তুরস্কের হাতায় প্রদেশের আনতাকিয়া শহরের বাসিন্দা এরদেম আভসারোগলু। ভূমিকম্পে তিনি বেঁচে গেলেও ভবন ধসে যাওয়ায় আটকা পড়েন তাঁর বোন, বোনের স্বামী ও এই দম্পতির দুই শিশুসন্তান। ভূমিকম্পের পর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েও বেঁচে ছিলেন তাঁরা। বিপর্যয়ের পরপরই যাঁরা উদ্ধারকাজে নেমেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগও করছিলেন। তবে চাপা পড়ার এক দিন না পেরোতেই ওই ভবনে আগুন লাগে। ফলে তাঁদের জীবিত উদ্ধারের আশাটুকুও মিইয়ে যায়।
৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে তুরস্ক ও সিরিয়ায়। এতে হাজারো মানুষ ভবনের নিচে চাপা পড়েন। এরদেমের মতো অনেকেই তাঁদের স্বজনদের ফিরে পেতে অপেক্ষা করেছেন। চাপা পড়া অনেকেই যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু তাঁদের সবাইকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাকে এরদেম বলেছিলেন, ‘এখন আমাদের চাওয়াটা হলো, যেন মরদেহগুলো অক্ষত অবস্থায় পাই। তবে তেমন কিছুই খুঁজে পাইনি। মনে হয় সবাই আগুনে পুড়ে গেছে।’
ভূমিকম্পের পর সিরিয়া ও তুরস্কের রাস্তায় স্বজনহারাদের আহাজারি চলছে ৬ ফেব্রুয়ারি থেকেই। এই ভূমিকম্প অনেককে নির্বাক করে দিয়েছে। যেমন তুরস্কের কাহরামানমারাস শহরের মেসুত হানসারের কথাই বলা যেতে পারে। তাঁর একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েছিল মেসুতের ১৫ বছরের মেয়ে ইরমাক। খোঁজাখুঁজির পর মেয়ের হাতের সন্ধান পেয়েছিলেন মেসুত। মৃত মেয়ের সেই হাত ধরে বসে ছিলেন মেসুত। অসহায় মেসুতের যে আর কিছু করার ছিল না।
মেসুতের করুণ পরিস্থিতি প্রতীকী চিত্র হয়ে উঠেছিল তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত মানুষদের জন্য। তাঁরা স্বজনের মৃত্যু দেখেছেন। কিন্তু কিছু করতে পারেননি। এমনকি অনেকে স্বজনের লাশ পচতেও দেখেছেন।
মানুষ মরে গেলে পচে যায়। কিন্তু সেই পচা মানুষের গন্ধ কেমন হয়? আমরা হয়তো বেশির ভাগই সেটা অনুধাবন করতে পারব না। তবে তুরস্ক ও সিরিয়ার মানুষেরা ভূমিকম্পের পর বুঝতে পেরেছেন।
১৮ ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুসারে, এই ভূমিকম্পে ৪৬ হাজারের বেশি মানুষের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সরকারের দেওয়া হিসাব অনুসারে তুরস্কে ৪০ হাজারের বেশি এবং সিরিয়ায় প্রায় ৬ হাজার মানুষ মারা গেছেন। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি।
ভূমিকম্পে তুরস্কের ১০টি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রদেশগুলো হলো কাহরামানমারাস, আদানা, আদিয়ামান, ওসমানিয়ে, হাতায়, কিলিস, মালাতিয়া, সানলিউরফা, দিয়ারবাকির ও গাজিয়ানতেপ। ভূমিকম্পের পর সিরিয়ায় চারটি প্রদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চারটি প্রদেশ হলো আলেপ্পো, হামা, ইদলিব ও লাতাকিয়া। তুরস্কের আদানা থেকে দিয়ারবাকির পর্যন্ত ৪৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর সিরিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ভূমিকম্পে দুই দেশের আড়াই কোটির বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই ভূমিকম্প কতটা শক্তিশালী তার জন্য আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় জানিয়েছেন, দেশটিতে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সংখ্যা এক লাখের বেশি। তুরস্কের ব্যবসায়ীদের সংগঠন এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড বিজনেস কনফেডারেশন জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কারণে তুরস্কের মোট ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। সেখানকার শুধু ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণেই খরচ হবে ৭ হাজার কোটি ডলার। সিরিয়ায় এই ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি।
ভূমিকম্পটা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এই ভূমিকম্পের পর ১০০ বারের বেশি পরাঘাত (আফটার শক) অনুভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্য অনুসারে, রিখটার স্কেলে এগুলোরও মাত্রা ছিল কমপক্ষে ৪। তুরস্কের কাহরামানমারাস ছিল এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। কিন্তু এই ভূকম্পন অনুভূত হয় সেখান থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত। তুরস্ক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা ছাড়া সাইপ্রাস, লেবানন ও ইরাক পর্যন্ত এ ভূকম্পন অনুভূত হয়।
সত্যি বলতে, এসব সংখ্যা দিয়ে সেখানকার ভয়াবহ পরিস্থিতি বোঝানোটা বেশ কঠিন। প্রথম কারণ হলো, ঠিক কত হাজার মানুষ মারা গেছেন, সে সংখ্যা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। উদ্ধারকাজ চালানোই সম্ভব হয়নি অনেক ভবনে। ঠিক কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সে সংখ্যা কেউ জানেন না। এমন একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর সাধারণত কয়েক মাস সময় লেগে যায় এই সংখ্যা জানতে। দ্বিতীয় কারণ, এই অঞ্চলের প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ব্যক্তি পর্যায়ের ক্ষতি কত, তা জানাটা প্রায় অসম্ভব। ফলে পরিসংখ্যান দিয়ে ক্ষতির পরিমাণ পরিমাপ করা বেশ কঠিন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আসলে সেখানকার পরিস্থিতি কী? এটা জানতে সেখানকার আবহাওয়া এখন কেমন, সেটা জানা দরকার।
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত দুই দেশের এই সীমান্তবর্তী এলাকায় এখন প্রচণ্ড শীত পড়ছে। কোথাও কোথাও তুষারও পড়ছে। রাতে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি, কখনো বা থাকছে শূন্যের কম। আবার বৃষ্টিও হয়। এমন পরিস্থিতিতে একেবারে জরুরি কাজ ছাড়া কারও বাইরে থাকার কথা নয়। ঠিক তা–ই। ৬ ফেব্রুয়ারি এই অঞ্চলের মানুষেরা যখন ঘুমিয়েছিল, ঠিক তখনই ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকেই ভবনের নিচে চাপা পড়েছেন। মারা গেছেন মুহূর্তেই। এমন অনেকেরই লাশ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ভূমিকম্পের পরপরই দ্রুত উদ্ধারকাজ চালানো দরকার ছিল, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ভূমিকম্পের ফলে সেখানকার রাস্তাঘাটে ধসে যায়, অনেক এলাকা হয়ে পড়ে বিদ্যুৎহীন। দেখা দেয় জ্বালানিসংকট। এতে করে অন্য এলাকাগুলো থেকে উদ্ধারকাজ চালাতে আসা সহজ ছিল না। আবার উদ্ধারকাজের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি দরকার ছিল। সেগুলো নেওয়াও কঠিন ছিল। ভূমিকম্পের এক দিন পর সেখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরে তুরস্কের বেসরকারি উদ্ধারকারী সংস্থা একেইউটির সমন্বয়কারী মুরাত হারুন অনগোরেন বলেছিলেন, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল অংশজুড়ে ধ্বংসলীলা চলেছে, রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ, তারপর আবার আবহাওয়া এত ঠান্ডা যে জমে যাওয়ার মতো। উদ্ধারকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছাতে সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে।
এত গেল উদ্ধার তৎপরতা। যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের অবস্থা? যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গার্ডিয়ান–এর ভিডিওতে দেখা যায়, এলাকার পর এলাকার ভবন সব ধসে গেছে। অর্থাৎ মানুষের আশ্রয় নেওয়ার মতো জায়গা ছিল না। এই শীতের মধ্যে লাখ লাখ মানুষকে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হয়েছে। এক কিংবা দুই দিন নয়। খাবার নেই, পানি নেই—দিনের পর দিন এই অবস্থার মধ্যে থাকতে হয়েছে।
রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ করে তা ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়। ৩ থেকে ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে ‘মাইনর’; ৪ থেকে ৪ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে হালকা (লাইট); ৫ থেকে ৫ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে মধ্যমানের (মডারেট); ৬ থেকে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে শক্তিশালী (স্ট্রং); ৭ থেকে ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে বড় (মেজর); ৮ থেকে এর অধিক মাত্রার ভূমিকম্পকে ভয়াবহ ভূমিকম্প বলে আখ্যা দেওয়া হয়। তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পটি ছিল ‘বড়’ ভূমিকম্প। বিগত ১০ বছরের এমন ‘বড়’ ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে ৫টি। এর মধ্যে ২০২১ সালে হাইতিতে ৭ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছিল এক হাজারের বেশি মানুষ। ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় চার হাজারের বেশি মানুষ। ইকুয়েডরে ২০১৬ সালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৬৫০ মানুষ নিহত হয়। ২০১৫ সালে নেপাল ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৯ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আর ২০১৩ সালে পাকিস্তানে প্রায় একই সঙ্গে ৭ দশমিক ৭ ও ৬ দশমিক ৮ মাত্রার দুটি ভূমিকম্পে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তান প্রদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে কমপক্ষে ৮২৫ জন নিহত হয়।
যেখানে মানুষ অসহায়
তুরস্কের আদিয়ামান শহরের বাসিন্দা আলী উনলু। ৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে ভূমিকম্পের পরপরই মায়ের বাসার দিকে ছুটেছিলেন তিনি। গিয়ে দেখতে পান, বাসাটি ধসে পড়েছে। আর তাঁর মা নিচে চাপা পড়েছেন। ঘটনার পর উদ্ধারকারীদের জন্য অপেক্ষা করেন উনলু। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না দেখে নিজেরাই উদ্ধারকাজে নামেন। এক আত্মীয়কে উদ্ধারও করেন। তবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে মাকে বের করতে পারেননি।
আবার স্বজন মারা গেছেন জেনেও অনেকে অপেক্ষা করেছেন। এমন একজন সোনের জামির। মা-বাবাকে হারিয়েছেন তিনি। তারপরও ভূমিকম্পের পর বাড়ির বাইরে ছয় দিন অপেক্ষা করেছেন তিনি। বলেন, ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পরও ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে কয়েকজনকে বের করে আনা হয়েছে। তবে এখন আর কোনো আশা নেই।
পরিস্থিতি আসলে এমনই। দুর্যোগের কাছে মানুষ যে এখনো অসহায়, তা আবারও দেখা গেল তুরস্ক ও সিরিয়ায়। ভূমিকম্পের পরপরই ক্ষয়ক্ষতির একটি মডেল দাঁড় করান যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের বিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন সময়ের বড় ভূমিকম্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক মডেল তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য সেখানকার কত মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানকার অবকাঠামো—এমন নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে মডেলে বলা হয়, তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার থেকে ১০ হাজারের মধ্যে থাকার আশঙ্কা ৪৭ শতাংশ। মৃত্যুর সংখ্যা ১০ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে থাকার আশঙ্কা ২০ শতাংশ। দ্বিতীয়টাই সত্য হতে চলেছে।
ভূমিকম্পের পর তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর অভিযোগ ছিল, যেভাবে উদ্ধারকাজ চলছে, তা যথেষ্ট নয় এবং যা ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, তা যথেষ্ট নয়। এ নিয়ে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেন আনতাকিয়া শহরের বাসিন্দা মেলেক। তিনি বলেন, ‘কোথায় তাঁবু, কোথায় খাবার? আমরা ভূমিকম্পের পরও বেঁচে গেছি। কিন্তু আমরা হয়তো ঠান্ডায় ও খাবার না পেয়ে মারা যাব।’
ঘটনার পাঁচ দিন পর সত্যটা স্বীকার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির আর্থকোয়েক রেসপন্স ইনসিডেন্ট ম্যানেজার রবার্ট হোলডেন বলেন, সহায়তার হাত বাড়ানো না গেলে ভূমিকম্পে যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যেতে পারে।
সিরিয়ার পরিস্থিতি আরও খারাপ
দেরিতে হলেও তুরস্কে মানুষ সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু সিরিয়ার পরিস্থিতি আরও খারাপ। সেখানে প্রথম ত্রাণ পৌঁছায় ঘটনার চার দিন পর। সেখানকার পরিস্থিতি এমন কেন, সেটা আগে জানা দরকার।
সিরিয়ার প্রায় ১২ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। সেখানকার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে মানেন না, এমন অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। তারা ছোটখাটো সংগঠন নয়। এদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অনেক এলাকা। হতাশার বিষয় হলো, এবারের ভূমিকম্পে যেসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর একটি বড় অংশ বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে বাশার আল-আসাদ সরকার সেখানে সাহায্য পাঠাচ্ছে না। আবার এসব অঞ্চল যে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, তা–ও নয়। ফলে সেখানকার মানুষেরা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল। জাতিসংঘের ত্রাণের ওপর নির্ভর করে সেখানকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ জীবন ধারণ করে।
এই ৫০ লাখ মানুষের সাহায্য প্রয়োজন, সেটা ভূমিকম্পের আগের চিত্র। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক কোটির বেশি মানুষ। বর্তমানে তাদের সবারই সাহায্য প্রয়োজন।
আর জটিলতা এখানেই। চাইলেই কেউ সিরিয়ার মূল ভূখণ্ড হয়ে এসব এলাকায় ঢুকতে পারেন না। আবার এসব এলাকার সীমান্ত তুরস্কের সঙ্গে। নিরাপত্তার কারণে তুরস্কও এসব এলাকার সীমান্ত বন্ধ রাখে। ফলে অনেকটা বন্দীদের মতো জীবন যাপন করে সেখানকার মানুষেরা। এবারও সেখানে ত্রাণ পাঠানোর জন্য সিরিয়া ও তুরস্ক সরকার এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছে, এরপর ত্রাণ পাঠানো গেছে।
আবার ত্রাণ বিতরণ নিয়েও জটিলতা রয়েছে। কেউ চাইলেই স্বাধীনভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে পারেন না। বিদ্রোহীরা চান, ত্রাণ তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হোক। সেই ত্রাণ তাঁরা বিতরণ করবেন। কিন্তু এতে আবার আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো রাজি নয়। এবারও এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার পর ফিরে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীরা।
এর ফলে কী হয়, সেটা শোনা যাক সিরিয়ার আলেপ্পোর বাসিন্দা ইউসেফের কাছ থেকে। সড়কে স্বজনদের জন্য দুই দিন অপেক্ষা করেছেন ইউসেফ। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের পর ধসে যাওয়া ভবনে তাঁর মা-বাবার কথা তিনি শুনেছেন। তবে তাঁদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
ইউসেফ বলেন, ‘আমি উদ্ধারকারীদের বলেছি, স্বজনদের গলা আমি শুনতে পেয়েছি। কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন, উদ্ধারকাজ ধীরগতিতে চলছে। তাঁদের (উদ্ধারকর্মী) কাছে যথেষ্টসংখ্যক যন্ত্রপাতি নেই।’
আলেপ্পো প্রদেশের জানদারিস শহরের বাসিন্দা ইব্রাহিম খলিল। তিনি বলেন, পরিবারের সাত সদস্যকে হারিয়েছেন তিনি। তাঁদের মধ্যে তাঁর স্ত্রী ও দুই ভাইও রয়েছেন। মরদেহ নেওয়ার জন্য একটি ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করেছেন তিনি। সেই ব্যাগ দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘উদ্ধারকারীরা আমার স্বজনদের মরদেহ বের করে আনবে, এই অপেক্ষায় আছি। অবস্থা খুবই খারাপ। কোনো ত্রাণ বা সাহায্য এখানে পাওয়া যাচ্ছে না।’
সিরিয়ার আলেপ্পোর জানদারিসের বাসিন্দা রুকাইয়া মোহাম্মদ মুস্তাফার অভিজ্ঞতাও এমন। তিনি বলেন, ‘আমরা বুঝতে পেরেছি, কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না। কোনো যন্ত্রপাতি ছাড়াই ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে আমরাই মানুষকে উদ্ধার করেছি। যাঁদের উদ্ধার করতে পারিনি, তাঁরা মারা গেছেন।’
ত্রাণ না পেয়ে, উদ্ধারকর্মীদের সাহায্য না পেয়ে অনেকেই নিজ দায়িত্বে কাজ করেছেন। আবার জীবিত যাঁদের উদ্ধার করা গেছে কিংবা ভূমিকম্পে যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁরাও চিকিৎসা পাননি। কারণ, হাসপাতালে জায়গা নেই, ওষুধ নেই, অস্ত্রোপচার করার মতো যন্ত্র নেই। সিরিয়ার চিকিৎসকেরা ভূমিকম্পের এক দিন পরই জানিয়েছেন, আহত দুজন আসার পর কাকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত তাঁদের নিতে হয়েছে।
সিরিয়ায় মানুষ মরছে ১২ বছর ধরে। এবার ভূমিকম্পে আরও ভয়ংকর চিত্র দেখল তারা। কেউ মা-বাবাকে হারিয়েছেন। অনেক এমন শিশু বেঁচে গেছে, যারা আর মা-বাবাকে দেখতে পাবে না। জানদারিসের বাসিন্দা আলী বকরের কথাই বলা যেতে পারে। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর পরিবারের ১৮ সদস্যের মধ্যে ১৭ জনই মারা গেছেন। আলী বকর বলেন, ‘আমার মানসিক সাহায্য প্রয়োজন। নিজ হাতে আমি মরদেহগুলো বের করে এনেছি।’
আলীর পাশেই ছিলেন ওমরাস সিদো। তিন সন্তান মারা গেছে তাঁর। বলেন, ‘আমি কীভাবে সুস্থ হব?’
শরীরের ক্ষত হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবেন সিরিয়া-তুরস্কের মানুষেরা। কিন্তু স্বজন হারানোর কষ্ট কি ভুলতে পারবেন তাঁরা? যেসব শিশু এতিম হয়ে গেল, তাদের কী হবে?