বইয়ের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার
গত চার-পাঁচ বছরে পৃথিবীটা বদলে গেছে অনেকখানি। প্রযুক্তিজগতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বইও তো একধরনের প্রযুক্তি। এককালে প্যাপিরাস বা স্ক্রোলে লেখা হতো, আজ তা হচ্ছে না। লেখা হচ্ছে কাগজে। পাশাপাশি কিন্ডেলের মতো ই-রিডার এসেছে, আছে অডিও বুক।
এই সবই বর্তমান। বইয়ের ভবিষ্যৎ তবে কী? একটু পিছিয়ে এসে, বড় পরিসরে প্রশ্নটা করা যায় এভাবে: পাঠ বা পড়ার ভবিষ্যৎটা কেমন হতে যাচ্ছে? এই লেখায় আমরা এ রকম কিছু সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করব। এর কিছু কিছু শুধু বাস্তব নয়, হয়ে যাবে আগামী কবছরেই। আবার কিছু কিছু ধারণা হয়তো তোমার মনে হবে, একদম আজব! তাই বলে সেটাকে উড়িয়ে দিয়ো না। এক-আধটু পাগলামো ভাবনা না ভাবলে কেমন করে হবে, বলো?
শুরুটা আমরা ডিজিটাল বই থেকে করি। এককালে ডিজিটাল বইয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধরনটি ছিল পিডিএফ। বিশ্বে এই পিডিএফ–বিপ্লব এসেছিল প্রজেক্ট গুটেনবার্গের হাত ধরে। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মিখায়েল হার্ট ১৯৭১ সালে এটি শুরু করেছিলেন। বিপুল পরিমাণ বইয়ের পিডিএফ বানিয়ে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন সবার জন্য। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও ২০০০-২০২০ পর্যন্ত পিডিএফের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। ওদিকে বিশ্ববাজারে ২০০৭ সালের ১৩ নভেম্বর যাত্রা করে অ্যামাজনের কিন্ডল ই-রিডার। শুধু বই পড়ার জন্য আলাদা যন্ত্র হতে পারে, এ কথা আগে ভাবেনি কেউই। সেই কিন্ডল এখন আরও উন্নত। শুরুর কিন্ডলগুলোতে আলো ছিল না; অর্থাৎ যন্ত্র, কিন্তু একদম বইয়ের মতো—পড়তে হলে সূর্যের আলো বা ঘরের বাতি জ্বালিয়ে পড়তে হতো। আজ কিন্ডলের ভেতরে বাতি আছে, আলাদা করে আলো জ্বালাতে হয় না। এর পেপারহোয়াইট সংস্করণ অনেক জনপ্রিয় আজ বিশ্বজুড়ে। কিন্ডলের পথচলার শুরুতে এজিডব্লিউ নামের একধরনের বিশেষ ফরম্যাটের বই-ই শুধু পড়া যেত এতে। কিন্তু এখন এতে ই-পাব পড়া যায়। গোটা বিশ্বই পিডিএফকে পেছনে ফেলে ই-পাব নামের নতুন ধরনের বইয়ে মেতে উঠেছে। এর বিশেষত্ব হলো ফন্ট ছোট-বড় করা যায়, রং বদলে নেওয়া যায়, এক ক্লিকে ছবি বড় করে দেখা যায় পুরো স্ক্রিনে। স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ–কম্পিউটারেও পড়া যাবে এ ফরম্যাটের বই। এখন আবার অ্যান্ড্রয়েডনির্ভর বেশ কিছু ই-রিডার এসেছে। এর মধ্যে কোবো, বুক্স বেশ জনপ্রিয়। এগুলোর দামও বেশি নয়—২০ হাজার টাকার আশপাশে (যাদের মনে হচ্ছে অনেক, তারা স্মার্টফোনের কথা ভাবতে পারো)।
ওদিকে অডিও বুকের বিশেষত্ব হলো, বইয়ের গল্পটা কেউ পড়ে শোনান। আবহ তৈরির জন্যও বিশেষ মনোযোগ দেন অনেকে। ইউটিউব, স্পটিফাইতে এ রকম অনেক অডিও বুক আছে। বাস বা ট্রেনে কোথাও যেতে যেতে অডিও বুক শুনতে শুনতে অনেকখানি জানা হয়ে যায়। এ কারণেই বিশ্বজুড়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এটি।
কিন্তু যাঁরা পড়তে পছন্দ করেন, ভাবতে চান, শব্দের কল্পরূপটা তৈরি করতে চান মাথায়—অডিও বুক হয়তো তাঁদের মন জোগাতে পারবে না। এ কথা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই যদিও, তবু স্ট্যাটিসটিকা, পিউ রিসার্চসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থার তথ্যে জানা যাচ্ছে, ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ এখনো ফিজিক্যাল বুক বা ছাপা বই পড়তে পছন্দ করেন। বিক্রির তথ্য তা-ই বলছে। দ্বিতীয় স্থানে আছে ই-বুক, বলা বাহুল্য। সেটা ২০-২৫ শতাংশের মতো। আর ১০-১৫ শতাংশ দখল করে আছে অডিও বুক।
এখন ই-বুক দিন দিন আরও আকর্ষণীয়, পড়তে সহজ এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ হয়ে উঠছে। ধরো, একটা উপন্যাস। এর পুরো টাইমলাইন, প্রতিটা চরিত্রের ব্যাপারে তথ্য দেখতে পারবে আলাদা—কেমন হবে সত্যিই এমনটা হলে? প্রশ্ন করতে পারো, কী রকম হবে সেসব বই? এ নিয়ে কাজ করেছে আইডিইও নামের বিখ্যাত এক ডিজাইন কোম্পানি। তাদের ধারণা প্রশংসিত হয়েছে পৃথিবীজুড়ে। বাস্তবায়নের চেষ্টাও শুরু হয়েছে।
এ রকম একটি ধারণা বা কনসেপ্টের নাম নেলসন কনসেপ্ট। ই-রিডারের ডিজাইনে তারা বাঁ পাশে সাইডবারের মতো একটি অংশ রেখেছে। ইতিহাস বা নন–ফিকশনের বই পড়ার সময় কোনো শব্দে ক্লিক করে তথ্যটি ঠিক আছে কি না (ফ্যাক্ট চেক) বা এ নিয়ে অন্তর্জালে কী কী ধরনের ভিন্নমত বা বিতর্ক আছে, তা দেখতে পারবেন পাঠক। আরও বিস্তারিত পড়তে পারবেন বিভিন্ন সূত্র থেকে।
আরেকটি ধারণার নাম কোপল্যান্ড কনসেপ্ট। অনেকে মিলে একসঙ্গে বই পড়া এবং এ বিষয়ে শেয়ার করার সুযোগ করে দেবে এটি পাঠককে। তোমার স্কুল-কলেজের কিংবা বন্ধুদের কে কোন বইটি পড়ছে, সেটা যেমন দেখতে পারবে, সবাই মিলে শেয়ার্ড বুকসার্ভারও গড়ে তুলতে পারবে চাইলে। তখন দলের একজন বইটি কিনলে বাকিদের আর কিনতে হবে না। ঠিক যেমন ছাপা বই ধার করে পড়ে বন্ধুরা বা ভালো লাগলে অন্যদের পড়তে বলে, সে রকম।
অ্যালিস কনসেপ্ট নামের একটি ধারণায় আইডিইও দেখিয়েছে, পুরো বইয়ের জন্য চাইলে একটা টাইমলাইন বা ঘটনার সময়কাল তৈরি করা যায়। ই-বইয়ের নির্দিষ্ট বাটনে ক্লিক করে এই সময়কাল দেখা যাবে। নন-লিনিয়ার বা সরলরৈখিক নয়, এমন বর্ণনা পড়ে বুঝতে না পারলে পাঠক দেখতে পারবেন এই সময়কাল। ফিকশনে এটি বেশ কাজে লাগবে। পাশাপাশি বইয়ের বিভিন্ন চরিত্রের ইতিহাস, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি জানতে পারবেন পাঠক। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় ছবি বা ভিডিওর সূত্র, বইয়ের টিজার, শব্দের ব্যাখ্যা ইত্যাদি তো রয়েছে এখনই।
এগুলোকে বলা যায় সাম্প্রতিক ভবিষ্যতের বই বা পাঠ। কিন্তু দূর ভবিষ্যতে পাঠ কেমন হতে পারে? সেটাই কষ্টকল্পনা। আজব বলতে পারো বটে, তবে এ জন্য খুব বেশি দূরে তাকাতে হয় না।
যারা ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তির হালচাল নিয়মিত ঘেঁটে দেখে, তারা নিশ্চয়ই বিষয়গুলো আমার চেয়ে ভালো জানে। জানে, মেটা বা অ্যাপলের এখন অগমেন্টেড রিয়েলিটিনির্ভর চশমা আছে। অ্যাপলেরটা হয়তো অ্যাপলপ্রেমী সবাই চেনেও ভালোভাবে—অ্যাপল ভিশন প্রো। আয়রনম্যানের চশমায় যেমন লেখা ভাসতে থাকে, তেমনি যদি ভেসে যায় বইয়ের লেখা, কেমন হবে? কিংবা ধরো, ইলন মাস্কের নিউরালিংক নামের যে চিপ গেল বছর; অর্থাৎ ২০২৪ সালে শারীরিক প্রতিবন্ধী একজনের মস্তিষ্কে বসানো হয়েছে, যার সাহায্যে তিনি শুধু চিন্তা করেই কম্পিউটারের মাউস নাড়াতে পারছেন, তার ব্যবহার যদি বইয়ে হয় কিংবা এর সঙ্গে যদি জুড়ে যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তাহলে হয়তো পুরো বদলে যাবে বইয়ের ধারণা।
এসব যে বাস্তবে হতে পারে, তা এখন শুনে বড়রা হয়তো বলতে পারেন পাগলামি। আসলে যে তা নয়, সে কথা তোমাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে?