কবি কাজী নজরুল ইসলামের গীতিকবিতা ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম’ এই সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কবিতায় পাই:
মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম,
মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল।
মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়,
মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল।
আকাশের মতো বাধাহীন,
মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,...
এই কবিতা থেকে ‘আকাশের মতো বাধাহীন’ পঙ্ক্তিটা কিশোর আলোর ১১তম বার্ষিকীর স্লোগান হিসেবে আমরা গ্রহণ করেছি। এগারো পেরিয়ে নতুন দিন, মোরা আকাশের মতো বাঁধাহীন। কাজী নজরুল ইসলাম বাঁধাহীন শব্দে নিজে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছেন, তার মানে বন্ধনহীন। কোনো বাঁধনে যা আটকে নেই।
বাংলাদেশের কিশোর–তরুণেরা একটা নতুন দিন এনেছে। আকাশে এক নতুন সূর্য। এই সূর্য রক্তে আঁকা। এই গানটাও কিন্তু এই সময়ে খুব উচ্চারিত হয়েছে—পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্তলাল। আমাদের নতুন সূর্য রক্তের রঙে লাল। কত শিশু–কিশোর–তরুণ–যুবা রক্ত দিল। কতজন হাত–পা হারিয়েছে! কতজন দৃষ্টি হারাচ্ছে। কতজন এখনো হাসপাতালে। এর কোনো সীমা–পরিসীমা নেই। কত অশ্রু, কত ত্যাগ। কত বীরত্ব, কত সাহস। এত সাহস যে আমরা আজ গাইতে পারি, আকাশের মতো বাঁধাহীন!
আমাদের স্বপ্ন বড় হওয়াই উচিত। আমাদের স্বপ্ন আকাশ ছাড়িয়ে যাবে। মনের মধ্যে আমরা কোনো বন্ধনকে প্রশ্রয় দেব না।
কিন্তু আমাদের নিজেদের যোগ্য করেও তুলতে হবে। সক্রেটিস বলেছিলেন, সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম হলো নিজের কাজটাকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে করা। আমরা শিক্ষার্থী। আমাদের প্রথম আর প্রধান কাজ লেখাপড়া করা। সেটা যেন আমরা সবচেয়ে সুন্দরভাবে করি।
তবে শুধু বইয়ের পোকা হয়ে থাকলে চলবে না। সে জন্যই কিশোর আলো। যখন আমাদের শিশু–কিশোরদের শুধু জিপিএ–৫–এর প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তখনই ১১ বছর আগে কিশোর আলোর প্রথম প্রকাশ। আমরা বলেছি, আমরা সবকিছুতেই ভালো হব। লেখাপড়ায় ভালো হব, খেলাধুলায় ভালো হব, সংস্কৃতি চর্চা করব, পাঠাগার আন্দোলন করব, বিতর্ক–বক্তৃতা–আবৃত্তি করব, গান–কবিতা–নাটক–দেয়ালপত্রিকা করব, বিজ্ঞান মেলা, পরিবেশ ক্লাব, চলচ্চিত্র–আলোকচিত্র—নানা কিছুতে ব্যস্ত থাকব, আমরা মানুষের সেবা করব, মানুষকে ভালোবাসব আর নৈতিকতার চর্চা করব। সবাই যেন বলে, আমরা ভালো মানুষ। আমাদের এখন দরকার ভালো মানুষ। আমাদের এখন দরকার সুন্দর মানুষ। আমরা আলো ছড়াব, অন্ধকার নয়। আমরা প্রীতির কথা বলব, মায়ার কথা বলব। হিংসা, বিদ্বেষ, যুদ্ধ, হানাহানির বিরুদ্ধে আমরা সরব থাকব। আমরা বলব না, আঘাত করো। আমরা বলব, আঘাত কোরো না, ভালোবাসো।
তাহলে আকাশের মতো বাধাহীন হব কী করে? আমরা আকাশের মতো সীমাহীন বড় স্বপ্ন রচনা করব, আমরা এক আকাশসমান ভালোবাসা দিয়ে এই পৃথিবীটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলব। সে জন্য আমাদের আবারও সাহিত্যের কাছে ফিরে আসতে হবে। পৃথিবীর সেরা মনীষীরা তাঁদের সেরা চিন্তাগুলো আমাদের জন্য উপহার হিসেবে রেখে গেছেন, তা আমরা পাব বইয়ের মাধ্যমে। তাই শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য পড়ব না, আমরা পড়ব নিজের মনের আকাশটাকে বড় করার জন্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন:
মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে,
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে;
যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার, তখনি সে
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে;
দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার,
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার
মনে মনে।
চিন্তা করা যায়, রবীন্দ্রনাথের কবিতা কীভাবে আমরা আমাদের কালে সত্য হতে দেখলাম! কবিরা অনেক সময় ভবিষ্যৎ দেখতে পান।
আমরা আকাশের মতো বাধাহীন। আমাদের পৃথিবী অনেক বড়। বড় স্বপ্ন দেখো। স্বপ্ন পূরণের জন্য কিন্তু প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়। যাকে বলে সাধনা। সাধনা ছাড়া কেউ কোনো বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না।
তুমি যদি বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, গবেষক হতে চাও, তোমাকে এখন থেকেই গণিতে ভালো হতে হবে, বিজ্ঞানে তোমার আগ্রহ থাকতে হবে। কাজেই স্কুল–কলেজের পাঠক্রমের বিষয়গুলো তোমাকে মন দিয়েই শিখতে হবে, চর্চা করতে হবে। তুমি যদি লেখক হতে চাও, তাহলে তোমাকে প্রচুর পড়তে হবে, আবার লেখার অনুশীলনও করতে হবে, মানে লিখতে হবে। বড় বিজ্ঞানীরাও সাহিত্য প্রচুর পড়েছেন। আবার রবীন্দ্রনাথের মতো বড় সাহিত্যিকও বিজ্ঞান বিষয়ে অনেক চর্চা করেছেন, রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানবিষয়ক লেখাগুলো পড়লে বিস্মিতও হতে হয়।
আমাদের সময়ে কাউকে কাউকে হঠাৎ হঠাৎ সফল হতে দেখে আমাদের মনে হতে পারে, আমিও তো এই রকম করে সফল হতে পারি। এই বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো: কেউ কেউ আছেন, যাঁরা জিনিয়াস, তাঁরা অনেক বিস্ময়কর সাফল্য দেখাতে পারেন। এটা সবার বেলায় সত্য হবে না। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলাম স্কুলের পড়া শেষ করতে পারেননি বলে যদি আমি ভাবি আমিও পড়া শেষ করব না, বড় কবি হব, এটা সম্ভব হবে না। যদি কেউ ভাবে, ক্রিকেটার হব, তাহলে তো আর লেখাপড়ার দরকার পড়বে না, তাকে বলব, এক লাখ মানুষ ক্রিকেট খেলবে, বড় ক্রিকেটার হবে ১০ থেকে ১২ জন, বাকিদের কী হবে? তাই তারকা হওয়ার জন্য দৌড়ে লাভ নেই। মানুষ হওয়ার জন্য চেষ্টা করো। লেখাপড়া করো। মা–বাবার কথা শোনো। শিক্ষকদের শ্রদ্ধা দেখাও। ভালো মানুষ হও।
কিশোর আলোয় আমাদের চেষ্টা থাকে শিশু–কিশোরদের মনের দিগন্তকে বড় করার। একজন কিশোর যখন বড় হবে, সে যদি ডাক্তার হয়, যেন একটু ভালো ডাক্তার হয়, সে যদি কম্পিউটারবিজ্ঞানী হয়, যেন একটু ভালো কম্পিউটারবিজ্ঞানী হয়, মানবিক হয়, আলোকিত হৃদয়ের মানুষ হয়। বড় বড় পদে থাকা মানুষ যদি মানবিক না হয়, নৈতিকভাবে ভালো না হয়, তাহলে তারা খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সেই বিপদ থেকে ভবিষ্যৎকে বাঁচাবে তোমরা। তোমরা বড় মানুষ হবে, ভালো মানুষ হবে। তোমরা সাফল্যকে বিচার করবে নৈতিকতা দিয়ে। ভালোমানুষি দিয়ে। ইতিবাচকতা দিয়ে।
তোমাদের জন্যই কিশোর আলো গত ১১ বছরে এগিয়ে ছিল। তোমাদের সবাইকে অনেক ভালোবাসা।