দাবানল ঠেকাবে ছাগল-ভেড়া

ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ দাবানলের কথা প্রায়ই খবরে উঠে আসে। প্রচণ্ড তাপমাত্রাযুক্ত স্থানে যখন বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন কোনো দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসে, তখন আপনা–আপনিই আগুন জ্বলে ওঠে সেখানে। আর সেখান থেকেই মূলত দাবানলের উৎপত্তি হয়। প্রচণ্ড আর্দ্র ও শুষ্ক স্থানে গাছপালা যখন পর্যাপ্ত পানি পায় না, তখন এগুলো আস্তে আস্তে দাহ্য পদার্থে পরিণত হয়। মূলত পাহাড়ি অঞ্চলগুলোয় দাবানল দেখা যায়। আমাদের দেশের সিলেট ও চট্টগ্রামেও পাহাড় আছে। তবে এসব স্থানের আর্দ্রতা খুব বেশি নয়, ফলে এসব অঞ্চলে দাবানল হয় না। কিন্তু ইউরোপ বা আমেরিকার আবহাওয়া কিন্তু এমন নয়। আমেরিকা, ইউরোপের বনাঞ্চলে প্রায় প্রতিবছরই আগুন লাগে। বিপুল ক্ষতি হয় পরিবেশের। অস্ট্রেলিয়ার ২০২০ সালের দাবানলের কথা মনে আছে তোমাদের? ভয়ংকর সেই দাবানলে হাজার হাজার হেক্টর বনসহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল কোয়ালা, ক্যাঙারুর মতো অনেক বন্য প্রাণী। দাবানলের ফলে পুড়ে যায় বন ও বনের মাটি, সেই পোড়ামাটি হারায় উর্বরতা।

এসব কারণে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর জন্য দাবানল এক দুঃস্বপ্নের নাম। প্রতিবার গ্রীষ্মকাল আসার আগে এসব জায়গার মানুষ নানান উদ্যোগ নেন দাবানল এড়াতে। কিন্তু স্পেনের বার্সেলোনার নগর কর্তৃপক্ষ দাবানল এড়ানোর জন্য অদ্ভুত এক উদ্যোগ নিয়েছে। দাবানল এড়ানোর জন্য তারা একটি পার্কে নিয়োগ দিয়েছে ছাগল ও ভেড়া! গত এপ্রিল মাস থেকে এই উদ্যোগ শুরু করা হয়েছে। পার্কটিতে ঢুকতেই দেখা যায় একটি অদ্ভুত দৃশ্য—শত শত ভেড়া ও ছাগল মনের সুখে ঘাসপাতা খেয়ে যাচ্ছে এবং তাদের পাহারা দিচ্ছেন একজন রাখাল। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, এটি বোধ হয় কোনো চারণভূমি, কিন্তু আদতে তা নয়।

বার্সেলোনা শহরের সবচেয়ে বড় পার্ক কলসেরোলা জাতীয় উদ্যান। ৮ হাজার ২০০ হেক্টরের এই পার্ক আমেরিকার নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কের প্রায় ২২ গুণ এবং প্যারিসের বইস দে বোলোউনে পার্কের তুলনায় ৮ গুণ বড়। বিশাল এই উদ্যানে বার্সেলোনা নগর কর্তৃপক্ষ সচেতনভাবেই বনায়ন করেছে। প্রতিবছরই নিজের মতো বাড়তে থাকে এখানকার ঝোপঝাড় ও গাছপালা। কিন্তু গ্রীষ্মকাল এলে এই অতিরিক্ত গাছপালা থেকেই দাবানল সৃষ্টির জোর আশঙ্কা দেখা দেয়। যেসব গাছ বা ঝোপ থেকে দাবানলের উৎপত্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, প্রাকৃতিক উপায়ে সেগুলো কমিয়ে ফেলারজন্যই এই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

প্রায় ২৯০টি ভেড়া ও ছাগলের এই পালের দেখভাল করেন ড্যানিয়েল সানচেজ নামের ৩৬ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি। রাতটাও উদ্যানের একটি ঘরেই কাটান তিনি। আগে তিনি ছিলেন একজন লাইটিং টেকনিশিয়ান, সে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন শুধু প্রকৃতির মাঝে সময় কাটাবেন বলে।

উদ্যানটিতে এমন কার্যক্রম চললেও এটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত। ব্যায়াম করতে বা সাইকেল চালাতে প্রতিদিন প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে এখানে। এমনই একজন ৫২ বছর বয়সী সার্গি ডমিনিগুয়েজ। নিজের পোষা কুকুর নিয়ে উদ্যানে হাঁটতে এসেছেন তিনি। কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রায় প্রতিবছরই এখান থেকে দাবানলের সৃষ্টি হয়। তাই এটি বেশ বিপজ্জনক জায়গা। এই ছাগল ও ভেড়া মিলে শুকনা ঘাস ও ডালপালা খেয়ে ফেলে, যেগুলো দাহ্য পদার্থ। এর থেকে ভালো আর কিছুই হয় না। আশা করি, ওরা আগামী বছর আবার আসবে।’

উদ্যানটি থেকে দাবানল ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কতটা বেশি, সেটি তুলে ধরেন জীববিজ্ঞানী এবং প্রকল্পটির পরিচালক ফেরান পাউন, ‘ভূমধ্যসাগরীয় এ অঞ্চলে প্রচুর মানুষের বসবাস। ফলে মানুষ শহরের পাশাপাশি বনভূমির আশপাশেও বসবাস করে, যেখানে দাবানল ছড়িয়ে যাওয়ার অনেক বড় শঙ্কা থাকে। একবার দাবানল লাগলে এই বিশাল উদ্যান পুড়তে আট ঘণ্টাও লাগবে না। দাবানল যদি আশপাশে ছড়িয়ে যায়, তাহলে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা অবর্ণনীয়।’

এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্প চলবে পুরো জুন মাস পর্যন্ত। যদি দেখা যায় এর ফলে আসলেই দাবানল এড়ানো সম্ভব হয়েছে, তাহলে পরের বছর আবার এমন উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে বলে জানান তিনি।

তবে উদ্যানটি শহরের খুব কাছে হওয়ায় প্রচুর শব্দদূষণ এবং অতিরিক্ত আলোর কারণে ক্লান্তির কথা জানান সানচেজ। অত্যধিক আওয়াজের জন্য প্রাণীগুলো দেখভাল করা খুবই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান এই প্রকৃতিপ্রেমী, ‘হঠাৎ মনে হয়, কোনো ভেড়া হয়তো বিপদে পড়ে ডাকাডাকি করছে, কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি, সেটা কোনো অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। অনেক সময় হেলিকপ্টারের আওয়াজের জন্য ওদের ডাকও শুনতে পারি না।’

এমন কিছু সমস্যা থাকলেও, দাবানল থেকে বাঁচার জন্য বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষের এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ কিন্তু আসলেই চমৎকার।