কে বলে ভূত নেই?

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

তাহলে একটা গল্প বলি। তখন আমার বয়স চার–পাঁচ বছর হবে। খেলা শেষে বাসায় ফিরছি। বড় মাঠ। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একটু ভয় ভয় করছে। আমি একা। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে থমকে গেলাম। তাকিয়ে দেখি একটি বিশাল পা। বিকট চেহারার এক ভূত আমার পথ আটকে ফেলেছে। বলছে, ‘তোর ঘাড় মটকে খাব।’ এর মধ্যে এসে জুটল আরেক ভূত। বলল, ‘তুই না, আমি খাব।’ দুই ভূতে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। আমি তো ভয়ে কাঁপছি। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বললাম, ‘তোমরা ঝগড়া কোরো না। আমাকে কে খাবে, সেটা ঠিক করার জন্য তোমরা চলো ওই পুকুরে। দুজন একসঙ্গে পানিতে ডুব দাও। যে বেশিক্ষণ পানির নিচে থাকতে পারবে, সে–ই আমাকে খাবে।’

দুই ভূত ভাবল, নিজেরা ঝগড়া করে সময় নষ্ট না করে বরং পুকুরে ডুব দিই। আমি বললাম, ‘এই যে পুকুরপাড়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। দেখব কে বেশিক্ষণ পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে। আমি রেফারি।’

দুই ভূত ডুব দিল পুকুরে। আমি পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে রেফারিগিরি করছি। কিছুক্ষণ পর একটি ভূত মাথা তুলে চারদিক তাকিয়ে দেখে, অন্য ভূত তখনো পানির নিচে। এই না দেখে সে আমাকে বলল, ‘আমি আবার ডুব দিচ্ছি। কিন্তু খবরদার অন্য ভূতকে বলবে না যে আমি আগে উঠেছি।’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই। কোনো চিন্তা নেই। আবার ডুব দাও। তোমার কথা গোপন রাখব।’

কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় ভূত পানির ওপর মাথা তুলে দেখে, অন্য ভূত তখনো পানির নিচে! সে তো ভীষণ অবাক। বলে, ‘আমি আবার ডুব দিচ্ছি। কিন্তু খবরদার অন্য ভূত যেন এই কথা না জানে।’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই, তুমি নিশ্চিন্তে ডুব দাও।’

এরপর চলতে থাকল দুই ভূতের ডুবাডুবি। এই ফাঁকে আমি এক দৌড়ে বাসায় চলে এলাম। আর সারা রাত ওই দুই ভূত পুকুরে ডুবছে আর উঠছে!

আসলে এটা একটা মজার গল্প। আমরা প্রায়ই ভূতের গল্পের প্রতিযোগিতা করতাম। খুব মজা হতো। এমনকি দু–একবার আমি পুরস্কারও পেয়েছি।

তার মানে ভূত নেই? না–ই যদি থাকে, তাহলে কেন বললাম, ‘কে বলে ভূত নেই?’ আমি আসলে বলতে চেয়েছি, ভূত আছে, কিন্তু সেটা আছে গল্পে। ঠাকুরমার ঝুলিতে। শুধু আমাদের দেশেই নয়। এমনকি এ ধরনের ভূত বিলেত–আমেরিকায়ও আছে। আমরা স্কুলের বাংলা পাঠ্যবইয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটা ছোট প্রবন্ধ পড়েছি। ‘পল্লিসাহিত্য’ নামের প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, আমরা যে ভূতের গল্প পড়ি, হাঁউ–মাঁউ–খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ! এ রকম গল্পের কথা শেক্‌সপিয়ারও লিখে গেছেন। তাঁদের ভাষায় ‘ফি–ফাই–ফো–ফাম, আই স্মেল দ্য ব্লাড অব আ ব্রিটিশ ম্যান!’ বিলেতি মানুষের রক্তের গন্ধ পাচ্ছে ব্রিটিশ দৈত্য, আর আমাদের দেশে ‘মানুষের গন্ধ’ পাচ্ছে রাক্ষস! একই কথা। এগুলো বিভিন্ন দেশের রূপকথার গল্পে পাওয়া যায়।

প্রশ্ন হলো, ভূতের গল্প সব দেশে প্রায় একই রকম কেন? কারণ, শিশুরা এ ধরনের গল্পের মধ্যে একটু শিহরণ বোধ করে, কল্পনাপ্রবণ হয় এবং চিন্তার জগতে কল্পনাশক্তির বিকাশ এক বড় ভূমিকা রাখে।

ভূত–প্রেত বলে আসলে কিছু নেই। কিন্তু এর গল্পগুলো আমাদের কাছে খুব প্রিয়। কারণ এর মধ্যে মজার অনেক কিছু রয়েছে। ওই যে প্রথমেই বললাম, দুই ভূতকে পুকুরে চুবানি খাইয়ে কী আনন্দই না পেয়েছিলাম ছোটবেলায়!