ফেসবুকে একটি কার্ড ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে লেখা আছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে কয়েকটি মৃদু ভূমিকম্প হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে বাংলাদেশ। এখানে আরও বলা হয়েছে, ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এই কার্ডটি ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কার্ডটি ভিত্তিহীন ও বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কোনো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া হয়নি আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। এমনকি নির্দিষ্ট সময়ে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার পদ্ধতি পৃথিবীতে আবিষ্কার হয়নি।
বিজ্ঞানীরা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, টর্নেডো বা সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভবিষ্যদ্বাণী প্রায় সঠিকভাবে করতে পারেন। পুরোপুরি নিখুঁত না হলেও কাছাকাছি থাকে। তবে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া হয় না। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস কয়েক সেকেন্ড আগে দেওয়া সম্ভব হলেও কয়েক ঘণ্টা বা দুই দিন আগে কোনোভাবেই পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে ভূমিকম্প নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে। সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে তিনটি মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে গত রোববার দুপুরে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ২। এর উৎপত্তি ঢাকা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইলের একটি এলাকায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জিওলজিক্যাল সার্ভে বলছে, এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশাল এলাকায়।
ঢাকা কি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় বড় মাত্রায় ভূমিকম্প হলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ঢাকা শহরে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ভবন তাত্ক্ষণিকভাবে ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যাপক প্রাণহানি ও আগুন ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ঢাকার জন্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
সারা বিশ্বে প্রতিবছর লাখ লাখ ভূমিকম্প হয়। প্রতিবছর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় গড়ে ১৭টি। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ৭ মাত্রার ওপরে হলে ভূমিকম্পকে বড় ধরনের ভূমিকম্প বলা হয়। গড়ে বছরে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয় অন্তত একবার। বছরে লাখ লাখ ভূমিকম্পের মধ্যে অধিকাংশ বোঝাই যায় না। প্রত্যন্ত এলাকায় ভূমিকম্পগুলো হয়। যেগুলোর মাত্রা খুব কম।
ভূমিকম্প কেন হয়
প্লেট টেকটোনিকস বা মহাদেশীয় পাতগুলো নড়াচড়ার সময় একটি আরেকটির সঙ্গে বাড়ি খেলে ভূমিকম্প হয়। নড়াচড়ার সময় একটি পাতের আঁকাবাঁকা সীমানায় অন্য পাতের কোনো অংশ আটকে যেতে। একদিকে জড়তা ও আরেক দিকে আটকে না থাকা পাতের গতিশীল অংশটাকে টান দেয়। ফলে ওই অংশটা মুক্ত হলেও শক্তির তীব্র স্রোত পৃথিবীর অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এই শক্তি সবকিছু নাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ভূপৃষ্ঠ নড়ে ওঠে। যাকে আমরা ভূমিকম্প বলি।
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস কি দেওয়া সম্ভব
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বা প্রেডিকশন করা খুব জটিল একটি বিষয়। কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকম্প সরাসরি নির্ণয় করা যায় না। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে একটি বড় ভূমিকম্প হবে, এমন দাবি ভিত্তিহীন। এমন দাবির সুযোগ নেই। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে ওয়েবসাইটে লেখা আছে, ‘ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে বা আর কোনো প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা কখনো এ ধরনের ভয়ংকর ভূমিকম্পের সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি। আমরা জানি না কীভাবে এই ভবিষ্যদ্বাণী করতে হয়। নিকট ভবিষ্যতে জানা যাবে, এমনটা মনেও হয় না।’
তার মানে, আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সত্যিই যদি কোনো ভূমিকম্প হয়ও, তাহলে বুঝতে হবে সেটি কাকতালীয়। কারণ, ভূমিকম্প যেকোনো সময়ই হতে পারে, কিন্তু সেটির পূর্ভাবাস দেওয়া আসলে সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানীরা কিছু প্রাকৃতিক ঘটনার সঙ্গে ভূমিকম্পের সংযোগ বের করার চেষ্টা করেছেন। যেমন ভূমিকম্পের আগে আগে অনেক সময় আশপাশের জলাধারের পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। বিভিন্ন প্রাণীর আচরণে নানা রকম অসংগতি চোখে পড়ে। কিন্তু অনেকভাবে চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারেননি, এ রকম কিছু হলেই ভূমিকম্প হবে। অনেক সময় ভূমিকম্প হয়েছে কিন্তু এসবের কিছু দেখা যায়নি।
ভূমিকম্পের প্রস্তুতি
ভূমিকম্প আসার আগে প্রস্তুত থাকা উচিত। বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন বন্ধ করার নিয়মকানুন পরিবারের সবার জেনে রাখা উচিত। ঘরের ভেতরে তাকের ওপরের দিকে ভারী জিনিসপত্র রাখা যাবে না। নিজেকে শান্ত রাখতে হবে। বাড়ির বাইরে থাকলে ঘরের ভেতরে আসা যাবে না। একতলা দালান হলে দৌড়ে বাইরে চলে যেতে হবে। বহুতল ভবনের ভেতরে থাকলে টেবিল বা খাটের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। লিফট ব্যবহার করা যাবে না। ভূমিকম্প আসছে, এমন গুজবে কান না দিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।