আমেরিকান প্রমিথিউস— খ্যাপাটে বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার
১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের ইয়োর্নাদা দেল মুয়ের্তো মরুভূমি। সেখানে একটি বাংকারের মধ্যে কাউন্টডাউনের অপেক্ষা করছেন একজন বিজ্ঞানী। বাংকার থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা হতে যাচ্ছে। যার সাংকেতিক নাম ট্রিনিটি। কাউন্টডাউন যেন শেষ হতেই চাইছে না। প্রতিটি সেকেন্ডকে মনে হচ্ছে অনন্তকাল। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে বিজ্ঞানীর। সফলভাবে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হলে তাঁর তিন বছরের পরিশ্রম সার্থক হবে। ইতিহাসের পাতায় উঠে আসবেন তিনি। সেই বিজ্ঞানীর নাম জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার।
ওপেনহাইমারের উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। দেখতে হালকা–পাতলা। কিন্তু পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রজেক্টে তিন বছর কাজ করার পর তাঁর ওজন আরও কমে যায়। ওজন হয়ে যায় মাত্র ৫২ কেজি। এরকম একজন লম্বা মানুষের ওজন ৫২ কেজি নিশ্চয়ই খুব কম। যেদিন ট্রিনিটি টেস্ট করা হবে, মানে পারমাণবিক বোমা প্রথমবার বিস্ফোরিত হবে, তার আগের রাতে ওপেনহাইমার মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমান। সারাক্ষণ মাথায় কাজ করছিল দুশ্চিন্তা। এছাড়া ওপেনহাইমার প্রচুর ধূমপান করতেন। ফলে ধূমপানজনিত কাশিও তাঁকে ঘুমাতে দেয়নি।
২০০৫ সালে ইতিহাসবিদ কা বার্ড ও মার্টিন জে শেরউইন ওপেনহাইমারকে নিয়ে লেখেন জীবনীগ্রন্থ। নাম ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’। সেই বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ১৯৪৫ সালের ওই দিনটি ছিল ওপেনহাইমারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি। যাহোক, ওই বইয়ের ওপর নির্ভর করেই চলতি বছর ২১ জুলাই মুক্তি পায় ক্রিস্টোফার নোলানের পরিচালনায় ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমাটি।
প্রথম পারমাণবিক বোমার কাউন্টডাউন যখন শুরু হয়, তখন সেখানে ওপেনহাইমারের পাশে উপস্থিত ছিলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা। বার্ড ও শেরউইন বলেন, ওই কর্মকর্তার থেকে তাঁরা জানতে পেরেছেন, ওই সময় ওপেনহাইমার আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। যেন তিনি নিশ্বাস ফেলতে পারছিলেন না।
এরপরেই ঘটে সেই বিস্ফোরণ। যেন সূর্যকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২১ কিলোটন টিএনটি–সমৃদ্ধ বোমাটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ। এর শকওয়েভ ১৬০ কিলোমিটার দূর থেকেও টের পাওয়া গিয়েছিল। কেঁপে উঠেছিল মরুভূমি। আকাশজুড়ে দেখা গিয়েছিল মাশরুম আকৃতির মেঘ। এ ঘটনা দেখে ওপেনহাইমার দারুণ স্বস্তি পেয়েছিলেন।
এর কয়েক মিনিট পরে ওপেনহাইমারের বন্ধু ও সহকর্মী ইসিডোর রবি তাঁকে দূর থেকে দেখতে পান। তিনি বলেন, ‘আমি কখনো তাঁর সেই হাঁটার দৃশ্য ভুলব না। তিনি যেভাবে গাড়ি থেকে নেমেছিলেন, তা–ও ভোলা সম্ভব নয়। তিনি এমন দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এসেছিলেন, যা দেখেই বোঝা যায়, তিনি নিজের কাজটা ঠিকভাবে করতে পেরেছেন।’
১৯৬০-এর দশকে এক সাক্ষাৎকারে ওপেনহাইমার নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট পরে তাঁর হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভগবদ্গীতার একটি শ্লোক মনে পড়ে। শ্লোকটি ছিল, ‘আমিই এখন পরিণত হয়েছি সাক্ষাৎ মৃত্যুতে, জগৎ ধ্বংসকারীতে।’
এরপর ওপেনহাইমারের বন্ধুদের কথায় জানা যায়, তিনি ধীরে ধীরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মধ্যে ভর করেছিল বিষণ্নতা। কারণ, তিনি জানতেন এরপর কী ঘটতে চলেছে।
একদিন ওপেনহাইমারকে জাপানের আসন্ন পরিণতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতেও শোনা গেছে। কিন্তু কয়েক দিন পরে তাঁর চিন্তা–চেতনা আবার পাল্টে যায়। যাতে বোমা ফেলে সর্বোচ্চ ক্ষতি করা যায়, সে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বার্ড এবং শেরউইনের মতে, ওপেনহাইমার সামরিক কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, যাতে বৃষ্টির দিনে বোমা বিস্ফোরণ না করা হয়। আর খুব বেশি ওপর থেকেও বোমা ফেলা যাবে না। তাতে জাপানের মানুষের খুব বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হবে না। ট্রিনিটি টেস্টের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জাপানের হিরোশিমায় সফলভাবে বোমা বিস্ফোরিত হয়। ওপেনহাইমার তখন পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজয়ী যোদ্ধাদের মতো দুহাত ওপরে তুলেছিলেন।
ওপেনহাইমার ছিলেন ম্যানহাটন প্রকল্পের প্রধান পরিচালক। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি পরমাণু বোমাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারতেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জেরেমি বার্নস্টাইন নামের এক ব্যক্তি কাজ করেন ওপেনহাইমারের সঙ্গে। তিনি ২০০৪ সালে ‘আ পোর্ট্রেট অব অ্যান এনিগামা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ওপেনহাইমারের পরিবর্তে লস আলামোসে অন্য কেউ পরিচালক হলে, ভালো বা খারাপ যেভাবেই হোক, যুদ্ধ শেষ হতো—তবে পারমাণবিক বোমার ব্যবহার ছাড়াই।’
ওপেনহাইমারের চরিত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, মহানুভবতা, হতাশা—সবই ছিল। বার্ড ও শেরউইন ওপেনহাইমারকে ‘রহস্য’ বলে অভিহিত করেছেন। একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হয়েও তাঁর মধ্যে মহান নেতার গুণাবলি ছিল। শৈশব থেকে তিনি বন্ধুদের কাছেও ছিলেন রহস্যময় এক মানুষ।
১৯০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন ওপেনহাইমার। তাঁর মা–বাবা জার্মান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। তাঁরা ছিলেন ইহুদি। বাবার ছিল টেক্সটাইলের ব্যবসা। এই ব্যবসার করেই তাঁরা ধনী হয়েছিলেন। নিউইয়র্কের আপার ওয়েস্ট সাইডে তাঁদের একটি বড় অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। সেখানে তিনজন কাজের মেয়ে, একজন ড্রাইভার ছিল। আর বাড়ির দেয়ালে শোভা পেত ইউরোপিয়ান শিল্পীদের আঁকা ছবি।
এই বিলাসবহুল বাড়িতে থেকেও ওপেনহাইমার ছোটবেলা থেকেই ছিলেন লাজুক স্বভাবের। তাঁর এক ছোটবেলার বন্ধুর মতে, ওপেনহাইমার ছিলেন অন্যদের থেকে আলাদা। দুর্বল, লাজুক ও খুবই বুদ্ধিমান।
খেলাধুলার নেশা ওপেনহাইমের কস্মিনকালেও ছিল না। শৈশবে যখন তাঁর বন্ধুরা মাঠে খেলা করতেন, ওপেনহাইমার তখন বিভিন্ন খনিজপদার্থ সংগ্রহ করতেন। সেন্ট্রাল পার্ক দিয়ে ঘুরে ঘুরে এগুলো সংগ্রহ করতেন। সমবয়সী বন্ধুরা তাঁকে দুর্বল বলে খ্যাপাত। ৯ বছর বয়সেই গ্রিক ও লাতিন ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। একবার নিউইর্কের মিনারেলজিক্যাল ক্লাবে তাঁর পাওয়া খনিজ পদার্থ সম্পর্কে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর এতটাই দক্ষ হাতে চিঠি লিখেছিলেন যে ক্লাবটি তাঁকে প্রাপ্তবয়স্ক ভেবে ভুল করেন। খনিজ পদার্থের বিষয়ে একটি আলোচনা সভার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
বার্ড ও শেরউইনের মতে, ওপেনহাইমার যা ভাবতেন বা করতেন, তাই নিয়েই সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। খেলাধুলায় তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। সাধারণ বাচ্চাদের মতো না হওয়ায় তাঁকে প্রায়ই বিদ্রুপ করা হতো। বন্ধুরা উপহাস করত। কিন্তু তাঁর মা–বাবা ছেলের প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন।
ওপেনহাইমার একবার বলেছিলেন, ‘আমি আবার মা–বাবার আস্থার প্রতিদান দিয়েছি। যাঁরা আমাকে শৈশবে অপমান করেছেন, তাঁরা আমার সংস্পর্শে আসতে পারেননি। এটা তাঁদের দুর্ভাগ্য।’
ওপেনহাইমার আরেকবার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘একটি বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়ে–পাল্টিয়ে বলতে পারবে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি এ বিষয়ে অবশ্যই জানি?’
ওপেনহাইমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছিলেন রসায়ন পড়তে। একই সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের কোর্সও ছিল। পদার্থবিজ্ঞান পড়তে গিয়ে তাঁর ভালো লেগে যায়। কারণ, ল্যাবে বসে বসে টেস্ট করতে তাঁর ভালো লাগত না। এ নিয়ে শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য লেগেই থাকত। একদিন একটি আপেলের মধ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক ভরে রেখে দিয়েছিলেন ওই শিক্ষকের টেবিলে। সৌভাগ্যবশত শিক্ষক সে আপেল খাননি। কিন্তু তিনি ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। ফলে তাঁকে মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হতে হলো।
মনোবিজ্ঞানী চিকিৎসা করে জানালেন, ওপেনহাইমারের সাইকোসিস রোগ আছে। চিকিৎসা করেও এ রোগ ভালো হবে না।
সে সময়ের কথা স্মরণ করে ওপেনহাইমার পরে লিখেছিলেন, তিনি বড়দিনের ছুটিতে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সে কাজটিও তিনি করেননি।
পরের বছর বন্ধুদের সঙ্গে যান প্যারিসে ঘুরতে। সেখানে তাঁর এক কাছের বন্ধু ফ্রান্সিস ফার্গুসন ওপেনহাইমারের বান্ধবীকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। রেগে যান ওপেনহাইমার। পেছন থেকে ফ্রান্সিসের শ্বাস রোধ করে মারার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু এবারও সৌভাগ্য তাঁর সঙ্গেই ছিল।
ফ্রান্সিস এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘আমি ঘাড়ে আঘাত পেয়েছিলাম। তবে সময় মতো দূরে সরে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম। ওপেনহাইমার কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল।’
মনোবিজ্ঞানীরা ওপেনহাইমার যে সমস্যার সমাধান দিতে পারেননি, সেটা দিয়েছিল সাহিত্য। মার্সেল প্রুস্তের ‘আ লা রেচারচে ডু টেম্পস পারডু’ পড়ে তাঁর অভ্যাস পরিবর্তন হয়। সাহিত্য ও দর্শন পাঠ করতে করতে ভালো হয় যায় তাঁর সাইকোসিস রোগও। প্যারিস থেকে তিনি ফিরেছিলেন দয়ালু ও সহনশীল হয়ে।
১৯২৬ সালে ওপেনহাইমার গোটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন। পরিচালক বুঝতে পারেন ওপেনহাইমারের প্রতিভা। তাঁকে এই ইনস্টিটিউটে পড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান পরিচালক। এখান থেকেই তিনি পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ অর্জন করেন। এখানে তাঁর অনেক বন্ধু হয়েছিল। তাঁরাই পরে যোগ দিয়েছিলেন লস আলামোসের ট্রিনিটি প্রকল্পে।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে ওপেনহাইমার কিছুদিন কাজ করেন হার্ভার্ডে। এখানে কয়েক মাস কাজ করার পর চলে যান বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু করেন নিজের গবেষণা। এ সময় তিনি মহাজাগতিক রশ্মি এবং পরমাণুর বিভাজন নিয়ে কাজ করেন। ১৯৩০-এর দশকের শুরুর দিকে তিনি ভগবদ্গীতা পড়ার জন্য সংস্কৃত ভাষা শেখেন। পরে এখান থেকে তিনি ওই উক্তিটি করেছিলেন, ‘আমিই এখন পরিণত হয়েছি সাক্ষাৎ মৃত্যুতে, জগৎ ধ্বংসকারীতে।’ কুরু ও পাণ্ডবদের যুদ্ধের কাহিনি তাঁকে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে উৎসাহিত করেছিল। ১৯৩২ সালে ওপেনহাইমার ভাইকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, যুদ্ধের সময় গীতায় বর্ণিত দর্শনকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওপেনহাইমার দেখা করেন জিন ট্যাকলকের সঙ্গে। ট্যাকলক ছিলেন মনোরোগবিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক। ওপেনহাইমার তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন। অবশ্য ট্যাকলকের চিন্তাভাবনাও ছিল ওপেনহাইমারের মতো রহস্যময়। ওপেনহাইমার একাধিকবার ট্যাকলককে বিয়ের প্রস্তাব দিলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এসময় ওপেনহাইমার ও ট্যাকলকের মধ্যে মৌলবাদী রাজনীতি নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হতো। কারণ, ট্যাকলক মৌলবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। এ জন্য পরে ওপেনহাইমারকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।
যাহোক, ১৯৪০ সালে ওপেনহাইমার জীববিজ্ঞানী ক্যাথেরিন কিটি হ্যারিসনকে বিয়ে করেন। তবে তখনো ক্যাটলকের সঙ্গে ওপেনহাইমারের ঘনিষ্টতা ছিল। কিটি ওপেনহাইমারের সঙ্গে ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করেছিলেন। তিনি ফ্লেবোটোমিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলনে। তাঁর কাজ ছিল বিকিরণের ভয়াবহতা নিয়ে গবেষণা করা।
১৯৩৯ সালে পদার্থবিদরা রাজনৈতিকদের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধ নিয়ে। এ বিষয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন মার্কিন সরকারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ১৯৪২ সালের মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে পারমানবিক বোমা বানানো সম্ভব। কিন্তু কে বানাবেন? নিশ্চই দেশের সেরা বিজ্ঞানীরা। আর সে সময় সেরা বিজ্ঞানীদের তালিকা করতে গেলে নিঃসন্দেহে নাম আসবে ওপেনহাইমারের। ওপেনহাইমারও সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। সেভাবে নিজে প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কমিউনিস্টদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ব্যাপারে জানতে পারলে তাঁকে আর এ প্রকল্পে নেওয়া হবে না।
ওপেনহাইমার এ ব্যাপারে তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আমি যদি কমিউনিস্ট কোনো বন্ধুর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখি, তাহলে সরকারের পক্ষে আমাকে ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়বে। আমি চাই না জাতির প্রতি আমার গ্রহণযোগ্যতা বিঘ্নিত হোক।’
মূলত এ কারণেই তাঁর প্রথম বান্ধবী ক্যাটলগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। গোপনে দেখা করার কারণে বিপদে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। পারমাণবিক বোমা প্রকল্পের জন্য ওপেনহাইমারের নাম প্রস্তাব করা হলে অনেকেই বিরোধিতা করেন। তবে তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে কারও কোনো দ্বিমত ছিল না। তাই ম্যানহাটন প্রকল্পের সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল লেসলি গ্রোভস তাঁকে প্রকল্পের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন।
যুদ্ধের পরে ওপেনহাইমারের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছিল। তিনি পারমাণবিক অস্ত্রকে ‘শয়তানের কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে ওপেনহাইমারকে ডেকে ছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। তিনি রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলেন, ‘আমি অনুভব করি, আমার হাতে রক্ত লেগে আছে।’ প্রত্যুত্তরে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ‘রক্ত লেগেছে আমার হাতে। ওটা নিয়ে আমাকেই ভাবতে দিন।’
গীতা পড়ে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন ওপেনহাইমার। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন হাতে অস্ত্র তুলে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, এতে তাঁর প্রিয়জনেরা মারা পড়বেন। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁকে বোঝান, যাঁরা এ যুদ্ধে মারা যাবেন, তাঁদের মৃত্যু আগেই তিনি লিখে রেখেছেন। অর্জুন হবেন শুধু তাঁদের মৃত্যুর হাতিয়ার।
পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের আগে একই সুরে কথা বলেছিলেন ওপেনহাইমারও। তাঁর সহকর্মীদের বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানী হিসেবে পারমাণবিক বোমা বানানো শুধু আমাদের কাজ। সেটা কীভাবে ব্যবহৃত হবে, তা দেখা আমাদের কাজ নয়।’
কিন্তু যুদ্ধের পরে বিজ্ঞানীর এ মত পাল্টেছিলেন। পারমাণবিক বোমা সফলভাবে বিস্ফোরণের পরে তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আরও শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা তৈরির জন্য। কিন্তু ওপেনহাইমার সরাসরি তার বিরোধিতা করেন।
কিন্তু হঠাৎ এ ধরনের বিরোধিতা ভালো চোখে দেখেনি মার্কিন সরকার। ১৯৫৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার তদন্ত শুরু করে। কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স। এ সময় অনেক একাডেমিক সদস্য তাঁর পক্ষ নিয়েছিলেন। সাহায্য করেছিলেন ওপেনহাইমারকে। কিন্তু মার্কিন সরকার তারপরও তদন্ত করে। অবশ্য তদন্তে তাঁর ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ১৯৬৩ সালে তাঁকে এনরিকো ফার্মি পুরস্কার দেওয়া হয়। আর তাঁর সিকিরিউটি ক্লিয়ারেন্স ফেরত দেওয়া হয় মৃত্যুর ৫৫ বছর পরে ২০২২ সালে।
ওপেনহাইমারের বাকি জীবন কেটেছে দোলাচলের মধ্যে। একদিকে তিনি তাঁর কাজ নিয়ে যেমন গর্বিত ছিলেন, তেমনি তাঁর পরিণতি নিয়েও ভুগেছেন অপরাধবোধে। তাঁর জীবনের শেষ ২০ বছর কাটে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্স স্টাডির পরিচালক হিসেবে। এ সময় তিনি আইনস্টাইন ও অন্যান্য পদার্থবিদদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন, বিজ্ঞানের নিজস্ব প্রভাবগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য মানবিকতার প্রয়োজন।
বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই প্রচণ্ড ধূমপান করতেন ওপেনহাইমার। এর প্রভাবে তিনি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ৬৩ বছর বয়সে মারা যান। মৃত্যুর দুই বছর আগে ওপেনহাইমার বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের কাজ নতুন জিনিস শেখা, একই ভুল দুই বার করা না।’