মিলান শব্দটা আমার কাছে সীমাবদ্ধ ছিল এসি মিলান আর ইন্টার মিলানে। পাওলো মালদিনি, আন্দ্রে পিরলো, কিংবা কাকা। শহর হিসেবে মিলানের সৌন্দর্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি বা মানুষ নিয়ে জানা হয়ে ওঠেনি। এবারের ঈদে সেটা হলো বেশ কাছ থেকে।
পড়াশোনার জন্য আমি থাকি জার্মানিতে। এক মাস আগের কথা। অনেক গবেষণার পর মনে হলো, ঈদ করার জন্য ইতালি চমৎকার একটা জায়গা হতে পারে। প্লেনের টিকিট কেটে ফেললাম। কোথায় ঘুরব বা কোথায় থাকব, তখনো ঠিক করা হয়নি। পরে বুঝতে পারলাম, দুই দিনে এ শহর দেখে শেষ করা সম্ভব না। তা-ও যতটুকু হয় আরকি।
শুরুতে মিলান সম্পর্কে কয়েকটা কথা না বললেই নয়। ইতালির উত্তরাঞ্চল লোম্বার্দি (Lombardi) নামে পরিচিত। আর এর অঞ্চলের রাজধানী হচ্ছে মিলান। সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স বা অস্ট্রিয়া দিয়ে খুব সহজে মিলানে চলে আসা যায়। ভৌগোলিক অবস্থান, সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে চিন্তা করলে মিলান ইতিহাসে বড় একটা নাম। পশ্চিম রোমান এম্পায়ারের রাজধানী, রেনেসাঁ পেরিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধবিধ্বস্ত হয়েও ইউরোপের মাটিতে মিলান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নেপোলিয়নের রাজা হওয়া বা ভিঞ্চির শিল্প, কী নেই মিলানে!
বার্লিন থেকে ৯ এপ্রিল যখন মিলান পৌঁছেছি, ঘড়িতে সকাল ১০টা। দেরি না করে বাসের টিকিট নিয়ে নিলাম। কারণ, কাছে-দূরে মিলিয়ে মিলানের তিনটি এয়ারপোর্ট আছে। বার্গামো (Bergamo) এয়ারপোর্ট ৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে অবস্থিত। সব মিলিয়ে মিলানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বেলা সাড়ে ১১টা।
শহরের আকর্ষণীয় জায়গার কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে ক্যাথলিক চার্চ দুয়োমো দি মিলানো বা মিলান ক্যাথেড্রাল (Duomo di Milano)। পাঁচ শতাব্দীর বেশি সময় নিয়ে তৈরি এই ক্যাথেড্রালের সামনে এসে যখন দাঁড়িয়েছি, আমার মতো হাজারো মানুষের মেলা। ইউরোপের শীতের বিদায় ঘটেছে, গ্রীষ্ম এসেছে। আর মানুষের ঘোরাঘুরিও শুরু হয়েছে। বাচ্চারা খেলা করছে, কেউ কেউ কবুতরদের খেতে দিচ্ছে। উৎসবের আমেজে অসাধারণ এক পরিবেশ।
দুয়োমো দি মিলানো পৃথিবীর অন্যতম বড় ক্যাথেড্রাল (বিশপের চার্চ)। এই চার্চে ৪০ হাজারের বেশি মানুষের আয়োজন সম্ভব। শোনা যায়, দুয়োমোতে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৪০০ মূর্তি, ১৩৫টি গার্গোয়েল বা মর্কট এবং ৭০০টি ফিগার বা চরিত্র আছে। গোথিক স্থাপত্যের নমুনা হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা এই চার্চ প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষকে মিলানে টেনে আনে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে চার্চের ছাদ থেকে তুষার মোড়ানো আল্পস দেখা যায়। দেখা যায় বিখ্যাত ম্যাডোনিনা, মেরির সোনার রঙের মূর্তি, যা ক্যাথেড্রালের সর্বোচ্চ চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।
স্থাপত্যের আরেক চমৎকার নিদর্শন গ্যালেরিয়া ভিটোরিয়া এমানুয়েলে (Galleria Vittorio Emanuele II)। আকাশচুম্বী কাচের ছাদের নিচে প্রবেশ করলে এই স্থাপত্যের বিশালতা বোঝা যায়। দুয়োমোর ঠিক পাশেই অবস্থিত এই গ্যালারিতে আছে কয়েক শ বছরের পুরোনো দোকানপাট, রেস্তোরাঁ। এ ছাড়া নামকরা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শাখা।
জাদুঘরের শহর মিলান। এক ডজনের মতো জাদুঘর ইতালি ও মিলানের ইতিহাস, ঐহিত্য ধরে রেখেছে শত শত বছর ধরে। পিনাকোটেকা দি ব্রেরা (Pinacoteca di Brera), সান্তা মারিয়া দেলে গ্রাজ্জিয়ে (Santa Maria delle Grazie), দ্য মুসেও দে নভেচেন্তো (The Museo del Novecento) যেগুলোর মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।
বিকেলের দিকে আমার সুযোগ হয়েছিল ব্রেরা আর্ট গ্যালারি ও সান্তা মারিয়ায় যাওয়ার। দর্শনার্থীদের কাছে সান্তা মারিয়ার প্রধান আকর্ষণ লেওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য লাস্ট সাপার’। পাঁচ শতাব্দীর বেশি পুরোনো এই চিত্রকর্মের নাম শোনেনি, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এ ছাড়া চৌদ্দ থেকে বিশ শতকের মধ্যকার সময়ের একঝাঁক শিল্পীর অসাধারণ কাজে ঘেরা ব্রেরা আর্ট গ্যালারিতে আছে চার শতাধিক শিল্পকর্ম। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘দ্য সাপার অ্যাট ইমেয়াস’ (The Supper at Emmaus, 1601), ‘ল্যামেন্টেশন ওভার দ্য ডেড ক্রাইস্ট’ (Lamentation over the Dead Christ, 1483), ‘দ্য ফাইন্ডিং অব দ্য বডি অব সেন্ট মার্ক’ (The Finding of the Body of St. Mark, 1562) ইত্যাদি। মিলান ছেড়ে আবার এসেছি জার্মানিতে, কিন্তু মনটা এখনও পড়ে আছে মিলানেই।