যেভাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ধ্বংস করা হবে
২৩ বছর ধরে মহাকাশ গবেষণার এক অনন্য ল্যাবরেটরি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস)। বিশ্বের মহাকাশচারী ও বিজ্ঞানীদের গবেষণা, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ মহাকাশ অভিযানের জন্য এ স্টেশনটি কাজ করে আসছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই স্টেশনের জীবনকাল শেষ হয়ে আসায় এটিকে নিরাপদে ধ্বংস করার জন্য নাসা ও স্পেসএক্স একযোগে কাজ করছে।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা আইএসএস ধ্বংস করার জন্য ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন নিরাপদে ধ্বংস করতে খরচ হবে ৮৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯ হাজার ৮৭২ কোটি ১০ লাখ ৩২ হাজার ৪০০ টাকার সমপরিমাণ।
গত ১৭ জুলাই নাসা ও স্পেসএক্স জানিয়েছে, তারা আইএসএস ধ্বংসের একটি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ড্রাগন মহাকাশযান ব্যবহার করে আইএসএসকে এর কক্ষপথ থেকে বের করে পৃথিবীর কোনো এক নির্দিষ্ট সমুদ্রে নিরাপদে ধ্বংস করা হবে। ২০৩০ সালের শেষদিকে মহাকাশ স্টেশনটির কার্যক্রম শেষ হবে। আর এই মিশন কার্যকর শুরু হবে সম্ভবত ২০৩১ সালে।
স্পেসএক্সের ড্রাগন স্পেসশিপগুলো নিয়মিতভাবে আইএসএসে মহাকাশচারী, খাদ্য, পানি এবং বিভিন্ন ধরনের গবেষণা সরঞ্জাম পরিবহন করে। অন্যদিকে আইএসএসের ওজন প্রায় ৯ লাখ ২৫ হাজার পাউন্ড। যদিও মহাকাশচারী ও কার্গোর তুলনায় আইএসএস অনেক ভারী। তবু স্পেসএক্সের ড্রাগন স্পেসশিপগুলো নিখুঁত বা নির্ভুলভাবে এই ভারী বস্তুকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে সরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আইএসএসকে কক্ষপথ থেকে বের করে আনার জন্য ড্রাগন স্পেসশিপকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন। এ জন্যই স্পেসএক্স ড্রাগন স্পেসশিপকে সুপারচার্জ বা আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে।
স্পেসএক্স বর্তমান কার্গো ড্রাগন ক্যাপসুলকে আরও শক্তিশালী করার পরিকল্পনা করছে। তারা এ ক্যাপসুলটিতে একটি নতুন ও খুব শক্তিশালী ফুয়েল ট্যাংক যোগ করবে এবং এতে সাধারণ ড্রাগনের চেয়ে ৩০টি বেশি ইঞ্জিন সংযুক্ত করবে। তবে ‘ডি-অরবিট ভেহিকল’ একটি সাধারণ ড্রাগন মহাকাশযান থেকে প্রায় দ্বিগুণ দৈর্ঘ্যের হবে। আর চার গুণ বেশি শক্তি উৎপাদন করতে ছয় গুণ বেশি প্রোপেল্যান্ট বহন করবে।
স্পেসএক্সের ড্রাগন মিশন ম্যানেজমেন্টের পরিচালক সারাহ ওয়াকার জানিয়েছেন, মিশনের সবচেয়ে জটিল অংশ হবে আইএসএসকে এর চূড়ান্ত কক্ষপথের দিকে পাঠানোর জন্য শেষ ধাক্কা বা বার্নটি।
সারাহ ওয়াকার ব্রিফিংয়ে আরো বলেন, ‘আমাদের এ বার্নটি এমনভাবে করতে হবে, যাতে পুরো মহাকাশ স্টেশনটি বায়ুমণ্ডলীয় টানের কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণন ও শক্তি হ্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে এবং নিরাপদে এর নির্ধারিত কক্ষপথে পৌঁছাতে পারে।’
আইএসএসকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের মতো গভীর সাগরে নিরাপদে ডুবিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। নাসা এখনো সুনির্দিষ্ট স্থান চূড়ান্ত করেনি। তবে তারা নিশ্চিত করতে চায়, এই ফুটবল মাঠের সমান আকারের মহাকাশ স্টেশনটি যেন কোনো জনবসতিপূর্ণ এলাকা বা জাহাজ চলাচলের পথে আঘাত না করে।
১৯৯৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া, কানাডা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এই স্টেশনে ২০০০ সাল থেকে নভোচারীরা বসবাস করে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে আসছেন। প্রায় ৩ হাজার ৩০০ গবেষণা পৃথিবীর কক্ষপথে এই স্টেশনে সম্পন্ন হয়েছে।
তবে দীর্ঘদিনের ব্যবহারের ফলে স্টেশনে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে নভোচারীদের জন্য বিভিন্ন সময়ে নানা ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া ২০৩০ সাল নাগাদ দেশগুলোর মধ্যে স্টেশনটি পরিচালনার জন্য করা চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে। এরপর তারা নিজ নিজ মহাকাশ স্টেশনে কাজ শুরু করবে। নাসা ভবিষ্যতে ব্যক্তিমালিকানাধীন মহাকাশ স্টেশনগুলোয় বিনিয়োগ করার কথা ভাবছে। আইএসএসের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশ গবেষণার নতুন দ্বার উন্মুক্ত হবে বলে আশা বিজ্ঞানীদের।
সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট