ভোর হতে না হতে পাখি কিচিরমিচির শুরু করে। আলো ফোটার আগেই পাখি গান গায়। আবার সন্ধ্যায় শোনা যায় একই শব্দ। সকাল-সন্ধ্যায় পাখিদের এই ডাকাডাকির সঙ্গে তুমি নিশ্চয়ই পরিচিত। কিন্তু পাখিদের এত ডাকাডাকির কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পাখিদের বিরক্ত করার দরকার নেই। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে পাখিদের এই আচরণের পেছনের কারণ খুঁজে বের করেছেন। চলো, জেনে আসি, ভোর হলেই পাখিরা কেন এত কিচিরমিচির করে। কেন আমাদের ঘুম ভাঙায়।
বিশ্বে প্রায় ১১ হাজারের বেশি প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। প্রতিটি প্রজাতির পাখির আকার, আয়তন, রং ও ডাকের ধ্বনি অন্যান্য প্রজাতি থেকে আলাদা। এই ভিন্নতার কারণে পাখিদের এত রূপ। ভোরে পাখির ডাকাডাকির পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ, পাখিরা ডাকের মাধ্যমে সঙ্গী খোঁজে, নিজের টেরিটরি ঘোষণা করে এবং গলা পরিষ্কার করে। ডাকের মাধ্যমে এরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিজের এলাকায় কোনো খাবারের সন্ধান মিলেছে, কোনো বিপদ আসছে কিংবা কোন জায়গা নিরাপদ—এই তথ্য এরা ডাকের মাধ্যমে আদান-প্রদান করে। আবার পাখিরা নিজে ঘুম থেকে উঠে অন্যদের ডাকে, কারণ এখন আলো ফুটেছে, সবাই মিলে খাবারের সন্ধানে যেতে হবে।
অনেক পাখি এদের নিজস্ব এলাকা চিহ্নিত করার জন্য ডাকাডাকি করে। এভাবে এরা অন্য পাখিদের জানিয়ে দেয়, এই এলাকাটি আমাদের দখলে। বেশ কিছু পাখির প্রজাতি সামাজিক আচরণ দেখায়। এরা দল বেঁধে থাকে। একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য ডাকাডাকি করে। অর্থাৎ, কোনো বিপদ দেখলে পাখিরা অন্য পাখিদের সতর্ক করার জন্য ডাকাডাকি করে। এভাবে এরা পাখি সম্প্রদায়কে রক্ষা করে। প্রজননকালে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিদের আকৃষ্ট করতে নানা সুরে গান গায়। সব মিলিয়ে পাখিরা সকালে গান গেয়ে থাকে এদের প্রজনন, সামাজিকীকরণ এবং এলাকা চিহ্নিত করতে।
ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওর জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হারুকা ওয়াদা ২০১০ সালে পাখি ডাকাডাকি নিয়ে নেচার জার্নালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ঋতুভেদে পাখিরা সাধারণত ভোর ৪টা থেকে সকাল ৬টার মধ্যে এদের কিচিরমিচির শুরু করে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দিনের অন্য সময়ের তুলনায় এই সময়ে এদের গান আরও উচ্চ স্বরে এবং ঘন ঘন শোনা যায়। এই আওয়াজ শুধু চেঁচামেচি নয়, এদের গলায় মিশে থাকে উচ্ছ্বাস।
একটি পাখি সাধারণত ঘুম থেকে উঠলে প্রথম যে কাজটি করতে চায় তা হলো খাবার খাওয়া। কিন্তু ভোরবেলা অন্ধকার থাকায় শিকার করা কঠিন হয়। একসময় এটা মনে করা হতো, পাখিরা কাজ না থাকায় এই সময়টা কিচিরমিচির করে কাটায়। সত্য হলো, প্রাকৃতিক পরিবেশ সকালবেলায় অনেক শান্ত থাকে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর আনাগোনা বাড়লে এই শান্তি নষ্ট হয়। ফলে পাখির গান অন্যান্য শব্দের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে। তাই এরা সকালের শান্ত পরিবেশে ডেকে অন্য পাখিদের জন্য বার্তা পাঠায়। নিজেদের কণ্ঠ যেন অন্য পাখি স্পষ্টভাবে শুনতে পায়।
সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সবার আগে কাক, দোয়েল, শালিকের মতো পাখিরা গান গাওয়া শুরু করে। এর একটু পরে ফিঞ্চ, ওয়ারব্লার, কার্ডিনাল, চড়ুই ও তিতিরও এদের সঙ্গে যোগ দেয়। শহরবাসীকে এই আওয়াজ শুনতে পার্ক কিংবা গাছপালা আছে এসব জায়গায় যেতে হবে। সব পাখির ডাকাডাকি একসঙ্গে মিলে কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায়। সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার সময় পাখিরা শিকার শেষ করে বাসা বা যে গাছে রাত কাটায় সেখানে ফিরে আবার কিচিরমিচির শুরু করে। একইভাবে অন্য পাখিদের জানায়, আমরা আবার ফিরে এসেছি। তবে পরিবেশদূষণ, বন ধ্বংস, পাখি শিকার, শব্দদূষণ, কীটনাশকের ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। গাছ না কাটা, পাখির আশ্রয় ধ্বংস না করে পাখিদের রক্ষা করা সম্ভব।
সূত্র: উইকিহাউ, ওয়াইল্ড বার্ডস আনলিমিটেড