২০১৯ সালের ২ মে ভারতের ওডিশা রাজ্যে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ফণী। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। লন্ডভন্ড হয় বেশ কিছু উপকূলীয় এলাকা। আঘাত হানার পর তীব্রতা কমে গিয়ে ক্রান্তীয় ঝড় হিসেবে শুরুতে কলকাতা ও পরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায় ফণী। ঘূর্ণিঝড় ফণীর নাম দিয়েছিল বাংলাদেশ। ফণী মানে যার ফণা আছে, যেমন সাপ। ফণীর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে লক্ষাধিক মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবুও এই ঝড়ে ভারত ও বাংলাদেশের ৮৯ জনের মৃত্যু হয়।
আরুবা ফারুকের তখন ১৩ বছর বয়স। মা–বাবার সঙ্গে একদিন লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডারে গিয়েছিল আরুবা। গিয়ে দেখে, দীর্ঘদিন ধরে তলিয়ে আছে চরের কিছু এলাকা। চারদিকে পানি, কিন্তু খাওয়ার মতো পানি নেই। পানির অভাব দেখে কিশোরী আরুবার মাথায় প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হলো, সরেজমিনে দেখে কৌতূহলী হয়ে ওঠে সে। বুঝতে পারে, ঘন ঘন ঝড়–বন্যা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।
বাবার সরকারি চাকরির কারণে আরুবা তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকে। জলবায়ু নিয়ে তার সচেতনতা তখন থেকেই। বাবার বদলির কারণে দেশের বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছে আরুবাকে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বদলাতে হয়েছে অন্তত ১০টি স্কুল। দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকার সময় ওই এলাকার পরিবেশ–প্রকৃতি নিয়ে সচেতনতা গড়ে উঠেছে তার মধ্যে।
আরুবা বলেছে, ‘আমাদের বসবাসের জন্য আছে একটাই পৃথিবী। পৃথিবীর জলবায়ু রক্ষা করতে না পারলে মানুষকে রক্ষা করা যাবে না। আর জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে শিশুরা, যারা পৃথিবীর জলবায়ু ধ্বংসের জন্য একদমই দায়ী নয়। জ্বালানি ব্যবহার করে কাজগুলো শিশুরা করে না। পরিবেশ দূষণ করা বড় বড় কারখানার মালিকও শিশুরা নয়। কিন্তু ঝড়, বন্যা আর যেকোনো দুর্যোগে প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরাই।’
শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় আরুবা। সে তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। শিক্ষকদের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে আরুবা। শিক্ষকেরা তাকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করেন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে। এভাবে আরুবার উদ্যোগে স্কুলে শুরু হয় জলবায়ু সচেতনতা কার্যক্রম। জলবায়ু অলিম্পিয়াড, দেয়ালপত্রিকা। ২৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আয়োজন করা হয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার।
২০১৯ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রথম দেশ হিসেবে ‘গ্রহগত জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। অথচ মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ নির্গমন করে বাংলাদেশ।
২০২১ সালে অনলাইনে একটি পিটিশন চালু করে আরুবা, যেটি স্বীকৃত হয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ু ধর্মঘটের অংশ হিসেবে। বড় বড় মানুষ স্বাক্ষর করেছেন এই পিটিশনে। সদ্য প্রয়াত জলবায়ুবিপ্লবী সালিমুল হক, আইনুন নিশাতসহ বিজ্ঞানী, ছাত্র, উন্নয়ন সংস্থার কর্মী এবং সাধারণ মানুষ এই পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন। একই বছর জুনে বাংলাদেশ সরকার ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার ঘোষণা দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতার কার্যক্রম লিখে কুইনস কমনওয়েলথ রচনা প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিল আরুবা। প্রতিবছর এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ইংল্যান্ডের রয়েল কমনওয়েলথ সোসাইটি। কমনওয়েলথভুক্ত ৭১টি দেশের শিক্ষার্থীরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে। হাজারো তরুণ অংশগ্রহণকারীর এই প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে আরুবা।
জুনিয়র ও সিনিয়র ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতাটি হয়। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত জুনিয়র ক্যাটাগরি এবং ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সীরা সিনিয়র ক্যাটাগরিতে অংশ নিতে পারেন। প্রতিযোগিতার জন্য নিবন্ধ, গল্প, কবিতা ও রচনা লিখে জমা দিতে হয়। বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা বিভাগগুলো হলো উইনার, রানারআপ, গোল্ড, গোল্ড ফাইনালিস্ট, সিলভার এবং ব্রোঞ্জপদক। এর মধ্যে উইনার ও রানারআপ বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন ব্রিটিশ রানি। রানি মারা যাওয়ার পর এই পুরস্কার তুলে দেন রাজা চার্লস। রাজপ্রাসাদে বিশেষ অনুষ্ঠানে পুরস্কার গ্রহণের পাশাপাশি লন্ডনে শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সপ্তাহব্যাপী যুক্ত থাকার সুযোগ পায় উইনাররা। বিজয়ীদের সনদ ও পদক দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিজয়ীরা কুইনস কমনওয়েথ ট্রাস্টের সদস্য হতে পারে সহজে।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন কুইনস কমনওয়েলথ পুরস্কার বিজয়ী হয়েছে। এ বছর আরুবা ফারুক সিনিয়র ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদক পেয়েছে। এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে এবার হলিক্রস কলেজে ভর্তি হয়েছে আরুবা। এরই মধ্যে বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছে সে। যেমন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনস পূর্ণ বৃত্তিতে পড়ার সুযোগ দিয়েছে আরুবাকে। ২০২৬ সালের মধ্যে এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে আরুবা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ৩০ নভেম্বর শুরু হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ)-এর ২৮তম আসর। এই সম্মেলনে ভিজিটর হিসেবে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে আরুবা।
জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আরুবা কাজ করতে চায়। এই পুরস্কার আরুবাকে পথ দেখাবে নিশ্চিত।