এক আকাশ অন্ধকার মাথায়
নিয়ে বসে আছে একটা কালো বিড়াল
চারিদিকে গা ছমছমে নীরবতা
আর হাড় হিম করা অন্ধকার।
— রামপ্রসাদ কর
বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাব। ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়েছি। দাদিকে সালাম করে যে–ই না ঘর থেকে বের হব, অমনি একটা কালো বিড়াল সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল। এই কাণ্ড দেখে দাদির চোখ গেল বড় বড় হয়ে। কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘আরে সর্বনাশ। কালা বিলাই গেল সামনে দিয়া। না না আইজ কোনোভাবে বাড়ি থাইকা বাইর হওয়া যাবে না। কাইল যাইস।’
দাদিকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘আরে বিড়াল তো বিড়ালই। সাদা–কালায় কী যায়–আসে। তুমি চিন্তা করো না। কিচ্ছু হবে না।’
তিনি কোনোভাবেই আমার কথা মানবেন না। বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। বৃদ্ধ মানুষকে বিজ্ঞান বোঝানো সহজ কম্ম নয়! অগত্যা কী আর করা। রেগে মুখ ভার করে বাসায় বসে রইলাম। তার ধারণা, নিশ্চয়ই সামনে বড় বিপদ আছে। বিড়াল তা আগেই টের পায়। তাই সাবধান করার জন্য সামনে দিয়ে দৌড়ে যায়। তারপরও সাবধান না হলে বিপদ নিশ্চিত।
আমার মতো এ রকম বিপদে কি তোমরা কখনো পড়েছ? দাদি–নানিদের মুখে এ ধরনের কুসংস্কারের কথা বেশি শোনা যায়। এর আসলে কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু তারপরও মানুষ এগুলো বিশ্বাস করে। কারণ, মানুষ কুসংস্কার বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। কালো বিড়াল–সম্পর্কিত এই ধারণাও কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু কীভাবে এই কুসংস্কার ডালপালা মেলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল? এর আছে একটা প্রাচীন ইতিহাস। চলো সেই ইতিহাস সংক্ষেপে জেনে আসি।
কালো বিড়ালের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস শুরু কয়েক হাজার বছর আগে, মিসরে। তখন মিসরের রানি ছিলেন ডায়ানা। সে আমলে প্রত্যেক রাজা বা রানির জন্য নির্দিষ্ট প্রতীক থাকত। রানি ডায়ানার পৌত্তলিক প্রতীক ছিল কালো বিড়াল। তখন কিন্তু কালো বিড়াল সুখেই ছিল। রানির কল্যাণে কালো বিড়াল ছিল পবিত্রতার প্রতীক। তাই কেউ বিড়াল হত্যা করলে, তার মৃত্যুদণ্ড প্রায় নিশ্চিত। মিসরে বিড়াল এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে মমি করে রাখা হতো। মিসরের একটি পিরামিডের মধ্যে অনেকগুলো মমি করা বিড়াল পাওয়া গেছে।
কিন্তু বিড়ালের ভাগ্যে এ সুখ বেশি দিন সইল না। বিড়ালের প্রতি এত সম্মান ক্যাথলিক ধর্মগুরুদের সহ্য হলো না। ১২৩৩ সাল। তখন পোপের দায়িত্ব পালন করছেন গ্রেগরি নবম। বিড়ালের এত সম্মান দেখে তিনি চিন্তিত হলেন। বিড়ালের সম্মান কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। নানাবিধ চিন্তাভাবনা করে একটি বদ বুদ্ধি আঁটলেন। ঘোষণা করলেন, কালো বিড়াল পৃথিবীতে আসে শয়তানের দূত হয়ে। তাই কালো বিড়াল পরিত্যাগ করা উচিত।
ব্যস, পোপের আর কিছু করতে হয়নি। সাধারণ জনগণ কালো বিড়াল ধরে ধরে পুড়িয়ে মারতে শুরু করল। পোপ হয়তো এই কাণ্ড দেখে একটু মুচকি হেসেছিলেন। কারণ, তার একটি মনগড়া উদ্ভট কথার কারণে পুরো ইউরোপ থেকে কালো বিড়াল প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল। সেই থেকে কালো বিড়ালের দুর্ভাগ্যের শুরু। আজও তা শেষ হয়নি।
এখানেই শেষ নয়। কালো বিড়ালের কপালে আরও দুর্ভাগ্য লেখা ছিল। আফ্রিকায় একসময় চালু হয়ে গেল, অশরীরী শক্তি বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধরে পৃথিবীতে বাস করে। আর জিনদের পছন্দের প্রাণী হলো কালো বিড়াল। তাই কেউ কালো বিড়াল দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে বিড়ালকে মেরে ফেলত। অনেকেই মনে করত, কেউ খুন হলে তার আত্মা কালো বিড়াল হয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসে খুনের বদলা নেয়। কেউ কেউ বিশ্বাস করত, কালো বিড়াল সাত বছর পরে ডাইনিতে রূপ নেয়। এ রকম নানা কুসংস্কারের কারণে মানুষ আজও কালো বিড়াল ভয় পায়। কালো বিড়ালকে মনে করে দুর্ভাগ্যের প্রতীক।
২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা জানান, বেশির ভাগ মানুষ কালো বিড়াল পুষতে চায় না। ৭০ শতাংশ কালো বিড়ালকে কেউ দত্তক নেয় না।
এই তথ্য থেকেই বোঝা যায়, প্রাচীনকালের সেই উদ্ভট কথা এখনো মানুষ বিশ্বাস করে। কিন্তু আসলেই কি কালো বিড়াল আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনতে পারে?
আসলে বিড়ালের সাদা–কালোতে কিছু যায়–আসে না। এটা শুধু একটা রং মাত্র। সব রঙের বিড়ালের গুরুত্ব একই। তবে কালো বিড়াল শিকার ধরার ক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি সুবিধা পায়। অন্ধকারে কালো বিড়ালকে মোটেও দেখা যায় না। ফলে শিকার (ইঁদুর) বিড়ালের উপস্থিতি টের পাওয়ার আগেই বিড়াল তা ধরে ফেলে। সুতরাং বুঝতেই পারছ, সাদা আর কালো শুধু বিড়ালের গায়ের রং। এর সঙ্গে ভাগ্যের কোনো সম্পর্ক নেই।
এখন তোমার সামনে দিয়ে একটি কালো বিড়াল দৌড়ে গেলে, তুমি কি তোমার যাত্রা বন্ধ করে দেবে? নাকি যেখানে যাওয়ার ছিল সেখানেই যাবে? তোমার উচিত যাত্রা বন্ধ না করা। আমার দাদির মতো তোমাকে কেউ কালো বিড়ালের কুসংস্কার শোনাতে পারে। কিন্তু তাতে কান দিয়ো না। কারণ, কালো বিড়াল আমাদের কি দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে, কালো হওয়ার কারণে ওর নিজেরই তো দুর্ভাগ্যের শেষ নেই।