হাই তোলা দেখলে কি হাই ওঠে

এই লেখা পড়তে পড়তেও হয়তো হাই তুলতে পারো তুমিও

ক্লান্তি বা ঘুম ঘুম চোখে বিছানায় যেতে না পারলে হঠাৎ আমাদের মুখ হা হয়ে যায়। যাকে বলে হাই তোলা। ক্লান্তির পাশাপাশি অন্যকে হাই তুলতে দেখলে মাঝেমধ্যে আমাদেরও হাই ওঠে। শুধু আমাদের নয়, অনেক মেরুদণ্ডী প্রাণীও হাই তোলে—যেমন সাপ, কুকুর, বিড়াল, হাঙর এবং শিম্পাঞ্জি। একজনের হাই তোলা দেখে অন্য কারও হাই উঠলে বলা হয় হাই তোলা ব্যক্তি সংক্রমিত হয়েছে। গবেষণা বলছে, প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ অন্যকে হাই তুলতে দেখলে হাই তোলে। এমনকি হাই তোলা নিয়ে লেখা পড়লেও নিজের অজান্তে হাই তোলে। প্রাণীদের মধ্যেও সংক্রামক হাই তোলার প্রবণতা রয়েছে, তবে এটি মানুষের মতো কাজ করে না। কেন আমরা অন্যদের হাই তুলতে দেখে হাই তুলি, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। এখানে প্রধান কয়েকটি তত্ত্ব আলোচনা করা হলো।

সংক্রামক হাই তোলার সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্ব হলো, এটি একটি অবচেতন যোগাযোগের মাধ্যম। অন্যের হাই তোলা দেখলে হাই তোলার মাধ্যমে আমরা তার আবেগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি। ২০১০ সালে কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চার বছর বয়সের আগে হাই তোলা সংক্রামক হয় না। চার বছর বয়সে সহমর্মিতার দক্ষতা গড়ে ওঠার পর এই প্রবণতা দেখা যায়। গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে সংক্রামক হাই তোলার হার তুলনামূলকভাবে কম। কারণ, তাদের সহমর্মিতার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

২০১৫ সালের একটি গবেষণায় কলেজ শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব পরীক্ষা করা হয় এবং তাদেরকে হাই তোলার ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। দেখা গেছে, যারা কম সহমর্মিতার অধিকারী, তারা হাই তোলায় কম সংক্রমিত হয়। সিজোফ্রেনিয়ার মতো সহমর্মিতার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য মানসিক অবস্থার ক্ষেত্রেও সংক্রামক হাই তোলার হার কম।

তবে হাই তোলা এবং সহমর্মিতার মধ্যে সংযোগ এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। ডিউক সেন্টার ফর হিউম্যান জিনোম ভ্যারিয়েশনের একটি গবেষণায় ৩২৮ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর জরিপ চালানো হয়। যেখানে ঘুম, শক্তি এবং সহমর্মিতার পাশাপাশি তাদের হাই তোলার প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, ৩২৮ জনের মধ্যে ২২২ জন অন্তত একবার হাই তুলেছেন। যদিও এটি একটি স্থিতিশীল বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তবে সহমর্মিতা, দিনের সময় বা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সংক্রামক হাই তোলার সরাসরি কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। গবেষকরা ধারণা করছেন, এর পেছনে জিনগত কারণ থাকতে পারে।

আরও পড়ুন

প্রাণীদের হাই তোলা নিয়ে গবেষণা মানুষের হাই তোলার রহস্য উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে। কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইমেট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভিডিওতে অন্য শিম্পাঞ্জির হাই তোলা দেখে ছয়টির মধ্যে দুইটি শিম্পাঞ্জি সংক্রামিত হয়। তবে, শিশু শিম্পাঞ্জিরা সংক্রামিত হয়নি, যা ইঙ্গিত দেয় যে শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রেও সংক্রামক হাই তুলতে মস্তিষ্কের পরিপক্বতা প্রয়োজন।

কুকুর মানুষের হাই তুলতে দেখে সংক্রামিত হয়
প্রতীকী ছবি: পেকজেলস

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা যায়, কুকুর মানুষের হাই তুলতে দেখে সংক্রামিত হয়। ২৯টি কুকুরের মধ্যে ২১টি কুকুর মানুষকে হাই তুলতে দেখে হাই তোলে, তবে শুধু মুখ খুলতে দেখে নয়। গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাত মাসের বেশি বয়সী কুকুরগুলোই বেশি সংক্রামিত হয়।

আরও পড়ুন

কুকুর ছাড়াও, বিড়াল এবং অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও সংক্রামক হাই তোলার নজির পাওয়া গেছে। সিয়ামিজ ফাইটার ফিশ এবং পেঙ্গুইনের মতো প্রাণীর ক্ষেত্রেও হাই তোলা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

তাপমাত্রার সঙ্গে সংক্রামক হাই তোলার একটি সম্পর্ক রয়েছে। ২০১০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পাখিদের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে হাই তোলার হার বেড়ে যায়। মানুষের ক্ষেত্রেও ক্লান্তি বা বিরক্তির সময় হাই তোলা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করলে পরিবর্তন হতে পারে।

সংক্রামক হাই তোলার সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। এটি সহমর্মিতা, বয়স, তাপমাত্রা এবং জিনগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে, তবে এর প্রকৃত কারণ অজানা। যারা হাই তুলতে সংক্রামিত হয় না, তারা হয়তো খুব তরুণ, প্রবীণ, বা জিনগতভাবে সংক্রামিত হওয়ার প্রবণতাহীন—এর মানে এই নয় যে তারা সহমর্মিতাহীন। সংক্রামক হাই তোলা মানুষের এবং প্রাণীদের একটি জটিল এবং বিস্ময়কর আচরণ, যা আমাদের আরও গভীর গবেষণার জন্য অনুপ্রাণিত করে।

আরও পড়ুন