এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত, লম্বা দূরত্বে দ্রুত আর সহজ যাতায়াতে বিমানের জুড়ি নেই। বিমানযাত্রা অনেক বেশি আরামদায়ক ও নিরাপদ বলেও বিবেচিত। দেশের ভেতরে এই দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা পেতে হলে প্রয়োজন শুধু বিমানের টিকিট। দেশের বাইরে যেতে পাসপোর্ট, ভিসার মতো কাগজপত্র লাগে। কোনো দেশে যেতে হলে সেখানকার আইনও মানতে হয়।
বিমানসহ সব যানবাহনের জন্য থাকে নির্দিষ্ট স্টেশন। ট্রেন, বাস, জাহাজ, ফেরি সবকিছু নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ছেড়ে যায়। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে থামে। বিমানেও তেমনি। দরকার হয় রানওয়ে ও এয়ারপোর্ট। রানওয়ে হলো বিমানবন্দরের এমন একটি অংশ, যেখানে বিমান অবতরণ ও উড্ডয়ন করে।
এয়ারপোর্ট বা বিমানবন্দরের মাধ্যমে মূলত এক জায়গা বা দেশ থেকে অন্য জায়গা বা দেশে যাওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এই প্রক্রিয়া সাধারণত শুরু হয় নিরাপত্তা স্ক্যানারের তল্লাশির মাধ্যমে। এরপর ধাপে ধাপে চেক ইন, ইমিগ্রেশন, বোর্ডিং। শেষে আকাশপথে যাত্রা। নেমে আবার অবতরণের ইমিগ্রেশন, কাস্টমস চেকিং সেরে বিমানবন্দর থেকে বের হওয়া যায়।
মাঝেমধ্যে দেখা যায় বিভিন্ন বিমানবন্দরে যাত্রীদের তল্লাশি চলছে। সেখানে মন খারাপ করে কোনো শিশু দাঁড়িয়ে আছে। কখনো শিশুদের কাঁদতেও দেখা যায়। অনেক কারণেই শিশুরা কাঁদে। তবে একটি কারণ, শিশুদের প্রিয় খেলনা রেখে দিয়েছেন বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা। খেলনার মধ্যে থাকে খেলনা পিস্তল বা অস্ত্রজাতীয় কিছু।
এখন প্রশ্ন হলো, খেলনা পিস্তল নিয়ে কি বিমানে চড়া যায়? বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল আইন ২০১৭ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা বেপরোয়াভাবে এমন কোনো কাজ করেন, যাতে নির্বিঘ্নভাবে বিমান পরিচালনায় অসুবিধা সৃষ্টি হয় এবং এর মাধ্যমে কোনো মানুষের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হয়, তাহলে সেটিকে একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ জন্য তিনি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অনধিক পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সাধারণ দৃষ্টিতে, খেলনা পিস্তল কারও জীবনের ঝুঁকি তৈরি করে না। তবে অনেক সময় এই খেলনাও জটিলতা তৈরি করতে পারে। যেমন ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ বিমানের একটি বোয়িং বিমান ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাচ্ছিল। ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার পরেই একজন যাত্রী পিস্তল নিয়ে ককপিটে প্রবেশ করেন। মাঝ আকাশেই তিনি পাইলটকে পিস্তল ধরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার দাবি করেন। বিমানের পাইলট ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে তাকে ব্যস্ত রাখেন, যেন সে কারও ক্ষতি না করে। এর মধ্যেই তিনি বিমানটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণ করান। অবতরণের পর পাইলট জরুরি গেট দিয়ে সব যাত্রীকে নিরাপদে বের করে দিতে সক্ষম হন, নিজেও বের হয়ে পড়েন। ততক্ষণে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, কমান্ডো, র্যাব, সোয়াট আর দমকল বিভাগ বিমানটি ঘিরে ফেলে।
অবতরণের প্রায় দুই ঘণ্টা পর সন্ধ্যায় অভিযান শুরু করেন সেনা কমান্ডোরা। হোলি আর্টিজান বেকারিতে যে দলটি অভিযান পরিচালনা করেছিল, সেই একই দল এখানে অভিযানটি পরিচালনা করে। কমান্ডোরা ওই ব্যক্তিকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে তিনি তাতে সাড়া দেননি। শেষ পর্যন্ত ওই ব্যক্তির নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে অভিযান শেষ হয়। তদন্তের পর জানা যায়, কথিত সেই ছিনতাইকারী যে অস্ত্রটি ব্যবহার করেছিলেন, সেটি আসলে একটি খেলনা পিস্তল।
তাহলে লক্ষ করে দেখো, সামান্য খেলনা পিস্তল হলেও এর জন্য সব যাত্রীদের কী পরিমাণ দুঃসহ সময় পার করতে হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীকে অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছে এবং কথিত ছিনতাইকারীকে প্রাণও দিতে হয়েছে। খেলনা বন্দুক তাই সাধারণ সময়ে খেলনা হলেও আকাশপথে তা বিপজ্জনক বস্তুতে পরিণত হতে পারে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘আকাশপথে যাত্রীসেবা সহায়িকা’ অনুযায়ী, হ্যান্ড লাগেজে যাত্রীরা স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ, মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, মূল্যবান জিনিস, জরুরি কাগজপত্র, জরুরি ব্যবহার্য ওষুধ ইত্যাদি বহন করবেন। তবে ছুরি, কাঁচি, সুই, ম্যাচ, লাইটার, ১০০ মিলিলিটারের অধিক পরিমাণ লিকুইড, যাত্রী ও ক্রুদের বিরক্তির সঞ্চার হয় বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোনো জিনিস হ্যান্ড লাগেজে নেওয়া নিষিদ্ধ। এ রকম কোনো জিনিস হ্যান্ড লাগেজে থাকলে যাত্রী উড়োজাহাজে প্রবেশের চেকিংয়ের সময় সরিয়ে ফেলতে হবে। কিছু মালামাল চেক ইন লাগেজে দিয়ে দিতে হবে। কেবিনে সঙ্গে রাখা যায় না।
ফলে বাংলাদেশে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো বস্তুকে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কারণ মনে করলে তারা ব্যক্তি বা তার ব্যাগ থেকে ওই বস্তু অপসারণ করতে পারেন, এমনকি সেটা খেলনা হলেও।
জাতিসংঘের যে সংস্থা আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের মূলনীতি ও কৌশল নির্ধারণ করে, তার নাম আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা বা আইসিএও। খেলনা বন্দুক আছে এই সংস্থার বিপজ্জনক বস্তুর তালিকাতেও।
তবে দেশ ও এয়ারলাইনসভেদে খেলনা বন্দুক বহন করার আইন ভিন্ন হতে পারে। কোনো কোনো দেশ বা বিমান সংস্থা শর্ত সাপেক্ষে খেলনা বন্দুক বহন করতে দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন নিরাপত্তা প্রশাসনের (টিএসএ) নিয়ম অনুযায়ী, পানিশূন্য কিংবা ১০০ মিলিলিটারের কম পানিযুক্ত ওয়াটারগান হ্যান্ড বা কেবিন লাগেজে নেওয়া যেতে পারে। তবে সত্যিকারের অস্ত্রের মতো দেখতে কিংবা সত্যিকারের অস্ত্রের মতো শব্দ করে এমন খেলনা শুধু চেক-ইন ব্যাগে নেওয়া যাবে। অন্যদিকে, হ্যান্ড গ্রেনেড বা যেকোনো ধরনের বিস্ফোরকের মতো দেখতে খেলনা হ্যান্ড বা চেক-ইন কোনো লাগেজেই বহন করা যাবে না।
সুতরাং বিমানযাত্রায় খেলনা অস্ত্র বহন করতে হলে তা চেক-ইন লাগেজে নেওয়া যেতে পারে। ঝামেলা এড়াতে নিজের সঙ্গে এবং হ্যান্ড বা কেবিন লাগেজে এসব না নেওয়াই ভালো। তবে চেক-ইন লাগেজ কিংবা হ্যান্ড লাগেজ যেখানেই নেওয়া হোক না কেন, নিরাপত্তার প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময় খেলনা অস্ত্র অপসারণ করতে পারে, এমনটা মাথায় রেখেই নিতে হবে।