বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় কোনটা? অনেকে নিশ্চয়ই মনে মনে উত্তর তৈরি করে ফেলেছ। ছোটবেলা থেকেই তো জেনে এসেছ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় হলো কেওক্রাডং। ভুল!
আসলে আমাদের সর্বোচ্চ পাহাড় হলো ‘সাকা হাফং’ বা পুবের পাহাড়। এর অবস্থান একেবারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে। মজার ব্যাপার হলো কেওক্রাডং কিন্তু প্রথম চারের মধ্যেও নেই। আমাদের সর্বোচ্চ যে পাহাড়গুলো রয়েছে তার প্রায় সব কটির অবস্থানই মিয়ানমারের একেবারে সীমান্ত ঘেঁষে। সেখানে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ সব পাহাড় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে সীমান্তের প্রহরীর মতো অনড় তাদের অবস্থান।
আমাদের ঘোরাঘুরির একটা দল আছে, ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়ি আমরা। এবারের পরিকল্পনা বাংলাদেশের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ উঁচু পাহাড়ে নিজেদের পায়ের চিহ্ন রেখে আসা। তাও আবার মার্চ মাসে! মার্চে পাহাড়ে গনগনে রোদ। মাথায় কেউ ডিম রেখে দিলে সেকেন্ডের মধ্যে পোচ হয়ে যাবে! কিন্তু পাহাড়ে ওঠার নেশা একবার পেয়ে বসলে ঘরে বসে থাকা কঠিন। ফলাফল মাথায় গামছা বেঁধে চূড়ায় ওঠার যাত্রা।
সে গামছা অবশ্য খুলে গেল রওনা দেওয়ার ২০ মিনিটের মাথায়! পানি, পানি বলে ছোটাছুটি শুরু করলাম পাহাড়ের কোনায়-কানায়। গরমে মাথায় যেন আগুন ধরে গেছে, দেড় হাত বেরিয়ে এসেছে জিব। টুকটুক করে বয়ে চলা ঝিরির পানি দেখে মনে হলো প্রশান্ত মহাসাগরের পানিও এর কাছে নস্যি। সে জলে গামছা ভিজিয়ে মাথায় প্যাঁচালাম। শুরু হলো পাহাড়জয়ের যাত্রা। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়া জ-ত্লং এবং চতুর্থ সর্বোচ্চ চূড়া যোগী হাফং যেতে হলে প্রথম বেসক্যাম্প করতে হবে দলিয়ান পাড়ায়। খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো এক পাহাড়ি পাড়া এটা। এখান থেকেই যাত্রা শুরু করেছিলাম আমরা। যোগী আর জ-ত্লংয়ে যেতে হলে রওনা করতে হয় খুব ভোরে, কাক ডাকারও আগে।
দলিয়ান পাড়ায় কাক নেই, তবে অনেক মুরগি আছে। ওরা আমাদের ডেকে তুলবে কী, উল্টো ওদেরই হাঁকডাকে অস্থির করে দিয়ে আলো-আঁধারির মাঝে রওনা দিলাম পুবের পাহাড়ে। প্রথম দিনের গন্তব্য যোগী হাফং। পাহাড়টা কাছেই। অভিজ্ঞরা বলেন, সন্ধ্যার আগেই নাকি আবার ফিরে আসতে পারব পাড়ায়। দুজন গাইড নিলাম আমরা। এর মধ্যে একজন বেশ অভিজ্ঞ। আরেকজন যোগী হাফংয়ের নামই শোনেনি। সে যাচ্ছে শুধু পানি বহন করার জন্য। কারণ, পাহাড়ে এই মৌসুমে পানির ভীষণ আকাল। তাই আমাদের সামনে জ্ঞানী গাইড, পেছনে পানি গাইড!
শুরুটা শুরু হলো ওয়াই জংশন দিয়ে, এর বাঁ দিকে যোগী হাফং, ডান দিকে গেলে জ-ত্লং। আমাদের ১০ জনের দল হাঁটা ধরল বাঁ দিকে। মাথা ফাটা রোদ আর বুক জ্বলা তৃষ্ণা নিয়ে তিরতির করে এগোচ্ছি জুমচাষের রাস্তা দিয়ে। সেখানে কয়েকটা পরিত্যক্ত জুমঘর। জুম চাষে ফসলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জুমঘর তোলা হয়। এখানকার ঘরগুলো জরাজীর্ণ, বোঝা যায় অনেক দিন কেউ আসে না এখানে। প্রায় ঘণ্টা তিনেক হাঁটার পর পেলাম নতুন এক জুমঘর, আমাদের আনন্দ তখন দেখে কে। পাহাড়ে নতুন সবজির চাষ হয়েছে, অচেনা সবজি, অচেনা রাস্তা আর এক অচেনা গাইড!
অচেনা গাইড! আসলে কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পর আবিষ্কার করলাম আমাদের গাইড আদতে কিছুই চেনেন না। যৌবনে উনি ভালো শিকারি ছিলেন, সেই সূত্রে পাহাড়ের দুর্গম এলাকা তাঁর মুখস্থ। শিকারের টানেই কিনা আমাদের এই পথে নিয়ে এলেন কে জানে! কারণ, এখন পর্যন্ত আশপাশে কোনো জনমানব দেখিনি। সামনে পড়ে আছে ঝুরঝুরে লাল মাটির অচেনা রাস্তা। এক পাশে গভীর খাদ—পা হড়কালেই মৃত্যু। সামনের রাস্তা এতই উঁচু যে ঘাড় রীতিমতো আকাশে তুলে দেখতে হয়। যত এগোই, তত উঁচু হয় রাস্তা। জিপিএসে দেখলাম মাত্র ২ হাজার ৫০০ ফুট ওপরে আছি। যোগী পাহাড়ে যেতে হলে উঠতে হবে আরও ৮০০ ফুট! আমরা ততক্ষণে কাহিল। মাথার চুল থেকে গায়ের জামাকাপড় সব ঘামে ভিজে জবজবে। একজন দুই মিনিট রেস্ট নেবে বলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ওঠানোর সাহস বা শক্তি কারও নেই। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত আমাদের আতঙ্কের সংবাদ দিল পানি গাইড—পানি প্রায় শেষ! এই নির্জন এলাকায় পানি পাই কোথায়! যত দূর চোখ যায় শুধু বাঁশবন। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, বাঁশবনের আশপাশে পানি থাকবে। কারণ, বেশির ভাগ ঝরনাই বাঁশবনে ঘেরা। আলাদিন তার জিনকে হুকুম দিত, আমি হুকুম দিলাম গাইডকে—যেখান থেকে পারো পানি নিয়ে আসো। ছোট গাইড সুড়সুড় করে নেমে গেল বাঁশবনের মধ্য দিয়ে। ৩০ মিনিট পর পানি নিয়ে ফেরত এল সে। সেই পানিতে উৎকট গন্ধ! কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। বোতলের মুখে গামছা পেঁচিয়ে দম বন্ধ করে ক্যোঁৎ করে গিলে ফেললাম। যদিও চলমান ঝরনা না হলে পানি সব সময় ফুটিয়ে খেতে হয়। কিন্তু আমরা নিরুপায়।
বিকেল যখন প্রায় পাঁচটা, তখন বুঝলাম পথ হারিয়েছি আমরা! জিপিএসে উচ্চতা দেখাচ্ছে ২ হাজার ৯০০ ফুট। সন্ধ্যার আগে পাড়াতে পৌঁছানোর কোনো সুযোগ নেই। যে জুমঘর ফেলে এসেছি, তা-ও এখান থেকে চার ঘণ্টার পেছন যাত্রা! সঙ্গে করে আনা বিস্কুট, খেজুর, চকলেটের ব্যাগের ওজন কমছে দ্রুত। এর মধ্যেই সামনে পড়ল একদম খাড়া এক ঝরনা, শুকনো খটখটে ঝরনার গা। এখান দিয়ে নাকি আমাদের উঠতে হবে। মনে মনে গাইডের মুণ্ডু চটকে পা বাড়ালাম।
কিছুক্ষণ আগে যেখানে ঝুরঝুরে মাটি, অচিন বাঁশবাগান, ধারালো লতা, ভোমরার বাসার ভয়ে আমরা থরহরি কম্পমান ছিলাম, সেই আমরাই হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম ঝরনার গা বেয়ে ওঠা শুকনো ঝিরিপথ দেখে! ধুপ করে যেন চলে এলাম প্রাগৈতিহাসিক কোনো জঙ্গলে! চেনাজানা সব ঝিরিপথের চেয়ে আলাদা এই পথ। কয়েকজন মানুষ সমান উঁচু শেওলামাখা পিচ্ছিল পাথর প্রতি মুহূর্তে হুমকি দিচ্ছে সামনে যেন না আসি। তবু শেষ বিকেলের আলো-আঁধারির মাঝে অদ্ভুত এক সাহস নিয়ে আমরা পা বাড়ালাম যোগী পাহাড় সামিট করার উদ্দেশ্যে। ঠিক দেড় হাত সামনের দৃশ্য দেখে সে সাহস ফুস করে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। বিশাল কয়েকটা পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কোনো মানুষের পক্ষে এই কাজ সম্ভব নয়। অনেকক্ষণ দেখে, হাত দিয়ে মাটি ঘেঁটে ঘোষণা দিল গাইড—এটা ভালুকের কাজ। ভালুক এখানে পাথর উল্টিয়ে কাঁকড়া খুঁজতে আসে! সর্বনাশ! যেখানে ভালুকের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। ভালুকের ভয়ে একজোট হয়ে গেলাম সবাই। সবার হাতে বাঁশ, টর্চলাইট। কিন্তু আমার মন খুঁতখুঁত করছে। বাতাসে কেমন যেন একটা পোড়া গন্ধ। বারুদ টাইপের কিছু একটা। হঠাৎ সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। মনে উঁকি দিল এক ভয়ংকর আশঙ্কা। তড়িঘড়ি করে সঙ্গী ফারুক ভাইয়ের হাত থেকে জিপিএসটা নিলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে অন করেই মুখোমুখি হলাম সেই ভয়াল সত্যের—আমরা আছি মিয়ানমারে!
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ল্যান্ড মাইন বা স্থলবোমা পুঁতে রাখে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। যেন অনাহূত কেউ এই পথ দিয়ে মিয়ানমারে ঢুকতে চাইলে বোমার আঘাতে মারা যায়! আমরা হয়তো দাঁড়িয়ে আছি সেই ল্যান্ড মাইন পোঁতা কোনো এক ঝিরিপথে! চিৎকার দিলাম, যে যেখানে আছে দাঁড়িয়ে গেল। জীবনে অনেক পাহাড়, ঝিরি ঘুরেছি, সারারাত অন্ধকারে ঝুমবৃষ্টিতেও জঙ্গলে হেঁটেছি। কিন্তু এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য নতুন। এক পা বাড়ালেই হয়তো উড়ে যাব! সবাইকে জানালাম, বুঝল সবাই। কটমট করে গাইডের দিকে তাকালাম। সে তার নিজের গলায় দা ধরে কসম কাটল—এটাই নাকি যোগী পাহাড়ে যাওয়ার পথ! ভুল হলে সে নিজের গলা কেটে ফেলবে! সবাই মাথা ঠান্ডা করে পা টিপে টিপে এগোতে শুরু করলাম সামনের দিকে। জিপিএস বলছে আর ২৫০ ফুট উঠলেই যোগী পাহাড়ে উঠে যেতে পারব। পরের পথটুকু মোহগ্রস্তের মতো এগোলাম। কীভাবে এগোচ্ছি জানি না, শুধু জানি এগোতে হবে। দলের কনিষ্ঠ সদস্য ফারহানা ঘোষণা দিল, দুনিয়া উল্টে গেলেও এই পথ দিয়ে সে ফিরবে না। এক ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা থামলাম। দুনিয়া ওলটায়নি, তবে দুনিয়ার শেষ মাথা মনে হয় আমাদের সামনে। আর কোনো পথ নেই, সুবিশাল এক পাথুরে দেয়াল চোখের সামনে। সবাই একে অপরের দিকে তাকালাম। গাইডের দিকে তাকাতেই দেখি সেই খাড়া দেয়ালে ঝুলে থাকা বাঁশগাছ বেয়ে টারজানের মতো ঝুলে ঝুলে উঠে যাচ্ছে গাইড। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, এখান দিয়েই উঠতে হবে, এটাই নাকি যোগী পাহাড়! শুরু হলো গড়িমসি! এখান দিয়ে কীভাবে সম্ভব! বাবু ভাই বসে পড়লেন। তিনি রাত তিনটায় ফেসবুকে আমাদের যাওয়ার কথা শুনে এক ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে রওনা দিয়েছিলেন। জীবনে কখনো বান্দরবানের গহিনে না আসা বাবু ভাইয়ের চোখে বিধ্বস্ত দৃষ্টি। তিনি ঘোষণা দিলেন আর জীবনে কোনো দিন রাত ১১টার পর ফেসবুকই খুলবেন না! আরও কোনো ঘোষণা দিতে যাচ্ছিলেন, পেছনে ভালুকের হুংকারে তাঁর সে ঘোষণা গলাতেই আটকে রইল। পড়িমরি করে দৌড় সবাই। শহুরে ছেলেগুলো তরতর করে ঝুলে ঝুলে উঠে পড়ছে পাহাড়ের গা বেয়ে! আমি ছিলাম সবার নিচে। সবাই যেন ঠিকঠাকভাবে ওঠার পর আমি উঠব, আমার পেছনে ফারহানা! এই বাঁশবাগান বেয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এর থেকে ভালুকের খাবার হতেই নাকি রাজি সে! এমন সময় ঝুরঝুরে পাথরে উঠতে গিয়ে পা হড়কালো দুজন। দেড়-দুই ফুট আকারের বিশাল এক পাথর ধেয়ে এল ফারহানার দিকে। সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আমি। নিজের শরীর দিয়ে আটকে দিলাম পাথর। সোজা কোমরে এসে বাড়ি লাগল। কুঁকড়ে গেলাম ব্যথায়। দেখল সবাই, কিন্তু কারোরই কিছু করার নেই। সবাই ঝুলছে।
বন্ধু কবির, আমি আর ফারহানা ছাড়া কেউ নেই দৃষ্টিসীমায়। সবার আগে চলে গেছে জাফর আর শাহেদ। তাদের গান গেয়ে সাহস দিচ্ছেন দেলোয়ার ভাই। ফারুক ভাই তার ওষুধের ব্যাগ নিয়ে সবার দিকে নজর রাখছেন। বাঁশ আর পাথরের জঙ্গল পেরিয়ে তারা চোখের আড়াল হতেই পাহাড়জুড়ে অন্ধকার নেমে এল। বহু কষ্টে বাঁশ ধরে উঠছে ফারহানা। এর মধ্যে একটার মাটি একটু আলগা। হুড়মুড় করে পড়ে গেল সে। ঠিক আমার পাশ দিয়ে নিচে পড়তে পড়তেই ধরে ফেললাম ওকে। যাকে বল একেবারে বাদুড়ঝোলা, শূন্যে চার হাত-পা ছড়িয়ে ঝুলে আছে সে। আমি যে বাঁশটায় ভর দিয়ে ওকে ধরে রেখেছি, মটমট করে উঠল সেটাও। এটা ভাঙলে সোজা ৭০-৮০ ফুট নিচের পাথরে থেঁতলে যাবে শরীর। সাহায্যের জন্য গলা ছেড়ে ডাকছি দুজনই, কিন্তু কারও কানেই পৌঁছাল না সে আওয়াজ!
শরীরের সব শক্তি এক করে অবশেষে আমরা উঠলাম কোনোমতে। ঘন জঙ্গল পাড়ি দিয়ে যখন যোগী পাহাড়ে পৌঁছালাম, তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারার আলোতে দেখা যাচ্ছে সামনে আরও তিনটি পাহাড়ের মাথা। ফারুক ভাই জানালেন, ওই তিনটি যোগীর আরও তিন মাথা। অর্থাৎ যোগী হাফং সামিট করতে হলে চারটা পাহাড়ের মাথায় উঠতে হয়। এটা ৪ নম্বর এবং এটাই সবচেয়ে উঁচু! যারা এখানে আসে, প্রথম তিনটি সামিট করেই চলে যায়, কারণ এটাতে আসা ‘লাইফ রিস্ক!’ হাতে গোনা কয়েকজন আসে এখানে! আমরা ঠিক সেই অসাধ্য কাজটাই করে ফেলেছি, তিনটি পাহাড় না ডিঙিয়ে আমরা সোজা ৪ নম্বর পাহাড়ে চলে এসেছি। এটাই সবচেয়ে উঁচু—জিপিএস রিডিং একবার দেখাচ্ছে ৩ হাজার ২৭২ ফুট, আরেকবার দেখাচ্ছে ৩ হাজার ২৫৪। কখনো ৩ হাজার ২৩৮! অর্থাৎ টেকনিক্যালি আমরা যোগী পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পড়েছি এবং সেটা পেছন দিক দিয়েই—মানে মিয়ানমার থেকে!
এমন সময় গাইড জানাল, সে এই রাস্তা ছাড়া আর কোনো রাস্তা চেনে না! তারার আলোতে চকচক করে উঠল আমাদের ক্রুদ্ধ চোখ। ঘোষণা দিলাম, আজ আমি কোথাও যাব না। কবির ঠাস করে একটা চড় দিল নিজের গালে। ভাবলাম, এই পথে আসার কথা ভেবে নিজের গালে চড় দিচ্ছে বোধ হয়। টর্চ জ্বেলে দেখি ওর গালে ইঞ্চি সমান এক মশা থেঁতলে আছে! কাউকে বলে দিতে হলো না কী করতে হবে—সবাই সুড়সুড় করে ফেরার পথ ধরল। এখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত! আবারও সেই পাহাড়ি বাঁশবাগান, আবারও সেই মাইন আতঙ্ক, শেওলা পাথর, ঝুরঝুরা মাটি। সঙ্গে যোগ হলো নতুন আতঙ্ক—কী হবে যদি মিয়ানমার সেনাবাহিনী আমাদের আলো লক্ষ্য করে চলে আসে! ভয়ে আলো নিভিয়ে চুপচাপ হাঁটা শুরু করল সবাই।
আমরা সেই জুমঘরে ফিরলাম রাত দুইটায়। ক্ষুধায় কাতর সবাই। কয়েকজন ওই রাতেই পাড়ায় চলে যেতে চাইল। ওরা গেলে যাক, আমাদের এত লোভ নেই। আমরা পাঁচজন থেকে গেলাম জুমঘরে। জীবনের স্বপ্ন ছিল একটা অচিন পাহাড়ে জুমঘরে রাত কাটাব। সারারাত ঠান্ডায় আর ক্ষুধায় কাঁপতে কাঁপতে ভোর দেখলাম আমরা। ভোরে এগোলাম দলিয়ান পাড়ার দিকে।
টানা ২৬ ঘণ্টা আমরা কোনো জনমানুষ দেখিনি, পেটে কোনো ভারী খাবার পড়েনি, পানির অভাবে ফেটে গেছে ঠোঁট! পাহাড় এমনই, সব নিংড়ে নিয়ে দেখাবে তার রূপ। পাহাড়ের ভয়কে আপন করতে পারলে পাহাড়ও তাকে আপন করে নেবে। মাঝেমধ্যে দেবে অপ্রত্যাশিত কিছু উপহারও। আমাদেরও দিয়েছিল পরদিন বিকেলে...মেঘের ওপর এক অদ্ভুত পাড়ার সন্ধান। সে গল্প না হয় আরেক দিন...