে ৪ নভেম্বর ছিল ‘অল সেইন্টস ডে’। এটি খ্রিষ্টানদের, বিশেষত রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মীয় উৎসব। এদিন সুইডেনে সরকারি ছুটি। গোথেনবার্গের সিটি লাইব্রেরি এদিন বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু ভুলবশত আগের দিন লাইব্রেরির একটি দরজা কেউ বন্ধ করতে ভুলে যায়। পরদিন দর্শনার্থীরা লাইব্রেরি খোলা ভেবে সেখানে ঢুকে পড়েন এবং কর্মীবিহীন লাইব্রেরির মতোই লাইব্রেরিটি ব্যবহার করতে থাকে।
সিটি লাইব্রেরির একজন লাইব্রেরিয়ান লাইব্রেরির পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি দেখেন লাইব্রেরিটি খোলা আর ভেতরে অনেক লোক যাঁর যাঁর মতো পড়াশোনা করছেন। তিনি বেশ অবাক হন আর তাঁর সহকর্মীদের কল করে বিষয়টি জানান। এরপর তাঁরা লাইব্রেরি বন্ধের ঘোষণা দিলে পাঠকেরা খুবই ধীরস্থিরভাবে বই জমা দিয়ে লাইব্রেরি থেকে চলে যান।
এদিন কম্পিউটার অটোমেটেড উপায়ে ২৪৬টি বই ধার নেওয়া হয়েছিল, সব কটি বই ফেরতও এসেছিল। ৪৪৬ জন দর্শনার্থী সেদিন লাইব্রেরিতে এসেছিলেন, কিন্তু লাইব্রেরির কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। একজন কর্মীও ছিলেন না লাইব্রেরিতে, তবু সব দর্শনার্থী নিজ দায়িত্বে লাইব্রেরি ব্যবহার করেন। বিষয়টি সবার জন্য সততা, দায়িত্বশীলতা আর নিজের শহরের সবকিছুর প্রতি ভালোবাসার এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল।
‘অল সেইন্টস ডে’তে গোথেনবার্গ সিটির প্রত্যেক মানুষ নিজেদের অজান্তেই একেকজন যেন সেইন্ট বা সাধু হয়ে উঠেছিলেন! পরবর্তী সময়ে সিটি লাইব্রেরি তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে ধন্যবাদসূচক পোস্ট করলে গোথেনবার্গের নাগরিকেরা জানান, নিজের শহরের সবকিছু যত্ন নিয়ে ব্যবহার করাটা সবার সাধারণ দায়িত্ব।
এ ঘটনা থেকে আমরাও কিন্তু শিক্ষা নিতে পারি।
সূত্র: দ্য লোকাল