মহাবিশ্বের প্রথম আলোর সন্ধানে

১০ বিলিয়ন, মানে প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার। এক হাজার কোটি ডলার খরচ করে বানানো একটা টেলিস্কোপ ১৩০০ কোটি বছরের বেশি পুরোনো মহাবিশ্বের ছবি তুলেছে। পাঁচটা ছবি। তাতেই সাড়া পড়ে গেছে পৃথিবীজুড়ে। কিন্তু আমাদের লাভটা কী? এসব ছবি আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কী কাজে আসবে?

তোমরা যারা এ লেখা পড়ছ, এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই তোমাদের মাথায় একবার হলেও উঁকি দিয়ে গেছে ১২ জুলাই জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের প্রথম ছবি প্রকাশের পর! প্রশ্নটা নিয়ে আমরা লেখাটির একদম শেষে কথা বলব। শুরুতে বরং দেখে নেওয়া যাক, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কী, এটা কীভাবে কাজ করে এবং এর মাধ্যমে আমরা কতটা অতীতের মহাবিশ্বের ছবি দেখতে পাব।

দুই

কিশোর আলোর গত ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যায় জেমস ওয়েব নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলাম। তবু সংক্ষেপে বিষয়গুলো আরেকবার দেখে নিই।

জেমস ওয়েব নভোদুরবিন উৎক্ষেপণ করা হয় গত ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১–এ। নভোদুরবিনটি নির্মাণে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা), ইউরোপিয়াস স্পেস এজেন্সি (ইসা) এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ)। ফ্রেঞ্চ গায়ানা থেকে এ নভোদুরবিন উৎক্ষেপণ করা হয় আরিয়ান ৫ রকেটের সাহায্যে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এই দুরবিন নির্মাণের পেছনে কাজ করেছেন। বর্তমানে দুরবিনটি পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরের এল ২ বিন্দুতে অবস্থান করছে।

জেমস ওয়েবের মূল আয়নাটি ষড়্‌ভুজাকৃতির। ১৮টি ছোট আয়না মিলে তৈরি এ আয়না সোনার আবরণে মোড়া। দ্বিতীয় আরেকটি আয়না আছে, যেটি মূল আয়না থেকে প্রতিফলিত আলোকে কেন্দ্রীভূত করবে ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্স ইনস্ট্রুমেন্ট মডিউলের ওপর। এই মডিউল গৃহীত আলো থেকে ছবি তৈরি করবে। পাশাপাশি টেলিস্কোপটিতে আছে স্টার ট্র্যাকার—ছোট ছোট কিছু টেলিস্কোপ, নক্ষত্রদের প্যাটার্ন খেয়াল রেখে মূল টেলিস্কোপটিকে লক্ষ্যের দিকনির্দেশনা দেবে।

এবারে তাকানো যাক ওয়েবের ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্স ইনস্ট্রুমেন্ট মডিউলের (আইএসআইএম) দিকে। এতে আছে একটি নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা (এনআইআর ক্যাম)। অবলাল আলোয় ছবি তোলা এবং টেলিস্কোপটিকে লক্ষ্যের দিকে ফোকাস করার মূল সেন্সর হিসেবে কাজ করে এটি। বলা যায়, এটি জেমস ওয়েবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যামেরা। কেন, সেটা আমরা বুঝব ওয়েবের ছবিগুলো নিয়ে কথা বলার সময়।

৭০০ ন্যানোমিটার থেকে ১ মিলিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে বলে অবলাল বা অবলোহিত আলো। এ আলো চোখে দেখা যায় না। এর মধ্যে ৮০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে বলে নিয়ার ইনফ্রারেড বা দৃশ্যমান আলোর নিকটস্থ অবলাল আলো। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যাম এই আলো ধরার চেষ্টা করবে।

পাশাপাশি, সায়েন্স ইনস্ট্রুমেন্ট মডিউলে আছে একটি মিড ইনফ্রারেড ইনস্ট্রুমেন্ট (এমআইআরআই)। মাত্র ৭ কেলভিন তাপমাত্রায়ও কার্যকর থাকে এই ক্যামেরা কাম স্পেকট্রোগ্রাফ বা বর্ণালিমাপক যন্ত্র। এটি মিড থেকে ফার ইনফ্রারেড, মানে তিন হাজার ন্যানোমিটার থেকে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলাল আলো ধরার কাজ করে। সেই সঙ্গে থাকছে একটি ফাইন গাইডেন্স সেন্সর (এফজিএস) এবং নিয়ার ইনফ্রারেড ইমেজার অ্যান্ড মিটলেস স্পেকট্রোগ্রাফ। অতি ম্লান নক্ষত্রের আলোকেও শনাক্ত করতে পারে এটি।

অতি ম্লান মানে, ১৮ ম্যাগনিচ্যুড বা উজ্জ্বলতাবিশিষ্ট নক্ষত্রের আলো। এই ‘ম্যাগনিচ্যুড’ একটি এককহীন উজ্জ্বলতার পরিমাপ। প্রতি ৫ ম্যাগনিচ্যুডের পার্থক্যের ফলে উজ্জ্বলতার পার্থক্য হয় ১০০ গুণ। যেমন ১ ম্যাগনিচ্যুডবিশিষ্ট নক্ষত্র ৬ ম্যাগনিচ্যুডবিশিষ্ট নক্ষত্রের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি উজ্জ্বল। মানে ম্যাগনিচ্যুডসংখ্যা যত বড়, উজ্জ্বলতা তত কম। এভাবে অতি ম্লান নক্ষত্রের আলো শনাক্ত করে, এর ওপর ভিত্তি করে টেলিস্কোপটিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে তাক বা ফোকাস করতে পারবে এফজিএস। স্পষ্ট ও পরিষ্কার ছবি ওঠাতেও ভূমিকা রাখে এটি।

একটি আলাদা নিয়ার ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফও (এনআইআরস্পেক) থাকছে। একসঙ্গে ১০০টি গ্যালাক্সির বর্ণালি ধারণ ও প্রক্রিয়াজাত করতে পারে এই যন্ত্রাংশ। এ–ই হলো জেমস ওয়েবের ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্স ইনস্ট্রুমেন্ট মডিউল। আগেই যেমন বলেছি, এর কাজ গৃহীত আলো থেকে ছবি তৈরি করা। এসব ছবি ও তথ্য পৃথিবীতে পাঠাবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘হাই গেইন অ্যানটেনা’।

সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপ ও আলো থেকে আড়াল করে রাখতে হবে এসব যন্ত্র। নাহলে সহজ করে বলা যায়, একদিকে উত্তাপে নষ্ট হয়ে যাবে এসব যন্ত্র ও আয়না, অন্যদিকে সূর্যের প্রচণ্ড আলোয় ঝলসে যাবে ক্যামেরার লেন্স। ফলে বহুদূর মহাবিশ্বের ম্লান আলো দেখা সম্ভব হবে না। সে জন্য সূর্যের আলো এবং উত্তাপ থেকে ওয়েবের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রগুলো আড়াল করে রাখবে বিশাল সানশিল্ড। দৈর্ঘ্যে এটি প্রায় ২২ মিটার ও প্রস্থে প্রায় ১৪ মিটার।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের বিভিন্ন অংশ

জেমস ওয়েবের মূল নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার কাজ করবে এর স্পেসক্র্যাফট বাস। আর এসব বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য মূল শক্তি জোগাবে এর সোলার পাওয়ার অ্যারে বা সৌরকোষ।

সংক্ষেপে এটাই হলো জেমস ওয়েবের গঠন। এবার একটু দেখে নেওয়া যাক, হাবলের উত্তরসূরি এই নভোদুরবিনের বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য কী! বিজ্ঞানীরা এই দুরবিন থেকে ঠিক কী আশা করছেন!

এককথায় বলা যায়, জেমস ওয়েবের মূল লক্ষ্য হলো শিশু মহাবিশ্বকে আরও ভালোভাবে জানার চেষ্টা করা। এ জন্য জেমস ওয়েব মূলত তিনটি কাজ করবে। এক, মহাবিশ্বের প্রথম আলোর সন্ধান। আমাদের মহাবিশ্বের বয়স ১৩৮০ কোটি বছর। জেমস ওয়েব প্রায় ১৩৫০ কোটি বছরের পুরোনো মহাবিশ্বের ছবি তুলতে পারে। হাবলের সঙ্গে তুলনা করে যদি বলি, হাবল যেখানে বিগ ব্যাংয়ের প্রায় ১০০ কোটি বছর পরের আলো ধরতে পারত, জেমস ওয়েবের সেখানে প্রায় ৩০ কোটি বছর পরের আলো ধরতে পারার কথা নিশ্চিতভাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, অন্ধকার যুগ কেটে গিয়ে এ সময়ই, অর্থাৎ মহাবিশ্বের জন্মের প্রায় ৩০ কোটি বছর পর প্রথম আলো ফোটে মহাবিশ্বে। জেমস ওয়েব এই আলো খুঁজে ফিরছে।

দুই, মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রের আলোর সন্ধান। এই আলোর খোঁজ পেলে বোঝা যাবে, এসব নক্ষত্রের জীবনচক্র কেমন ছিল। বিজ্ঞানীদের ধারণা, শিশু মহাবিশ্বের প্রথম দিকের দানব নক্ষত্রগুলো হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। পরে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে এদের মৃত্যু হয়। এ সময় তৈরি হয় পর্যায় সারণির ভারী সব পদার্থ যেমন লোহা। বর্তমানে আমরা যেসব তরুণ নক্ষত্র দেখতে পাই, এসব নক্ষত্রে এত ভারী পদার্থ তৈরি হওয়ার কথা নয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আগেকার দানব নক্ষত্রদের ধ্বংসাবশেষ ওসব ভারী পদার্থের চিহ্নই বর্তমানের তরুণ নক্ষত্রগুলোর বুকে শনাক্ত করা যাচ্ছে। ব্যাপারটা যাচাই করে দেখা যাবে জেমস ওয়েবের ‘চোখ’ দিয়ে।

তিন, শিশু মহাবিশ্বে জন্ম নেওয়া প্রাচীন গ্যালাক্সিদের খোঁজ করছে জেমস ওয়েব। এর মাধ্যমে বোঝা যাবে মহাবিশ্বের ক্রমপরিবর্তনের বিষয়টি, জানা যাবে গ্যালাক্সিদের মধ্যে এত বৈচিত্র্য কীভাবে এল। এ ছাড়া ডার্ক ম্যাটারের খোঁজ করবে জেমস ওয়েব। গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ব্যবহার করে দূর, বহুদূরের গ্যালাক্সির ঘূর্ণন পরীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করবে, সেসব জায়গায় ডার্ক ম্যাটার আছে কি না। থাকলে সেসব গ্যাল্যাক্সির ওপর কী রকম প্রভাব ফেলছে ইত্যাদি।

ছবি ১.১: স্ম্যাক্স ০৭২৩

শিশু মহাবিশ্বকে জানার পাশাপাশি জেমস ওয়েবের চতুর্থ লক্ষ্য হলো, সৌরজগতের বাইরে প্রাণের উপযোগী গ্রহে প্রাণের সন্ধান। এমনকি সৌরজগতের ভেতর নেপচুন এবং ইউরেনাসকেও আরও ভালোভাবে জানার চেষ্টা করবে এ নভোদুরবিন। তৈরি করবে এদের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার মানচিত্র (মানে, কোথায় কী রকম তাপমাত্রা সাধারণত থাকে)। তালিকা করবে এদের মধ্যকার রাসায়নিক পদার্থদের। জানতে চেষ্টা করবে, এরা একে অন্যের থেকে এবং প্রতিবেশী শনি ও বৃহস্পতি থেকে কতটা ভিন্ন।

জেমস ওয়েবের তোলা যে পাঁচটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলো এসব লক্ষ্য পূরণে জেমস ওয়েবের সামর্থ্যের কথা জানান দিচ্ছে জোরালোভাবে। এবার ছবিগুলোর কথা জানব সংক্ষেপে।

তিন

পাঁচটি ছবির প্রথম ছবিটি (১.১) একটি ডিপফিল্ড ছবি। এর নাম, স্ম্যাক্স ০৭২৩। ডিপ ফিল্ড ছবি মানে, এতে একসঙ্গে অনেক, অনেক গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রকে দেখা যাচ্ছে। তবে এর মূল ফোকাস পৃথিবী থেকে ৪ কোটি ৬০ লাখ বছর দূরের (বা অতীতের) স্ম্যাক্স ০৭২৩ নামের একটি গ্যালাক্সি ক্লাস্টার, অর্থাৎ গ্যালাক্সিপুঞ্জ। এই গ্যালাক্সিপুঞ্জের গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ব্যবহার করে এর অনেক পেছনের, অনেকটা দূরের এবং বহু অতীতের গভীরতম মহাকাশের বিভিন্ন নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির ছবিও তুলেছে জেমস ওয়েব। ৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে প্রায় ১৩০০ কোটি বছর আগের এসব গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের ছবি দেখা যাচ্ছে এই একটি ছবিতেই। ছবিটি তুলতে জেমস ওয়েবের প্রায় সাড়ে ১২ ঘণ্টা সময় লেগেছে। শিশু মহাবিশ্বকে আরও জানার ক্ষেত্রে জেমস ওয়েব যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এই ছবি সে কথা জানান দিচ্ছে জোরালোভাবে।

দ্বিতীয় ছবিটি (১.২) একটি এক্সোপ্ল্যানেট, অর্থাৎ সৌরজগতের বাইরের গ্রহের। পৃথিবী থেকে প্রায় ১১৫০ আলোকবর্ষ দূরের গ্যাসীয় এই গ্রহের নাম ওয়াস্প–৯৬ বি। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ভেতর পাঁচ হাজার এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এটা তার একটা। পৃথিবী থেকে তাকালে দক্ষিণ মহাকাশের ফিনিক্স তারামণ্ডলে এর অবস্থান।

ছবি ১.২: ওয়াস্প-৯৬ বি

জেমস ওয়েব গ্রহটির বর্ণালি পর্যবেক্ষণ করে ছবিটি প্রকাশ করেছে। পানির উপস্থিতি শনাক্ত করেছে এর বায়ুমণ্ডলে। মেঘ ও কুয়াশার চিহ্নও শনাক্ত করেছে। জেমস ওয়েবের নিয়ার ইনফ্রারেড ইমেজার অ্যান্ড স্লিটলেস স্পেকট্রোগ্রাফ এই ছবি তুলতে ব্যয় করেছে ৬ ঘণ্টা ২৪ মিনিট। ফলাফল দেখা যাচ্ছে ছবির গ্রাফে। যে বক্ররেখা পাওয়া গেছে, এটিই সেই বর্ণালি। এই বক্ররেখায় নির্দিষ্ট রঙের আলোর উজ্জ্বলতা সামান্য কমে যাওয়া থেকে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে কী কী গ্যাসের অণু আছে, তা শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এভাবেই পাওয়া গেছে পানির চিহ্ন। ছবিটি বলছে, সৌরজগতের বাইরের বিভিন্ন গ্রহের ব্যাপারে জানা ও ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে জেমস ওয়েব নভোদুরবিন।

ছবি ১.৩: কারিনা নীহারিকা

তৃতীয় ছবিটি (১.৩) কারিনা নীহারিকার। পৃথিবী থেকে প্রায় ৭৬০০ আলোকবর্ষ দূরে এই নীহারিকার অবস্থান। ধূলিকণা ও গ্যাস–মেঘের এই নীহারিকার একটি অংশকে বলা হয় কসমিক ক্লিফ। কারণ, এই অংশের ছবিতে পাহাড়ের শীর্ষ ও খাদের মতো কিনারা দেখা যায়। জেমস ওয়েবের ছবিতে এই কসমিক ক্লিফই দেখা যাচ্ছে। অঞ্চলটি মূলত একটি স্টেলার নার্সারি, অর্থাৎ নক্ষত্রের জন্মস্থান। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নতুন নক্ষত্র গঠিত হচ্ছে। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে নক্ষত্রের গঠন ও জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়। এ অঞ্চলের ছবি হাবল টেলিস্কোপও আগে তুলেছে। কিন্তু জেমস ওয়েব যতটা স্পষ্ট ছবি তুলেছে, আর কোনো দুরবিন থেকে তা পাওয়া যায়নি। ছবিটি নক্ষত্রের জীবনচক্র বুঝতে সাহায্য করবে বিজ্ঞানীদের। পাশাপাশি, শিশু মহাবিশ্বের নক্ষত্রদের নিয়ে আরও জানতে জেমস ওয়েব কী রকম ভূমিকা রাখবে, সে ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে এ ছবি থেকে।

ছবি ১.৪: সাউদার্ন রিং নীহারিকা

চতুর্থ ছবিতে (১.৪) দেখা যাচ্ছে, পৃথিবী থেকে প্রায় ২০০০ আলোকবর্ষ দূরের প্ল্যানেটরি বা গ্রহীয় নীহারিকা, সাউদার্ন রিং। গ্রহীয় নীহারিকা মানে, মৃত নক্ষত্রকে ঘিরে ছড়িয়ে থাকা গ্যাসীয় মেঘ। মহাকর্ষের টানে এসব মেঘ এক হয়ে তৈরি করবে নতুন কোনো গ্রহ বা নক্ষত্র। জেমস ওয়েবের ছবিতে প্রথমবারের মতো এর দ্বিতীয় মৃত নক্ষত্রটিকে দেখা যাচ্ছে। সাউদার্ন নীহারিকার বাইরে যে উজ্জ্বল বিন্দুগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর প্রতিটি একেকটি গ্যালাক্সি।

ছবি ১.৫: স্টিফেনস কুইন্টেট

পঞ্চম ছবিটির (১.৫) নাম স্টিফেনস কুইন্টেট—পাঁচটি গ্যালাক্সির একটি দল। এখানকার চারটি গ্যালাক্সি পৃথিবী থেকে প্রায় ২৯ কোটি আলোকবর্ষ দূরে পেগাসাস নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত। অন্য গ্যালাক্সিটির দূরত্ব প্রায় চার কোটি আলোকবর্ষ। জেমস ওয়েবের তোলা সবচেয়ে বড় ছবি এটি। প্রায় এক হাজারটি আলাদা ছবিকে একসঙ্গে জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ছবি।

এই ছবি থেকে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া, এদের গঠন, বিবর্তন ইত্যাদি জানা যাচ্ছে। পাশাপাশি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের গঠন ও বিবর্তন সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে এ ছবিতে। শিশু মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর গঠন ও বিবর্তন বুঝতে জেমস ওয়েব কী রকম ভূমিকা রাখবে, সে ইঙ্গিত দিচ্ছে এই ছবি।

অবলাল আলোয় তোলা সব কটি ছবির পেছনেই মূল ভূমিকা জেমস ওয়েবের নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা এবং মিড ইনফ্রারেড ইনস্ট্রুমেন্টের। নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে জেমস ওয়েব এখন খুঁজছে মহাবিশ্বের প্রথম আলো। প্রায় ১০ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে চলবে জেমস ওয়েবের এই খোঁজ। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই ১০ বছরে শিশু মহাবিশ্বের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞানের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে জেমস ওয়েব নভোদুরবিন।

চার

এবার কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা নিয়ে কথা বলা যাক। প্রথম কথা, কোনো গ্যালাক্সি বা নক্ষত্র কত দূরের, সেটা কীভাবে বোঝেন বিজ্ঞানীরা? সংশ্লিষ্ট আরেকটি প্রশ্ন হলো, গ্যালাক্সিগুলো থেকে আসা আলো অবলালই কেন? অন্য কোনো রঙের আলো কেন আসে না? উত্তরটি সম্ভবত অনেকেরই জানা। তবু সংক্ষেপে একবার দেখে নেওয়া যাক বিষয়টি।

এ জন্য ব্যবহার করা হয় ডপলার প্রভাব ও রেড শিফট বা লোহিত সরণ। এর সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ ট্রেনের গতি। ট্রেন যখন হুইসেল বাজাতে বাজাতে স্টেশনে আসে, তখন আমরা শুনতে পাই, হুইসেলের তীক্ষ্মতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এর কারণ, ট্রেন স্থির থেকে হুইসেল বাজালে শ্রোতা, অর্থাৎ আমাদের ও ট্রেনের মধ্যকার শব্দতরঙ্গের দৈর্ঘ্য অপরিবর্তিত থাকার কথা। কিন্তু ট্রেন যখন আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, তখন এই তরঙ্গের দৈর্ঘ্য কমে যায় ও কম্পাঙ্ক বেড়ে যায়। ফলে শব্দ তীক্ষ্ম শোনায়। আর ট্রেন যখন দূরে সরে যেতে থাকে হুইসেল বাজাতে বাজাতে, তখন আমাদের ও ট্রেনের মধ্যকার শব্দতরঙ্গের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়, কমে যায় কম্পাঙ্ক। তাই শব্দের তীক্ষ্মতা কমে যায়। সে জন্য হুইসেলের শব্দ কমতে থাকে।

আলোর জন্যও ডপলার প্রভাবের বিষয়টি একইভাবে কাজ করে। কারণ, আলোও একধরনের তরঙ্গ। তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। তোমরা হয়তো জানো, দৃশ্যমান সাদা আলো আসলে সাত রঙের আলো মিলে তৈরি হয়। বেগুনি, নীল, আকাশি, হলুদ, কমলা ও লাল। এর মধ্যে নীল আলোর কম্পাঙ্ক সবচেয়ে বেশি। আর লাল আলোর কম্পাঙ্ক সবচেয়ে কম। আমরা জানি, কোনো কিছু থেকে আলো এসে আমাদের চোখে পড়লে আমরা সেই জিনিস দেখতে পাই। ডপলার প্রভাব থেকে দেখা যায়, কোনো কিছু আমাদের দিকে যত এগিয়ে আসে, সেটা থেকে আসা আলোটি তত নীলচে হয়। এটাকে বলে আলোর নীল সরণ। আর কোনো কিছু আমাদের থেকে যত দূরে, সেটা থেকে আসা আলো তত লালচে হয়। এটাকে বলে আলোর লোহিত সরণ। এ থেকে বোঝা যায়, একটা জিনিস আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, নাকি দূরে সরে যাচ্ছে।

(ছবি ৪) এ ক্ষেত্রে আরও কাজে লাগে আলোর গতি। আলোর গতি মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতি। আর এ গতি হলো সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার। আলো এক বছরে যত দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে, তাকে বলে এক আলোকবর্ষ। এখন কোনো কিছু থেকে আমাদের কাছে আলো এসে পৌঁছাতে যদি ১০ আলোকবর্ষ সময় লাগে, তাহলে সহজ করে বলা যায়, জিনিসটি আমাদের থেকে ১০ বছর (মানে, ১০ আলোকবর্ষ) দূরে আছে। সূর্যের আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে সাড়ে আট মিনিট লাগে। তার মানে, সূর্য আমাদের থেকে সাড়ে আট আলোক মিনিট দূরে আছে।

দের কাছে আসতে ১০ বছর লাগছে, সে আলো নিশ্চয়ই ১০ বছর আগে ছুটতে শুরু করেছে, তা–ই না? তার মানে, যে বস্তু থেকে আলোটা বেরিয়েছে, আমরা বর্তমানে বসে সেটার ১০ বছর আগের ছবি দেখছি। বস্তুটার বর্তমান অবস্থা কিন্তু আমরা এখন দেখতে পাব না, আরও দশ বছর পরই কেবল জানতে পারব সে কথা। অর্থাৎ, বস্তুটি আছে আমাদের থেকে ১০ বছর অতীতে। এভাবেই আলোকবর্ষের হিসাব থেকে বের করে নেওয়া যায়, আমরা কত বছর আগের মহাবিশ্ব বা গ্যালাক্সির ছবি দেখছি।

আরও অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে তোমাদের এ রকম। প্রশ্নগুলো চাইলে তোমরা লিখে পাঠাতে পারো কিশোর আলো বা বিজ্ঞানচিন্তার ঠিকানায়। বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট সংখ্যাটিও চাইলে পড়ে দেখতে পারো। ওখানে এ রকম অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে আগ্রহীরা।

এবার সেই শুরুর প্রশ্নটিতে ফিরে যাই। এই যে এসব জ্ঞান, এসব ছবির পেছনে আমরা এত টাকা খরচ করছি, এতে আমাদের লাভ কী?

এখানে প্রথম কথাটা বুদ্ধিবৃত্তিক। মানুষ সেই সভ্যতা শুরুর আগে থেকেই জানতে চেয়েছে, আমরা কোত্থেকে এলাম, কোথায় যাচ্ছি, মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান কোথায়। এই প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা মানুষকে তাড়িত করেছে, আজও করছে। বুদ্ধিবৃত্তিক এই তাড়না আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। তুমি যদি না-ই জানো তুমি কে, তাহলে বেঁচে থাকার কি কোনো অর্থ হয়? সে জন্যই গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, ‘নো দাইসেলফ’—‘নিজেকে জানো’।

দ্বিতীয় কথাটা হলো, এই জ্ঞান প্রজাতি হিসেবে বিনয় ও মাতৃগ্রহটির প্রতি আমাদের যত্নশীল হতে শেখায়। এত এত গ্রহ খুঁজে আজ পর্যন্ত ভিনগ্রহের কোনো প্রাণ পাইনি আমরা। মানুষের বসবাসযোগ্য গ্রহও নেই আশপাশে, যেখানে চাইলেই আমরা যেতে পারব। তাই আমাদের পৃথিবীর যত্ন নিতে হবে। একটাই তো পৃথিবী আমাদের।

আর বিনয়ের বিষয়টি যদি ভাবো, কিছুদিন আগেও আমরা ভাবতাম, মহাবিশ্বের সবকিছু আমাদের কেন্দ্র করে ঘোরে। সে ভুল ধারণা ভেঙে যাওয়ার পরও, আজ থেকে ১০০ বছর আগেও মানুষ ভাবত, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে কিছু নেই। আজ আমরা জানি, মহাবিশ্বের কোটি কোটি গ্যালাক্সির একটি এই মিল্কিওয়ে। এটা আমাদের নিজেদের ক্ষুদ্রতা বুঝতে শেখায়, ভালো মানুষ হতে শেখায়।

তৃতীয় কথাটা প্রায়োগিক। অ্যাপোলো অভিযানের জন্য মানুষ যে প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে, তার হাত ধরেই আমরা পেয়েছি, স্যাটেলাইট থেকে শুরু করে তোমার বাসায় ডিমভাজির জন্য ব্যবহৃত ননস্টিক ফ্রাইং প্যানসহ নানা কিছু। জেমস ওয়েবের জন্য আবিষ্কৃত বিভিন্ন প্রযুক্তি কী কী কাজে লাগবে, এর সব আমরা এখনো জানি না। তবে নাসা কয়েকটি প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা সরাসরি জানিয়েছে। এখানে তার দুয়েকটি নিয়ে সংক্ষেপে বলি।

জেমস ওয়েবের মূল আয়নাটি বানানোর সময় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিমাপের জন্য পরিমাপ পদ্ধতিতে অনেক উন্নতি করতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের। বানানো হয়েছে স্ক্যানিং শেক-হার্টম্যান সেন্সর, যা বিভিন্ন সার্জারি, চোখের চিকিৎসাসহ নতুন রোগ শনাক্তকরণে কাজে লাগবে। চোখের ব্যাপারে যেসব তথ্য জানতে ঘণ্টা পেরিয়ে যেত সার্জারি বা বড় কোনো অসুখ হলে, সেগুলো এখন এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানা সম্ভব কয়েক সেকেন্ডে।

জেমস ওয়েবের আয়না ও যন্ত্রপাতিগুলো প্রচণ্ড শীতল অবস্থায় রাখতে হয় নিখুঁত ছবি তোলার জন্য। নাহলে যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যকার অণু সামান্য তাপেও কাঁপতে থাকবে। এই কম্পন বা ভাইব্রেশন সমস্যা করবে ছবিতে। সে জন্য যে প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা, সে প্রযুক্তি সেমিকন্ডাক্টর, বিমান বা রকেট পরিচলনা থেকে শুরু করে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও গবেষণায় কাজে লাগবে। ইতিমধ্যেই এর প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলারের শিল্প গড়ে উঠেছে এই প্রযুক্তিকে ঘিরে।

এ ছাড়া ছবি তোলার প্রযুক্তি থেকে শুরু করে নানা ধরনের প্রযুক্তিতে বড় পরিবর্তন আসবে জেমস ওয়েবের জন্য আবিষ্কৃত প্রযুক্তিগুলোর হাত ধরে। ভবিষ্যতে যদি কোয়ান্টাম কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয় বা উন্নতমানের বৈদ্যুতিক যানবাহন—সেগুলো ঠান্ডা ও স্থিতিশীল রাখার কাজেও লাগবে জেমস ওয়েবকে শীতল রাখার প্রযুক্তি। মহাকাশ গবেষণা ও এক্সপ্লোরেশনের জন্য বানানো বিভিন্ন নভোদুরবিন ও নভোযানের যাত্রা বাস্তবায়নের জন্য যুগে যুগে যেসব অসাধারণ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে, সেগুলো এভাবেই আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ ও উন্নত করেছে। যেদিন নতুন কিছু জানার ও আবিষ্কারের পেছনে মানুষ শ্রম দেওয়া বন্ধ করে দেবে, সেদিন থেকে বন্ধ হয়ে যাবে সভ্যতার উন্নতি ও অগ্রগতি।

এভাবেই বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতা এগোয়। আমরা যত বেশি উন্নতি করতে পারব বিজ্ঞানে, তত বেশি ভালো মানুষ ও বিনয়ী হয়ে উঠব। নিজেদের অস্তিত্ব ও মূল পরিচয়ের আরও গভীরে যেতে পারব। পাশাপাশি এর হাত ধরে এগোবে প্রযুক্তি। উন্নত হবে সভ্যতা।