কাতার বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পরপরই তোমরা হয়তো দেখেছো, নিজ দলের খেলার দিন গ্যালারিতে নানাভাবে প্রতিবাদ করেছেন ইরানের সমর্থকেরা। ইরান দলের খেলোয়াড় আর কোচিং স্টাফও যোগ দিয়েছেন সমর্থকদের সঙ্গে। কিন্তু এর পেছনের কারণটা কি জানো? আসলে কী হচ্ছে ইরানে?
অনেক দিন ধরেই বিক্ষোভে উত্তাল ইরান। এর সূচনা হয় প্রায় তিন মাস আগে। ‘সঠিকভাবে হিজাব না পরা’র অভিযোগে মাসা আমিনি নামের এক কুর্দি তরুণীকে গ্রেপ্তার করে ইরানের নীতি পুলিশ। এর কিছুদিন পরেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। তিন দিন কোমায় থাকার পর সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখ হাসপাতালে মৃত্যু হয় আমিনির। অস্বাভাবিক মৃত্যুটি নিয়ে তদন্ত শেষে কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়, আগের অসুস্থতার কারণে মৃত্যু হয়েছে ২২ বছর বয়সী ওই তরুণীর। কিন্তু এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় আমিনির পরিবার। তারা দাবি করে, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে আমিনিকে।
এর পরের দিন আমিনির নিজ এলাকায় শুরু হয় আন্দোলন, যা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। নিজ নিজ জায়গা থেকে ইরানের নাগরিকেরা, বিশেষ করে নারীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, নারীরা নিজেদের স্বাধীনতা আর জীবনের নিরাপত্তার জন্য স্লোগান দিচ্ছেন। অনেকে নিজের মাথার হিজাব খুলে পুড়িয়ে ফেলছেন। পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়েছে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দাঙ্গার ভিডিও।
ইরানের এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা। নিজ নিজ জায়গা থেকে সমর্থন দেন বিনোদন জগতের তারকারাও। সব মিলিয়ে বহির্বিশ্বেও এই আন্দোলন নিয়ে বেশ ভালো সাড়া জাগে।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় কাতার বিশ্বকাপ। অনেক আগেই বাছাই পর্বের বৈতরণী পেরোনো ইরান অংশ নেয় তাতে। দলকে সমর্থন দিতে কাতারে পাড়ি জমান ইরানের অনেক নাগরিকও। ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই প্রতিযোগিতার দিকে যে চোখ থাকে পুরো বিশ্বের, তা ভালোমতোই জানা আছে তাদের। ফলে আন্দোলনের কথা পুরো বিশ্বকে আরো ভালোমতো জানানোর জন্য তারা বেছে নেন এই মঞ্চকে। ইরানের খেলার দিন সবাই উপস্থিত হন আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন জার্সি, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার নিয়ে। পুলিশি হেফাজতে নিহত মাসা আমিনির নাম লেখা জার্সি হাতে করে নিয়ে আসেন এক দর্শক। অনেকে গালে লাল রঙ দিয়ে অশ্রু এঁকে নিয়ে আসেন। এই প্রচেষ্টা বৃথা যায়নি, বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের নজরে চলে আসেন তাঁরা। ইরানিদের আন্দোলন হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল ইরানের ফুটবল দলের সদস্যদেরও। তাই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে খেলোয়াড়েরাও একাত্মতা প্রকাশ করেন দর্শকদের সঙ্গে। সেজন্য অভিনব এক উপায় বেছে নেন তাঁরা।
বিশ্বকাপে ইরানের প্রথম খেলাটি ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। খেলার শুরুতে মুখোমুখি হওয়া দুই দলের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর নিয়ম বহু দিনের। আর এ সময় খেলোয়াড়রা স্বাভাবিকভাবেই গলা মেলান গানের সঙ্গে। কিন্তু ইরান ফুটবল দলের মাথায় ঘুরছিল ভিন্ন কিছু। যখন মাঠে তাঁদের জাতীয় সংগীত বেজে ওঠে, সবাই অবাক হয়ে লক্ষ করেন, একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন ইরানের ফুটবলাররা। কেউই গাইছেন না নিজ দেশের জাতীয় সংগীত। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বোঝা না গেলেও, খেলা শেষ হতে হতে সবাই বুঝে ফেলেন, দেশের আন্দোলনরত নাগরিকদের সমর্থনের জন্য এমন অভিনব উপায়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ইরানের খেলোয়াড়েরা। পরের ম্যাচেও একই কাজ করতে চেয়েছিল দলটি, কিন্তু নানা চাপে বাধ্য হয়ে তা আর করা হয়নি দলটির। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার, হয়ে গেছে। বিশ্ববাসীর কাছে পৌছে গেছে ইরানের বার্তা।
নভেম্বরের মাঝামাঝিতে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। এ অঞ্চলটি মূলত কুর্দি–অধ্যুষিত এলাকা। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, এসব অঞ্চলে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী ভারী অস্ত্রসজ্জিত গাড়ি নিযুক্ত করেছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইরানের ম্যাচের পর তেহরানে বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন করেন ইরানিরা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত আন্দোলনে অন্তত ৬০ জন শিশুসহ চার শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম সিএনএনের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ইরানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে শারিরীক নির্যাতনের পাশাপাশি আন্দোলনকারীরা যৌন নিপীড়নেরও শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে ইরান সরকার প্রথম দিকে কিছু না জানালেও গত ৩ ডিসেম্বর অন্তত ২০০ মানুষ নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করে।
এত মানুষ মারা গেলেও এ আন্দোলের পেছনে নিজেদের দায় দেখছে না ইরান সরকার। তারা জনগনের এই আন্দোলনের জন্য ক্রমাগত পশ্চিমাদের উসকানিকে দায়ী করে আসছে। আন্দোলনকারীদের সরকার ‘সশস্ত্র সন্ত্রাসী’ আর ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে আখ্যা দেয়। এজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার ঘোষণাও দেয়।
সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলেও ইরানিদের এই আন্দোলন একেবারে বৃথা যায়নি। আন্দোলন শুরুর আড়াই মাস পর ইরান সরকার তাদের নীতি পুলিশের কার্যক্রম ‘আপাতত’ বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে। তবে নীতি পুলিশ পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে কি না, এ সংক্রান্ত কোনো আশ্বাস তারা দেয়নি। তবে মেয়েদের হিজাবসংক্রান্ত আইন সংশোধন করা যায় কি না, এ নিয়ে কাজ চলছে বলে জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
সরকারের এমন ‘ধোঁয়াটে’ ঘোষণা ও মৃত্যুসংখ্যার স্বীকারোক্তির পরও ইরানে আন্দোলন বন্ধ হয়নি। তেহরানের সড়কগুলোতে অনেক নারীই এখনো মাথায় ওড়না ছাড়াই চলাফেরা করছেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধ, অগ্নিসংযোগসহ বিক্ষোভও চলছে। ফলে সরকারের এই ঘোষণা ও স্বীকারোক্তি আন্দোলনরত ইরানিদের প্রাথমিক বিজয়, না কি শুধুই আন্দোলনের মোড় ঘোরানোর অস্ত্র, সেটা এখনও অস্পষ্টই থেকে যাচ্ছে।