রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল পড়তে শুরু করো

অলংকরণ: আরাফাত করিম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পড়েননি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে সবাই তো আর লেখাপড়া জানেন না। তাঁরা কী করে পড়বেন? না পড়লেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কোনো না কোনোভাবে প্রত্যেক বাঙালিই উপভোগ করেছেন। সহজ উদাহরণ হলো গান। বাংলাদেশের মানুষ ‘আমার সোনার বাংলা’ এই গানটা শোনেননি, এটা হতেই পারে না। তেমনি, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’ গানটা শুনে চাঁদরাতে খুশি হয়ে ওঠেনি, এমন মানুষও এ দেশে খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল ১৮৬১ সালের ৭ মে। বাংলা তারিখ ২৫ বৈশাখ। তিনি মারা যান ১৯৪১ সালে। ৮০ বছর বেঁচেছিলেন। তার মানে তিনি মারাই যান ৮৩ বছর আগে। ৯০ বছরের বেশি বছর এখন যাঁদের বয়স, তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের জীবদ্দশায় পেয়েছিলেন। হয়তো রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিনের কথা কারও কারও স্মৃতিতে আছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতায়। তাঁর জীবনের অনেকটা সময় তিনি পূর্ব বাংলায়, মানে এখনকার বাংলাদেশে কাটিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু স্কুলের পড়ায় একদমই মন বসাতে পারতেন না। একটার পর একটা স্কুল বদল করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। স্কুলের পড়া শেষ করতে পারেননি।

তাঁকে ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল, তিনি না পড়েই চলে এসেছিলেন।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

কিন্তু তাঁর মতো জ্ঞানী ও গুণী মানুষ, তাঁর মতো সৃষ্টিশীল শিল্পী মানুষ, তাঁর মতো বড় কবি ও লেখক এই পৃথিবীতেই কম এসেছে।

তিনি কবিতা লিখেছেন। কবিতা লিখে ‌১৯১৩ সালে তিনি পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার।

তিনি ছোটগল্প লিখেছেন। তোমরা শুনলে অবাক হবে, বাংলা ভাষায় আগে গদ্য লেখা হতো না। কথা সবাই গদ্যেই বলত, কিন্তু লেখার সময় শুধু কবিতা লেখা হতো। ১৮০০ সালের পর মোটামুটিভাবে গদ্য লেখা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন লিখতে শুরু করেন, তখন বাংলা ভাষায় খুব অল্পসংখ্যক ছোটগল্পই লেখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই বাংলা ছোটগল্প প্রতিষ্ঠা পায়, জনপ্রিয় হয়। এখনো বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার হিসেবে আসবে রবীন্দ্রনাথেরই নাম। তোমরা তাঁর গল্পগুচ্ছ নামের বইটি সংগ্রহে রাখবে। গল্পগুলো পড়বে।

আরও পড়ুন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর লেখা গোরা, ঘরে-বাইরে, শেষের কবিতা বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকায় স্থান পাবে।

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, তাঁর লেখা গান বাঙালিকে শুনতেই হবে। কথা সত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখেছেন, গানে সুর দিয়েছেন। আমরা যে কিশোর আলোর অনুষ্ঠান করি, সেখানে যখন অর্ণব ‌‌‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ গানটা গাইতে শুরু করেন, তখন তোমাদের বয়সী শিশু–কিশোরেরা তাঁর সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করে দেয়। আমি জানি না, তোমরা রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করো কি না, কারণ তোমাদের বয়সে আমিও পছন্দ করতাম না, কিন্তু এখন আমার রবীন্দ্রসংগীত না শুনলে একটা দিনও চলে না। নানান গান শুনে মনে হয়, যেন পূর্ণ হলো না, এবার রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হোক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরেক বিস্ময়কর এলাকা হলো নাটক। তাঁর লেখা নাটক রক্তকরবী, তাসের দেশ, বিসর্জন, ‌‌মুক্তধারা—এগুলো এখনো আধুনিক এবং বিশ্বমানের। আমার নিজের ধারণা, নাটকের জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ থেকে ১০০ বছর পর, ২০০ বছর পরও আধুনিক বলেই বিবেচিত হবেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। সমাজ, বিশ্ব, রাষ্ট্র, জাতি নিয়ে তাঁর চিন্তার মধ্যে এখন পর্যন্ত ভুল কিছু পাওয়া যায়নি বললেই চলে।

একজীবনে তিনি যত চিঠি লিখেছেন, আমরা তা দেখে দেখে কপি করতেও পারব না, এই রকম সেসবের পরিমাণ।

তিনি ছবি এঁকেছেন। ছবি আঁকায় তিনি আধুনিকতার প্রবর্তক।

তিনি আবার কাজও করেছেন অনেক রকমের। যেমন তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে গাছের নিচে ক্লাস হবে, এ রকম একটা ধারণা ছিল তাঁর।

প্রথম ক্ষুদ্রঋণ প্রবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আধুনিক উপায়ে চাষবাস করানোর উদ্যোগ নেন। উন্নত জাতের গরু নিয়ে আসেন। বীজ নিয়ে আসেন। আলুর চাষ করেন। মানে এত বিচিত্র কাজ করেছেন তিনি, আবার এত বিপুল পরিমাণে লিখে গেছেন, তাঁর সমগ্র জীবনটাই বিস্ময়কর।

তাঁর লেখা কিন্তু পড়তে খুব ভালো লাগে। তিনি ছিলেন মহারসিক। লেখার ছত্রে ছত্রে এই রসিকতার ঝিলিক দেখতে পাওয়া যায়।

কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিলনের জন্য চেষ্টা করতেন, অনেক লেখা লিখেছেন এ নিয়ে। তিনি সাম্যবাদী ছিলেন, ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য উচ্চকণ্ঠে লিখে গেছেন।

আমার যখন মন খারাপ থাকে, তখন আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে প্রেরণা পাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথের গান–কবিতা আমাদের আশা দেখাত।

কাজী নজরুল ইসলাম একজন বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালে। গ্রামে জন্ম। যখন তাঁর বয়স মাত্র ৯ বছর, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। ছোটবেলা কেটেছে দুঃখে-কষ্টে, এ জন্য তাঁর নাম ছিল দুখু মিয়া। তিনি ছোটবেলায় রুটির দোকানে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামও স্কুলের পড়া শেষ করতে পারেননি। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করতে নওশেরা, করাচি (এখনকার পাকিস্তান) গিয়েছিলেন। হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম নামে লিখতে শুরু করেন। ১৯২২ সালে তাঁর বয়স মাত্র ২২–২৩। তখনই তিনি লিখে ফেলেন বাংলা ভাষার একটা শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বিদ্রোহী’।

মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়্‌গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না—

বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।

..........................

আমি চিরবিদ্রোহী বীর—

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় দেশ-বিদেশের পুরাণ থেকে তিনি এত কিছু নিয়েছেন, বিস্মিত হতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না করেও যে কত পড়াশোনা করা যায়, কত বড় বিদ্বান হওয়া যায়, তার একটা প্রমাণ কাজী নজরুল ইসলাম। তবে তাঁর লেখা পড়লে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। মনে হয়, তিনি বিশেষ রকমের প্রতিভাবান ছিলেন, জিনিয়াস ছিলেন। তা না হলে এত অল্প বয়সে এত ভালো কবিতা লেখা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না।

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি। তিনি যেখানে যেতেন, সেখানেই ভিড় হয়ে যেত। তখন ভারত শাসন করত ইংরেজরা। তিনি সেই ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন তাঁর লেখার মাধ্যমে। এ জন্য তাঁকে কারাগারেও যেতে হয়েছে।

আরও পড়ুন

কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিলনের জন্য চেষ্টা করতেন, অনেক লেখা লিখেছেন এ নিয়ে। তিনি সাম্যবাদী ছিলেন, ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য উচ্চকণ্ঠে লিখে গেছেন।

সাম্যের গান গাই—

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।

বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির—

কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,

অর্ধেক তার নর।

এই অমর পঙ্‌ক্তিগুলো কাজী নজরুল ইসলামেরই লেখা।

আবার তিনি ইসলামি গানও লিখেছেন। গজল লিখেছেন। শ্যামাসংগীত লিখেছেন।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

কাজী নজরুল ইসলামের গানও বাংলা ভাষার অমূল্য সম্পদ। কাজী নজরুল ইসলাম যখন গান রচনা করতেন, তখন তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাঁর লেখা নানা ধরনের গান আছে, প্রেমের গানগুলো সত্যি অনবদ্য। আবার তাঁর লেখা গান ‘কারার ঐ লৌহ কবাট’, ‘জাগো অনশনবন্দী ওঠোরে যত’—এ ধরনের গানগুলো আমাদের শিকল-ভাঙার প্রেরণা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় নজরুলের গান আমাদের বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিত।

কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। ১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন, ১৯৭৬ সালে তিনি মারা যান।

কাজী নজরুল ইসলামের ছোটদের ছড়া-কবিতাগুলো আমরা এখনো পড়ি। ‘ভোর হলো দোর খোলো’—এই কবিতা কে না পড়েছে? বা ‘আমি হব সকালবেলার পাখি’—এই কবিতার কোনো তুলনা নেই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বলো আর কাজী নজরুল ইসলামের লেখাই বলো, আমাদের উচিত মন দিয়ে পড়া। পড়ে বোঝার চেষ্টা করা। আমি তো মনে করি, আমরা যদি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রাহী’ কবিতাটা পড়ে উপলব্ধি করতে পারি, তাঁকে ধারণ করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের সমাজের অর্ধেক সমস্যা আর থাকবে না।

আরও পড়ুন

তোমাদের বলব, এসো আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পড়তে শুরু করি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ছড়া। ভোলানাথ লিখেছিল:

ভোলানাথ লিখেছিল,

তিন-চারে নব্বই—

গণিতের মার্কায়

কাটা গেল সর্বই।

তিন চারে বারো হয়,

মাস্টার তারে কয়;

‘লিখেছিনু ঢের বেশি’

এই তার গর্বই।

কাজী নজরুল ইসলামের একটা ছড়া। আমি যদি বাবা হতুম:

আমি যদি বাবা হতুম,

বাবা হত খোকা,

না হলে তার নামতা,

মারতাম মাথায় টোকা।।

রোজ যদি হত রবিবার!

কী মজাটাই হত যে আমার!

কেবল ছুটি! থাকত নাকো নামতা লেখা জোকা!

থাকত নাকো যুক্ত অক্ষর, অঙ্কে ধরত পোকা।।

কী, ভীষণ মজার না। আমরা আসলে পড়তে চাই না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পড়তে শুরু করলে পড়ার আনন্দে মন ভরে উঠবে। পড়ো।

আরও পড়ুন