ভারত মহাসাগরে কিছুদিন আগে একটি বাংলাদেশি জাহাজ হাইজ্যাক করেছে সোমালি জলদস্যুরা। বর্তমানে ২৩ জন নাবিক এই জাহাজে জিম্মি অবস্থায় আছেন। সোমালিয়ার উপকূল থেকে কিছুটা দূরে নোঙর করে রাখা হয়েছে জাহাজটিকে। মুক্তিপণ নিয়ে জলদস্যুদের সঙ্গে আলোচনা চলছে জাহাজের মালিকদের। সোমালি জলদস্যুদের এভাবে বাণিজ্যিক জাহাজ হাইজ্যাক করার ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। প্রতিবছরই এমন কোনো না কোনো ঘটনা ঘটছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনা কমে এসেছে, কিন্তু আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে জলদস্যুদের বাণিজ্যিক জাহাজ আক্রমণ করা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
সোমালি জলদস্যুরা কেন ও কীভাবে বাণিজ্যিক জাহাজ হাইজ্যাক করে, সেটা ভালোভাবে বুঝতে হলে আগে জানতে হবে সোমালিয়া সম্পর্কে।
হর্ন অব আফ্রিকা
আফ্রিকা মহাদেশের একটা দেশ সোমালিয়া। ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ নামে আফ্রিকা মহাদেশের একেবারে পূর্ব পাশে যে অংশ আছে, সেখানে এর অবস্থান। এই হর্ন অব আফ্রিকা আর ইয়েমেনের মাঝখানে যে গালফ অব এডেন (এডেন উপসাগর) রয়েছে, সেখান দিয়ে মিসরের সুয়েজ খাল হয়ে অসংখ্য জাহাজ চলাচল করে। ইউরোপ থেকে যেসব বাণিজ্যিক জাহাজ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চলাচল করে, সুয়েজ খাল হয়েই যেতে হয় সেগুলোকে। এর কারণ হলো, সুয়েজ খাল ভূমধ্যসাগর আর লোহিত সাগরের মধ্যে একটা শর্টকাট হিসেবে কাজ করে। সুয়েজ খাল ব্যবহার না করলে, এই জাহাজগুলোকে পুরো আফ্রিকা মহাদেশের একেবারে নিচে দিয়ে, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে ইউরোপে পৌঁছাতে হবে। তাতে অতিরিক্ত প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে, আর সমুদ্রে অতিরিক্ত সময় কাটাতে হবে ১০ দিনের মতো। সময় তো বেশি লাগেই, পাশাপাশি জ্বালানি খরচ, জাহাজের নাবিকদের বেতন—এসব মিলিয়ে পরিবহন খরচ পড়ে অনেক বেশি। এসব কারণে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো পুরো আফ্রিকা মহাদেশ না ঘুরে, হর্ন অব আফ্রিকা হয়ে সুয়েজ খাল দিয়েই এশিয়া আর ইউরোপের মাঝে যাতায়াত করে। আর এই রুটেই পড়ে সোমালিয়ার বিস্তীর্ণ উপকূল। এই উপকূল ধরে চলাচল করার সময়ই জাহাজগুলো জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হয়।
কেন এই আক্রমণ
মাথাপিছু আয়ের হিসাবে সোমালিয়া পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম। নব্বইয়ের দশকের গৃহযুদ্ধে সোমালিয়ার সরকার ভেঙে যাওয়ার পর দেশটিতে কার্যকর কোনো শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। একটা দেশে যেমন একটা কেন্দ্রীয় সরকার থাকে, যার অধীনে পুরো দেশ পরিচালিত হয়, সোমালিয়ায় তেমন কোনো কার্যকর সরকার বর্তমানে নেই। নামেমাত্র সরকার একটা আছে বটে, কিন্তু দেশের অনেক অংশের ওপরই তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকারের পরিবর্তে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। দেশে তরুণদের জন্য চাকরিও তেমন নেই। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ।
সোমালিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে যারা বসবাস করে আসছে, তাদের অনেকেই সমুদ্রে মাছ শিকার করে জীবিকা চালাত। কিন্তু সোমালিয়ার উপকূলে এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মৎস্যশিকারিরা এসে দীর্ঘদিন মাছ শিকার করায় সমুদ্রের ওই অংশে মাছের সংখ্যা কমে যায়। এ ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতার শিকার হন সোমালি জেলেরাও। তার ওপর সোমালিয়ার কোনো কার্যকর নৌবাহিনী নেই। ফলে তাদের জলসীমায় অন্য দেশের মাছ শিকার করার মতো ঘটনাগুলোকে বাধা দেওয়াও সম্ভব হয়নি। সব মিলিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা সোমালিদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। দেশে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকায় অর্থনীতিও সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি।
চাকরি খুঁজে না পেয়ে অনেক তরুণই তখন এই জলদস্যুতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর মোট বাণিজ্যিক জাহাজের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ চলাচল করে সোমালিয়ার উপকূল দিয়ে। কী থাকে না এসব জাহাজে! মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আনা তেল বা পেট্রোলিয়াম থেকে শুরু করে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক—প্রায় সব ধরনের পণ্যই এসব জাহাজে করে ইউরোপ এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছায় হর্ন অব আফ্রিকা হয়ে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের পণ্য পরিবহন করা এসব জাহাজ হাইজ্যাক করতে পারলে জাহাজের নাবিকদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করা যাবে—এই আশা থেকেই মূলত জাহাজগুলোকে আক্রমণ করে সোমালি জলদস্যুরা।
নব্বইয়ের দশক থেকে সোমালি জলদস্যুদের এই আক্রমণ শুরু হলেও, মূলত ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে এই আক্রমণ ছিল সর্বোচ্চ। সে সময় প্রতিবছর দেড় শ থেকে দুই শ বাণিজ্যিক জাহাজ আক্রমণ করছিল তারা। শুরুর দিকে মুক্তিপণের পরিমাণ কম থাকলেও ধীরে ধীরে সেটা বাড়তে শুরু করে। ১, ২, ৩ মিলিয়ন থেকে ২০-২৫ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত মুক্তিপণ চাইতে থাকে তারা। ২০১০ সালের এপ্রিলে সামহো ড্রিম নামে একটা তেলবাহী সুপারট্যাংকার হাইজ্যাক করে সোমালি জলদস্যুরা। ১৭০ মিলিয়ন ডলারের তেল নিয়ে জাহাজটি ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিল। জাহাজটির ২৪ জন নাবিককে জিম্মি করে ২০ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ চাওয়া হয়। সাত মাস ধরে আটকে রাখার পর নভেম্বর মাসে সাড়ে ৯ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেয় জলদস্যুরা। এখন পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে বেশি মুক্তিপণ আদায়ের রেকর্ড।
জলদস্যুতার বাণিজ্য
সোমালিয়ার উপকূলজুড়ে যেসব গ্রাম রয়েছে, সেসব গ্রামের অনেক মানুষই সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। যখন দেখা গেল, বিলিয়ন ডলারের পণ্যবাহী জাহাজ আটকে রেখে, নাবিকদের জিম্মি করে মিলিয়ন ডলার আয় করা যাচ্ছে, তখন একাংশ মাছ ধরার কাজ বাদ দিয়ে পাইরেসি-বাণিজ্যে নেমে পড়ল। জলদস্যুতার এই ‘ব্যবসা’ একটা পর্যায়ে বেশ রমরমা ছিল। বিষয়টা ভেঙে বলা যাক।
সাধারণত বাণিজ্যিক জাহাজগুলো চলাচল করে উপকূল থেকে অন্তত কয়েক শ কিলোমিটার দূর দিয়ে। প্রথম দিকে ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা ব্যবহার করে এই জাহাজগুলোর কাছাকাছি আসত জলদস্যুরা, এরপর নৌকা থেকে মই দিয়ে জাহাজে ওঠার চেষ্টা করত। আস্তে আস্তে জাহাজ হাইজ্যাক করার এই পুরো প্রক্রিয়া অনেক বড় একটা অপারেশনে রূপ নেয়। কোন রুট ধরে একটা জাহাজ চলাচল করছে, কিংবা একটা জাহাজে কী ধরনের মালামাল বা কার্গো আছে, প্রথমে এসব নিয়ে জানার দরকার হয়। এ জন্য সোমালি জলদস্যুরা ‘ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স’, যেমন শিপিং কোম্পানিগুলোর ব্লগ থেকে শুরু করে রাডার কিংবা জিপিএসের মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। একটা জাহাজকে টার্গেট করার পর সেটাকে ট্র্যাক করা শুরু করে তারা। একটা বড়সড় ‘মাদারবোট’ পেছনে থাকে, আর সমুদ্রে জাহাজের কাছাকাছি এগিয়ে যায় একাধিক ইঞ্জিনচালিত নৌকা। নৌকায় যারা থাকে, তাদের হাতে বন্দুক ও রকেটচালিত গ্রেনেড (আরপিজি) থাকে। জাহাজের কাছাকাছি এসে চারপাশ থেকে সেটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে তারা। তারপর মোটা রশি দিয়ে বানানো মই ছুড়ে মারে ওপরে। সেটা ব্যবহার করে তারা জাহাজের ডেকে উঠে যায়। বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে আগে সাধারণত সশস্ত্র গার্ড থাকত না। সে জন্য জলদস্যুরা পেছন থেকে ধাওয়া করার সময় বা জাহাজের ডেকে একবার উঠে গেলে নাবিকদের আর তেমন কিছু করার থাকত না। আত্মসমর্পণ করতে হতো। জাহাজের নিয়ন্ত্রণ একবার জলদস্যুদের হাতে চলে আসার পর সেটাকে মাদারবোটের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। শুরু হয় মুক্তিপণ আদায়ের প্রস্তুতি।
বাণিজ্যিক জাহাজ হাইজ্যাক করার এই যে পুরো প্রক্রিয়া, এর সঙ্গে জড়িত থাকে অনেকেই। জলদস্যুতাকে কেন্দ্র করে উপকূলীয় গ্রামগুলোতে পুরো আলাদা একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যেহেতু জাহাজ হাইজ্যাক করতে অনেক লোকবল, অস্ত্র ও অর্থের প্রয়োজন হয়, সে জন্য এর পেছনে বিনিয়োগ করে গ্রামের অনেকে মিলে। যে কেউই চাইলে বিনিয়োগ করতে পারে। কেউ টাকা দিয়ে, কেউ অস্ত্র দিয়ে বিনিয়োগ করে, আবার কেউ একটা দলে ক্রু হিসেবে যোগ দেয়। কেউ কেউ জিম্মি করা নাবিকদের অনুবাদক হিসেবে কাজ করে, কেউ সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে, এমনকি চা বিক্রেতা হিসেবেও কাজ করে কেউ। ঠিক একটা ব্যবসায় বিনিয়োগের মতোই পুরো ব্যাপারটা কাজ করে। মুক্তিপণ পাওয়ার পর সবাই প্রত্যেকের লভ্যাংশ পেয়ে যায় হিসাবমতো। গ্রামের যারা অসহায় বা বৃদ্ধ, তাদের কেউ কেউ সেখান থেকে সাহায্যও পায়। জাহাজ আটক করে মুক্তিপণ আদায়ের এই পুরো ব্যাপারটাই একটা ‘কমিউনিটি অ্যাকটিভিটি’ হিসেবে কাজ করে অনেক জায়গায়। যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের কেউ কেউ অবশ্য নিজেদের ‘জলদস্যু’ হিসেবে মানতে নারাজ। নিজেদের বরং সোমালিয়ার ‘কোস্টগার্ড’ হিসেবে পরিচয় দিতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাদের দাবি, সোমালিয়ার উপকূলে জাহাজ চালানোর ‘ট্যাক্স’ হিসেবে এই মুক্তিপণ আদায় করছে তারা, যদিও তা সমুদ্রবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
নিজেদের যে নামেই ডাকুক না কেন, সোমালি জলদস্যুদের জাহাজ হাইজ্যাকিংয়ের ঘটনা যে বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনেক বড় একটা ব্যাঘাত ছিল, সেটা এখন সবাই জানে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০০৫ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোমালিয়ার উপকূলে যেসব জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়েছিল, সেসব জাহাজ ছাড়িয়ে নিতে সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের মতো মুক্তিপণ দিতে হয়েছে। ভাবা যায়!
ক্যাপ্টেন ফিলিপস
জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার করা নিয়ে যে ঘটনাটি সবচেয়ে বিখ্যাত, সেটি ২০০৯ সালের। ২৩ জন নাবিক নিয়ে ওমান থেকে কেনিয়ায় যাচ্ছিল কার্গো জাহাজ মার্স্ক আলাবামা। ৮ এপ্রিল জাহাজটি আটক করে সোমালি জলদস্যুরা। একপর্যায়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন রিচার্ড ফিলিপসকে একটা লাইফবোটে জিম্মি করে তারা। লাইফবোটটিকে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তখন তিনটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ সেখানে পাঠানো হয় এবং ক্যাপ্টেন ফিলিপসকে উদ্ধার করতে গিয়ে নেভি সিলের সদস্যরা তিন জলদস্যুকে হত্যা করেন। এরপর লাইফবোটটি থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়।
ঘটনাটি নিয়ে ২০১০ সালে ক্যাপ্টেন ফিলিপস একটি বই লেখেন, আ ক্যাপ্টেনস ডিউটি নামে। বইটির ওপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে ক্যাপ্টেন ফিলিপস মুভিটি তৈরি করা হয়। এতে ক্যাপ্টেন ফিলিপস চরিত্রে অভিনয় করেন টম হ্যাংকস। মূলত মুভিটি মুক্তি পাওয়ার পরই সোমালিয়ার উপকূলে বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর জলদস্যুদের আক্রমণের ব্যাপারটি বড় পরিসরে সাধারণ মানুষের নজরে আসে।
সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুতা ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, ভারত এবং আরও বেশ কিছু দেশের নৌবাহিনীর নেওয়া পদক্ষেপের ফলে ২০১৩ সাল থেকে আস্তে আস্তে জাহাজ হাইজ্যাকিংয়ের ঘটনা কমতে থাকে। পুরোপুরি অবশ্য সেটা থামেনি। সম্প্রতি বাংলাদেশের জাহাজ হাইজ্যাকের ঘটনাটিই তার প্রমাণ। আমাদের আশা এটাই যে বাংলাদেশের নাবিকেরা সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসবেন।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস