‘ফটো তোলার ঝোঁক ছিল আগে থেকেই। একটা কম দামি ক্যামেরা ছিল, লুবিডর ক্যামেরা; ওটা দিয়েই ফটো তুলতাম। পরে টাকা জমিয়ে ৫০০ টাকায় ইয়াসিকা সিক্স-থার্টিফাইভ ক্যামেরা করাচি থেকে আনাই পোস্টালের মাধ্যমে। ওই ক্যামেরাই ব্যবহার করেছি একাত্তরে।
ফটোগ্রাফি শিখেছি নিজে নিজে। স্টুডিওতে গিয়ে দেখতাম, কীভাবে ওরা এনলার্জ করে। তখন কৌতূহলও বেড়ে যায়। লেদ মেশিনে নিজের মতো যন্ত্রাংশ তৈরি করি। করাচি থেকে ১৫০ টাকায় আনাই একটা লেন্সও। রেলগেটের লাইটে যে কাচ লাগানো থাকে, ও রকম দুটো কাচও জোগাড় করি। এগুলো দিয়েই বানাই এনলার্জ। তখন চাকরি করতাম কুতুবউদ্দিন অ্যান্ড সন্স টোব্যাকোতে। অফিসের ভেতর একটা রুমকে স্টুডিও বানিয়ে ফেললাম। এভাবেই ফটোগ্রাফির আগ্রহটা জীবন্ত রাখি।
বঙ্গবন্ধু তখন বাঙালির প্রাণের নেতা। কুষ্টিয়ায় এলে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি পোর্ট্রেট ও জনসভার ছবি ক্যামেরাবন্দী করেছিলাম। ওই ছবিগুলোই আজ কথা বলছে। একাত্তরের আন্দোলন, প্রতিবাদ, আত্মত্যাগ ও বীরত্বের ইতিহাসটাও ছবির মাধ্যমেই জীবন্ত হয়ে আছে।’
একাত্তর প্রসঙ্গে এভাবেই কথা বলেন যুদ্ধ-আলোকচিত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ রায়হান।
চয়েন উদ্দিন ও জোবেদা খাতুনের বড় সন্তান হামিদ রায়হান। বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের ৫২ মসজিদ বাড়ি লেনে (বর্তমানে সেটি ১১ নম্বর খলিলুর রহমান সড়ক)।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই কুষ্টিয়া উত্তপ্ত হতে থাকে। ২৩ মার্চ ইসলামিয়া কলেজ মাঠে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে শোডাউন করে ছাত্র-মজুর-জনতা। ২৫ মার্চ কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে ছাত্রনেতারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গোলাম কিবরিয়া, আবদুর রউফ চৌধুরী, নূরে আলম জিকো প্রমুখ। ওই দিন সাধারণ মানুষ ও ছাত্ররা লাঠিসোঁটা, তির-ধনুক, দা ও ডামি রাইফেল নিয়ে সমাবেশও করে। ওই আন্দোলনে হামিদ রায়হান নিজে শুধু যুক্তই থাকেননি, বরং ক্যামেরায় ছবিও তুলে রেখেছেন।
২৫ মার্চের পর সারা দেশে গণহত্যা শুরু হলে হামিদ রায়হান পরিবারসহ চলে যান ভারতের করিমপুরে। সেখানে রিক্রুটিং ক্যাম্পে যুবকদের সংগঠিত ও খাওয়ানোর ব্যবস্থা করাসহ মাস্টাররোল তৈরির কাজ করেন বেশ কিছুদিন। পরবর্তীকালে যুক্ত হন বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের সঙ্গে।
কীভাবে
তাঁর ভাষায়, ‘ওরা ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে শরণার্থী ক্যাম্পের যুবক-যুবতীদের সংগঠিত করে লেফট-রাইট করানোসহ নানা কাজে যুক্ত রাখত, যাতে তারা বিপথগামী হয়ে না যায়। ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের উদ্যোক্তা ছিলেন আমার বাল্যবন্ধু ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। লন্ডনের ওয়ার অন ওয়ান্ট তাঁদের ফান্ড দিত। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ ছিলেন ওয়ার অন ওয়ান্টের চেয়ারম্যান।
ব্যারিস্টারের (আমীর-উল ইসলাম) মাধ্যমেই ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের ফটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ পাই। বেতন ছিল ৪০০ টাকা। এরপরই ক্যামেরাবন্দী করা শুরু করি যুদ্ধদিনের নানা অধ্যায় ও ঘটনাপ্রবাহ।’
বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের দল যখন যে জায়গায় যেত, তাদের সঙ্গেই যেতে হতো হামিদ রায়হানকে। বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়েও ছবি তুলতেন তিনি। পাটগ্রামের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করতে এসেছিলেন ওয়ার অন ওয়ান্টের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ। ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর ডোনাল্ড চেসওয়ার্থসহ পাটগ্রামের কোর্ট-কাচারি, হাসপাতাল ও বিভিন্ন জায়গায় ছবি তোলেন হামিদ রায়হান। এ ছাড়া তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প, শরণার্থী ক্যাম্প ও মুক্তাঞ্চলগুলোয়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ধ্বংস করা ব্রিজ, কালভার্ট ও ভবনের ছবিও উঠে এসেছে তাঁর ক্যামেরায়, যা স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শিকারপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ছবি, ১১ ডিসেম্বর যশোরের পিকনিক কর্নার এলাকায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ফেলে যাওয়া তাজা রকেট বোমার পাশে দুই শিশুর ছবি, ঝিকরগাছায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজ, ২২ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়া রাজাকারের ছবিও ক্যামেরাবন্দী করেন এ আলোকচিত্রী।
পাকিস্তানি সেনাদের বেয়নেটের টর্চারে আহত এক মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিএসবি হাসপাতালে চিকিত্সা দেওয়ার ছবি, ৬ ডিসেম্বর ভারতের স্বীকৃতির দিন কলকাতায় একটি মিছিলে প্ল্যাকার্ড হাতে ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কবি নির্মলেন্দু গুণের ছবিও উঠে আসে তাঁর ক্যামেরায়। এই ছবিগুলোই ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। একাত্তরে হামিদ রায়হানের তোলা ছবিগুলো বিশ্ব গণমাধ্যমে পাঠানো হতো। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
যুদ্ধদিনের কয়েকটি ঘটনার কথাও তুলে ধরে আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হান বলেন, ‘খুব কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। অভুক্ত অবস্থায় মানুষ আসছে দেশ থেকে। তিন-চার দিন পর খাবার পেল। আবার কলেরা শুরু হয়ে গেল। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোয় চোখের একটা অসুখ দেখা দেয় তখন। চোখের ওই রোগ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল সব ক্যাম্পে। ফলে পশ্চিম বাংলার লোকেরা ওই রোগের নাম দেয় “জয় বাংলা রোগ”। এক শরণার্থী ক্যাম্পে দেখেছি, মা মরে গেছে, বাচ্চা গিয়ে তার দুধ খাচ্ছে। এই ছবিটা তুলতে না পারায় আজও খুব আফসোস হয়।’
হামিদ রায়হান আরও বলেন, ‘একাত্তরে ভারতীয় জনগণের সহযোগিতার কথা না বললেই নয়। ভারতীয়রা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে স্কুলগুলো দেয় শরণার্থীদের থাকার জন্য। সাড়ে সাত কোটির ভেতর এক কোটি লোককেই তারা জায়গা দিয়েছে। ওই সময়ের শরণার্থী ক্যাম্পগুলো না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন না, একাত্তরে কী হয়েছিল! ছবি তুলেছি বর্ডার এলাকার অ্যাকশন ক্যাম্পগুলোতেও। আমার ক্যামেরায় তুলে আনি একাত্তরের ৫৪০টির মতো ছবি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে ২৯২টি, দৃককে ১০০টি ও সামরিক জাদুঘর বিজয় কেতনকে দিয়েছি আরও বেশ কিছু ছবি।’
স্বাধীনতা লাভের পর কুষ্টিয়া শহরে রূপান্তর নামে একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হান। পরিসর ছোট হলেও এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার এক জীবন্ত মিউজিয়াম।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখনো আবদুল হামিদ রায়হানকে মুক্তিযুদ্ধ-আলোকচিত্রী হিসেবে কোনো স্বীকৃতি বা পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। এ নিয়ে কোনো আফসোসও নেই তাঁর। শুধু বলেন, ‘কর্তব্য ছিল, করেছি। দেশটা তো স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো প্রজন্ম দেখুক। ভাবুক তারা, কত কষ্টে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি!’