প্রশ্ন হলো। ফল খেয়ে পানি খেলে কী হবে?
আমাদের দেশে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে। ফল খেয়ে জল খেতে হয় না। ‘ফল খেয়ে জল খায়, যম বলে আয় আয়।’ ফল খেয়ে পানি খেলে একেবারের যমালয়ে যেতে হবে, বা মারা যেতে হবে, এটা সত্য নয়। তবে ফল খাওয়ার পর পানি খেলে শরীরের কোনো ক্ষতি নেই।
হেলথশটস নামের একটা ওয়েবসাইটে চিকিৎসককে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ফল খেয়ে জল খেলে পাঁচটি অসুবিধা হতে পারে—
১. পেটে ব্যথা। পেটে গ্যাস হতে পারে।
২. অনেক ফলে যথেষ্ট পানি আছে। যেমন: তরমুজ। তরমুজ খাওয়ার পর পানি খেলে শরীরের পিএইচ লেভেল উল্টাপাল্টা হতে পারে।
৩. অনেকে ফল খেলেই অস্বস্তি বোধ করেন। অ্যাসিডের সমস্যা হচ্ছে বলে অনুভব করেন। ফলের সঙ্গে জল খেলে পাকস্থলীর অ্যাসিড বেড়ে যাওয়ার অনুভূতি হতে পারে।
৪. ফল খাওয়ার পরেই পানি খেলে পাকস্থলী পূর্ণ হবে। তখন অম্ল বা অম্বলের সমস্যা হতে পারে। গলা পর্যন্ত টক পানি উঠে যেতে পারে।
৫. ফল খেয়ে পানি খেলে রক্তে চিনি বা শর্করা বেড়ে যেতে পারে।
খাওয়ার সময় পানি খেলে কী হয়
দুপুরে খেতে বসেছি। জগ থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি খাব। ভাইয়া বাধা দিল। বলল, খাবারের আগে পানি খেতে হয় না। খেলে পেট ভরে যাবে, হজমে সমস্যা হবে। ভাইয়া আম্মুর কাছ থেকে এই সতর্কতা শুনে বড় হয়েছে। আমিও শুনেছি। কিন্তু এই তথ্য সঠিক নয়। মাকে বলেছি। মা মানতে চায়নি। ভাইয়াকেও বললাম। তোমাদেরও বলি।
লোকে দাবি করে, খাওয়ার আগে পানি খেলে পাচক রসের ঘনত্ব কমে যায়। পাকস্থলীতে খাবার পানির সঙ্গে মিশে পাতলা হয়। খাবার ভাঙতে অসুবিধা হয়। পুষ্টির শোষণ ব্যাহত করে। হজমপ্রক্রিয়া ধীরে হয়। পেট খালি হওয়া ধীরে হয়ে গেলে পেট ফুলেও যায়। এ দাবি ‘পুরোপুরি ভুল’ বলেছেন পুষ্টিবিদ ও লেখক তামারা ডুকার ফ্রেউম্যান। ‘দ্য ব্লাটেড বেলি হুইস্পারার’ বইয়ের এই লেখক জোর দিয়ে বলেছেন, প্রচলিত হলেও এই দাবি সঠিক নয়। খাবারের সঙ্গে বেশি বেশি পানি খেলে আর যা-ই হোক, পাচক রসের ঘনত্ব কমে না।
খাবার হজমে শরীর কীভাবে কাজ করে বুঝতে পারলে এই ভুল ধারণা ভাঙতে পারে। স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক ভুল ধারণা বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়। খাবারের সঙ্গে পানি খেলে যেমন মনে হয়, সত্যিই হয়তো পাকস্থলী ধুয়ে যাবে। হজমপ্রক্রিয়া লক্ষ করলে এ ধারণা ভুল মনে হবে। খাবার মুখে দিলে মুখের মধ্যেই হজমপ্রক্রিয়া শুরু হয়। মুখে খাবার চিবিয়ে নরম করা হয়, অনেকটা খাবারের পেস্টের মতো। মুখের লালার এনজাইম এভাবে খাবারের সঙ্গে মেশে। এরপর খাবার গিলে ফেললে খাবার খাদ্যনালি দিয়ে পাকস্থলীতে যায়। পাকস্থলীতে থাকে অম্লীয় গ্যাস্ট্রিক জুস, যেগুলো খাবারকে ভেঙে ফেলে। ফলে খাবারের মিশ্রণ ক্ষুদ্রান্তে যায়। এখানেই পিত্ত অ্যাসিড এবং এনজাইমের সঙ্গে খাবারের পেস্ট মিশ্রিত হয়। এই পর্যায়ে খাবারের প্রায় ৭৫ শতাংশ পুষ্টি শরীরে শোষিত হয়। বাকি অংশ শোষিত হয় তা বৃহদন্ত্রে প্রক্রিয়াজাত হয়। এরপর শরীর থেকে নির্গত হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মতো লাগে।
পানি পাকস্থলীর পাচক রস পাতলা করে দেবে, এমন ধারণা বিভিন্ন কারণে ভুল। প্রথমত, শরীর পানি শোষণ করে মোটামুটি দ্রুততম সময়ে। পানি খাওয়ার প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে। এর মানে যেকোনো খাবারকে সম্ভাব্য তরলীকরণ করলেও সেটা হবে স্বল্প সময়ের ঘটনা। কারও যদি পেটভরা পানি থাকে, তবে এটি খাবারের হজমে প্রভাব ফেলবে না। আমেরিকান গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য ডেবোরাহ ডি প্রক্টর ওয়াশিংটন পোস্টকে এমনই বলেছেন। তিনি বলেন, পানি এনজাইমের কাজকে বাধা দেয় না। কারণ, এনজাইম পানির উপস্থিতিতে কাজ করে।
পানি পেটের ভেতরের অম্লতাকে প্রভাবিত করবে না। আমরা যা কিছু খাই না কেন—খাবার বা পানীয়—মুহূর্তের মধ্যে পাকস্থলীকে কিছুটা কম অম্লীয় করে তুলবে। যে খাবার খাব, সেটাকে হজম করার জন্য যতটুকু অ্যাসিড দরকার, তা তৈরি হবে। পাকস্থলীর কার্যকারিতাই এমন। এমন না যে খাবার খেলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অ্যাসিড দিয়ে খাবার হজম শুরু হবে। যদি ওই খাবারটুকু হজমের জন্য আরও অ্যাসিডের প্রয়োজন হয়, তবে শরীর সেটুকু তৈরি করবে।
কেউ কেউ মনে করে খাবারের সঙ্গে পানি খেলে হজমের গতি কমে। পাকস্থলী থেকে খাবার বের হয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে যাওয়ার গতিকে পানি কমিয়ে দেয়। হজমপ্রক্রিয়া এ তথ্যকে সঠিক বলে না। খাবারের সঙ্গে পানি খেলে খাবার হজম হওয়ার হার প্রভাবিত হয় না। খাওয়ার সময় পানি হজমে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে চিবানো এবং গিলে ফেলার সময়। এ সময় পানি খাবারকে নরম করে। খাদ্যনালি থেকে পাকস্থলীতে যেতে সাহায্য করে। পানি খেলে শরীর হাইড্রেটেড হয়। হজমের পর অন্ত্রের মধ্য দিয়ে খাবারের অংশ চলাচল করতে সাহায্য করে। বর্জ্য শরীর থেকে সহজে বের হতেও সাহায্য করে।
খাওয়ার আগে পানি খেলে আসলে যে ঘটনাটি ঘটে, পেট ভরার অনুভূতি পাওয়া যায় না। ২০ মিনিটের মতো সময় ধরে পানি পাকস্থলীতে থাকে বলে পূর্ণতার অনুভূতি কমিয়ে দিতে পারে। বিষয়টি ভালো না মন্দ, বিষয়টি আমরা কীভাবে দেখছি, তার ওপর নির্ভর করে। কেউ যদি ওজন কমানোর চেষ্টা করে, তবে খাবারের আগে পানি খেলে কম খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তবে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়ার আগে পানি খেয়ে পেট ভরে ফেললে ওজন কমানোর ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি কাজ না-ও করতে পারে। আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো, কিছু মানুষ পেট ফুলে যাওয়ার অস্বস্তি অনুভব করে।
খাওয়ার সময় পানি খেতে চাইলে, সঠিক নিয়ম হলো ধীরে ধীরে চুমুক দেওয়া। হাইড্রেটেড হওয়া বা তৃষ্ণা মেটানো, যেকোনো প্রয়োজনেই ধীরে ধীরে পানি পান করতে হবে। খাওয়ার সময় ঢক ঢক করে বা একটানা বেশি পানি খেলে পেটে গ্যাস জমা হওয়ার অনুভূতি হতে পারে।