বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৪ বছর। সেখানে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর রাজকার্য পরিচালনা করেছেন ৭০ বছর। ১৯২৬ সালে জন্ম নেওয়া রানি বেঁচে ছিলেন ৯৬ বছর। এই জীবনে তিনি দেখেছেন যুদ্ধ। দেখেছেন পুরোনো বিশ্ব থেকে বিশ্বের আধুনিকায়নও।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ আসলে কত কিছু দেখেছেন, তাঁর একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। এর আগে কিছু তথ্য তুলে ধরছি। রানির পুরো নাম এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর। মা আদর করে ডাকতেন ‘লিলিবেট’। তাঁর বাবা ছিলেন আলবার্ট ফ্রেডেরিক আর্থার জর্জ। যাঁকে রাজা ষষ্ঠ জর্জ নামেই সবাই চেনে। মা ডাচেস অব ইয়র্ক এলিজাবেথ অ্যাঞ্জেলা মার্গারেট বোস-লিয়ন। ১৯৫২ সালে ষষ্ঠ জর্জ মারা গেলে রানি হন এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি। সেই সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। এরপর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের আমলে আরও ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন। সবশেষ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। যাঁকে নিয়োগ দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা যান। রানি সিংহাসনে বসার পর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ জন প্রেসিডেন্ট এসেছেন। তিনি যখন রানি হন অর্থাৎ ১৯৫২ সালে তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হ্যারি ট্রুম্যান। আর তিনি যখন মারা গেলেন তখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
প্রযুক্তির এক অবিশ্বাস্য উন্নয়ন দেখেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। কারণ, ১৯২৬ সালে যখন তাঁর জন্ম হয়, তখনো কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয়নি। তাঁর জন্মের এক বছর পর অর্থাৎ ১৯২৭ সালে টেলিভিশন আবিষ্কৃত হয়। আর ১১ বছর পর আবিষ্কৃত হয় কম্পিউটার। আর তিনি যখন মারা গেলেন তখন পারমাণবিক শক্তি, ইন্টারনেটের যুগ পেরিয়ে রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছে মানুষ।
রাজনীতিরও নানা উত্থান–পতন দেখেছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আট বছর পর রানির জন্ম। এরপর কমপক্ষে ৩০টি বড় যুদ্ধ দেখেছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তান যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধসহ হাল আমলের ইউক্রেনের মতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। তিনি ভারত ভাগ হতে দেখেছেন। দেখেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে কীভাবে এত দেশের জন্ম হলো। মিখাইল গর্বাচেভের মতো উদার সংস্কারবাদী নেতার শাসন যেমন দেখেছেন, তেমনি সেই ভূখণ্ডে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা ভ্লাদিমির পুতিনের মতো নেতার শাসন দেখেছেন তিনি।
৯৬ বছর আগে যখন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্ম হয় তখন সত্যিকার অর্থেই রাজত্ব করত ব্রিটিশরা। সেই সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার সম্পর্কে বলা হতো, এই সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য ডোবে না। এদিকে ভারত যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন ছিল, তেমনি আফ্রিকাতেও ছিল এই সাম্রাজ্যের বিস্তার। অবশ্য রাজসিংহাসনে বসে থাকা অবস্থায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সংকোচন তিনি দেখেছেন। তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের পাঁচ বছর আগে ভারত স্বাধীন হয়। এরপর তাঁর রাজত্বকালে আফ্রিকায় একের পর এক দেশ স্বাধীন হয়। তাঁর জীবদ্দশায় ব্রিটিশ রাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে গিয়ে সবশেষ প্রজাতন্ত্র পায় বারবাডোজ। গত বছর এই দেশ রানিকে সরিয়ে নতুন রাষ্ট্রপ্রধান পায়। সাম্রাজ্য ছোট হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ রাজপরিবারের ক্ষমতাও কমে এসেছে। ১৯৬০-এর দশক থেকে রাজপরিবার ব্রিটিশ সরকার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। আর ১৯৮৯ সালে যুক্তরাজ্য সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করে। তখন থেকে রানির দায়িত্ব মূলত আনুষ্ঠানিকতা পালন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তখন থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নেয়।
রানি জীবদ্দশায় যে শুধু বাইরের সংকট দেখেছেন, এমনটা নয়। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সংকটও দেখেছেন, সেই সংকট সামলেছেনও তিনি। ১৯৯০-এর দশকে রাজপরিবারে নানা ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটতে শুরু করে। তাঁর ছেলে প্রিন্স অ্যান্ড্রু ও স্ত্রী সারা আলাদা হয়ে যান। মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান ও স্বামী মার্ক ফিলিপসের বিয়ে ভেঙে যায়। এরপর বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লসের (তখন প্রিন্স চার্লস) সাবেক স্ত্রী ডায়ানা ১৯৯৭ সালের প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। ডায়ানা মারা যাওয়ার পর রানির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তবে কয়েক দিন নীরব থাকার পর টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি। ডায়ানাকে প্রশংসায় ভাসান সেই ভাষণে। পরিস্থিতি সামলে নেন তিনি।
এরপর প্রিন্স অ্যান্ড্রুর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা নিয়ে কেলেঙ্কারি ফাঁস হলে তাঁর সামরিক মর্যাদা কেড়ে নেন এবং রাজকীয় দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তও নেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। একইভাবে নাতি প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী মেগান মার্কেল সংবাদমাধ্যমে রাজপরিবারের বিভিন্ন তথ্য ফাঁস করে দিলে হ্যারি ও মেগান—দুজনই রাজপরিবারের সব সুযোগ-সুবিধা হারান। আবার ২০০৫ সালে ক্যামিলা পার্কারকে বিয়ে করতে প্রিন্স চার্লসকে (বর্তমান রাজা) অনুমতি দিয়ে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ান রানি।
রাজনীতির বাইরে থাকার রীতি থাকলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদের (ব্রেক্সিট) সময় আর দূরে থাকতে পারেননি রানি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বিবৃতি দেন তিনি। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক হবে যুক্তরাজ্যের। অতীতের সম্পর্কের ইতিহাস টেনে সম্পর্ক জোরদার করার কথাও বলেছিলেন রানি। কিন্তু এই বক্তব্য এতটাই কৌশলী ছিল যে সেখান থেকে বোঝা সম্ভব ছিল না, তিনি ব্রেক্সিটের পক্ষে না বিপক্ষে।
রাজনৈতিক কিংবা পারিবারিক যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রানি বেশ ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর ফলে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশদের কাছে। এর প্রমাণ পাওয়া গেল তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর চিত্রে। প্রায় আড়াই লাখ মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এ জন্য অধিকাংশ মানুষকে ১৫ ঘণ্টার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।
নতুন রাজা তৃতীয় চার্লস
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ব্রিটেনের রাজা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন রাজা তৃতীয় চার্লস। ৭৩ বছর বয়সে রাজা হলেন তিনি। লন্ডনের সেন্ট জেমস প্যালেসে এক আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের রাজা হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছে তৃতীয় চার্লসের। তিনি কেমন রাজা হবেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন আলোচনাও হচ্ছে।
কথিত রাজা বলতে যা বোঝায় তৃতীয় চার্লস হয়তো তেমন হবেন না। কারণ, তিনি বিজ্ঞানমনস্ক। ১৯৬৮ সাল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব নিয়ে সোচ্চার তিনি। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অন্যতম সমর্থক ছিলেন চার্লস। ২০২০ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এভাবে চলতে দিতে পারি না। আমরা যদি হাল ছেড়ে দিই এবং দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে দিই, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে।’
জলবায়ুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে চার্লস কথা বলে বিভিন্ন সময় সমালোচিতও হয়েছেন। কিন্তু তাঁর আচরণে এটা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে যে তাঁর মা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যেভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেছেন, ততটা হয়তো তিনি থাকবেন না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সফল হতে হলে আমাকে পুরোপুরি তাঁর (রানি) মতো হতে হবে, এমন ধারণা অমূলক।’ তবে তিনি কতটা সফল হবেন, সেটা সময়ই বলে দেবে।
টুকরা খবর
পাসপোর্ট ছাড়া ১২০ দেশে
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কোনো পাসপোর্ট ছিল না। রাজপরিবারের ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে, কোনো দেশে যাওয়ার জন্য কোনো পাসপোর্টের প্রয়োজন হতো না তাঁর। কারণ, ব্রিটিশ পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় তাঁর ক্ষমতাবলে। আর এমন পাসপোর্ট ছাড়াই ১২০টির বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন রানি। সবচেয়ে বেশিবার গেছেন কানাডায়। তবে ব্রিটিশ রাজপরিবারের অন্য সদস্যদের পাসপোর্ট রয়েছে।
এ ছাড়া রানির কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্সও ছিল না। একমাত্র তিনিই যুক্তরাজ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাতে পারতেন।
রানির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না
রানি কোনো স্কুলে যাননি। পড়েননি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর মা তাঁকে পড়িয়েছেন। কিংবা তাঁর দেখাশোনা যাঁরা করতেন, তাঁরা পড়িয়েছেন। তবে নতুন রাজা এমন নন। ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন রাজা তৃতীয় চার্লস।
দুটি জন্মদিন রানির
রানি দুটি জন্মদিন পালন করতেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল। এই দিন যেমন জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয়, তেমনি জুনের একটি শনিবারও তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। কারণ, ওই সময় আবহাওয়া ভালো থাকে।
সবচেয়ে বেশি সময়ের রানি
যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময়ের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তাঁর আগে রানি ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে ছিলেন ৬৩ বছর ২১৬ দিন। দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে থাকলেন ৭০ বছরের বেশি সময়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি রানি ভিক্টোরিয়ার রেকর্ড ভাঙেন।
রানি হওয়ার কথা ছিল না তাঁর
বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে দ্বিতীয় এলিজাবেথকে সিংহাসনে বসতে হয়। অথচ তাঁর বাবা ও তাঁর রাজসিংহাসনে আরোহণের সম্ভাবনা ছিল একেবারে কম।
সিংহাসনের উত্তরাধিকারের তালিকায় তৃতীয় ছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এ তালিকায় প্রথম ছিলেন তাঁর বড় চাচা প্রিন্স অব ওয়েলস অষ্টম এডওয়ার্ড ও তাঁর বাবা ডিউক অব ইয়র্ক আলবার্ট ষষ্ঠ জর্জ।
দাদা পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর পর তাঁর বড় চাচা অষ্টম এডওয়ার্ড ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ সিংহাসনে বসেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি সিংহাসন ত্যাগ করেন। এর পেছনে ছিল প্রেমের সম্পর্ক। মার্কিন সমাজকর্মী ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করতে চাইলে তাঁর সিংহাসনে থাকা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পরে সিংহাসন ত্যাগ করেন অষ্টম এডওয়ার্ড। আর এর মাধ্যমে রানি এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জের ক্ষমতা গ্রহণের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে রানি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় দ্বিতীয় এলিজাবেথের।
রাজা আছে, রানি নেই
ব্রিটেনের রানি কে হবেন, তা ঠিক হয় উত্তরাধিকারসূত্রে। অর্থাৎ রানি হবেন তিনিই, যিনি পূর্বসূরির কাছ থেকে উত্তরাধিকারবলে এই খেতাব পাবেন। তাঁর মর্যাদা, কর্মকাণ্ড আর দায়িত্বগুলোও হবে একজন রাজার মতোই। যেমনটি ছিলেন সদ্য প্রয়াত দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তিনি রাজসিংহাসনে বসেছিলেন বাবার উত্তরাধিকারসূত্রে।
অন্যদিকে রাজাকে যিনি বিয়ে করবেন, তাঁকে বলা হবে কুইন কনসর্ট। যেটা বলা হচ্ছে ক্যামিলা পার্কারকে। তিনি কখনোই রাজসিংহাসনে বসতে পারবেন না। কারণ, তৃতীয় চার্লসকে বিয়ের মধ্য দিয়ে রাজপরিবারের সদস্য হয়েছেন তিনি।