জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাশারের সচেতনতা

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা বাশারের গল্পের শুরু রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর স্কুলটিকে ভালোবাসতে শুরু করেন বাশার। স্কুলের গাছপালাকে খুব আপন লাগত তাঁর। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় শুনতে পান, বাংলাদেশের দক্ষিণের বড় একটি অংশ ২০৫০ সালের মধ্যে পানির নিচে ডুবে যাবে। বিষয়টি তাঁর কাছে ভয়ংকর মনে হয়। শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে তিনি বুঝতে পারেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে। মানুষ সচেতন না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের লড়াইয়ে জেতা যাবে না। তাই শুরু করেন জলবায়ুবিষয়ক সচেতনতার প্রকল্প ‘সবুজ’।

সবুজের লক্ষ্য ছিল শহরের মানুষের মধ্যে গাছপালার প্রতি আগ্রহ বাড়ানো। তাই বন্ধুদের নিয়ে বিনা মূল্যে গাছপালা বিতরণ শুরু করেন বাশার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য আয়োজন করেন শিক্ষামূলক কর্মশালা। সবুজ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেন, শিশুদের মধ্যে গাছপালার প্রতি ভালোবাসা আছে। তাদের হাতে গাছের চারা তুলে দিলে তারা গাছ লাগায়, যত্ন করে।

বাশারের পুরো নাম আবুল বাশার রহমান। পড়াশোনা করছেন অর্থনীতি নিয়ে। এইচএসসি পাসের পর দেশের বাইরে পড়ার সুযোগ পান। ভর্তি হন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায়। অর্থনীতি নিয়ে পড়লেও তাঁর মাথায় ঘুরতে থাকে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের একাংশ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক পড়ার পাশাপাশি ঘাঁটতে থাকেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকপড়ুয়াদের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৭) অংশ নেওয়ার সুযোগ পান।

কনফারেন্স অব পার্টিজ বা কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হয় মিসরের শারম আল শেখে। জলবায়ুতে মানুষের সৃষ্টি ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ১৫৪টি দেশ ১৯৯২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে (ইউএনএফসিসিসি) স্বাক্ষর করে। তার পর থেকে প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে আলোচনা করা হয় যে ঠিক কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানো যাবে। কাজের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা-ও এই সম্মেলনে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৭ পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশগ্রহণের সময় বাশার বুঝতে পারেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর তেমন সরব উপস্থিতি নেই সম্মেলনে। অথচ এই দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের প্রান্তিক মানুষের দুর্দশার কথা এ সম্মেলনে উঠে আসে না। বিষয়টি বাশারের মনে দাগ কাটে। তিনি ভাবতে থাকেন, ক্ষতিগ্রস্তদের কথা যদি ভালোভাবে সবাই না জানতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের যতটুকু ক্ষতিপূরণ ও তহবিল পাওয়ার কথা, বাংলাদেশ তা পাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া যাবে না। তাই তাদের পক্ষে লড়াই করাও কঠিন হয়ে যাবে।

এই সমস্যাকে তুলে ধরতে এখান থেকেই বাশার শুরু করেন নতুন একটি প্রকল্প। নাম ‘পরিবর্তনের গল্প’। এর লক্ষ্য বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আক্রান্ত মানুষের অভিযোজনের গল্পগুলো সবার সামনে তুলে ধরা। জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের অবস্থা নিয়ে যেন আলোচনা হয়।

এ জন্য বাশার দুটি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে জানালেন তাঁর সাহায্য প্রয়োজন। একটি তথ্যচিত্র তৈরি করতে চান তিনি। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে আক্রান্ত মানুষের গল্প উঠে আসবে। গল্প সংগ্রহ করতে সাইকেল চালিয়ে দেশ ঘুরবেন। টেকনাফ থেকে সাইকেল চালিয়ে যাবেন তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। যাত্রাপথে গল্প সংগ্রহ করবেন। খুঁজে দেখবেন, সবাই মিলে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে মানুষ। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোকে আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন। এই উদ্যোগ কপ-২৮–এ প্রান্তিক মানুষের দুর্দশার গল্প আলোচনায় উঠে আসতে সাহায্য করবে। পরিবর্তনের গল্প সংগ্রহ করতে সাইকেল বেছে নেওয়ার কারণ, সাইকেল পরিবেশ সংরক্ষণের একটি প্রতীক। সাইকেল কোনো কার্বন নিঃসরণ করে না। পরিবেশের ক্ষতি করে না।

কানাডার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৫ দিনের ছুটি নিয়ে দেশে ফেরেন বাশার। যাত্রা শুরু করেন টেকনাফ থেকে। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ কিছুদিন আগেই ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র কবলে পড়েছে। টেকনাফে সমুদ্র উপকূলে বাঁধ থাকার কারণে এবারের জলোচ্ছ্বাসে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে পারেনি। ঝড়ের প্রভাব টেকনাফে পড়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে ভাটার কারণে ক্ষতি কম হয়েছে। ঝড়ের মূল প্রভাব মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে।

টেকনাফে বাশার সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাশারের টিম গাড়িতে তাঁকে অনুসরণ করেছে। টেকনাফের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। ঘুরতে ঘুরতে বাশার একদল নারী বনরক্ষীর খবর পেয়েছেন। স্থানীয় বন সংরক্ষণে যাঁরা পাহারা বসিয়েছেন।

টেকনাফের বনরক্ষী নারীরা

উপকূলে নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য বন সংরক্ষণ জরুরি। একবার এলাকায় জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রের লবণ পানি ঢুকে অধিকাংশ মিষ্টি পানির উৎসকে লবণাক্ত করেছে। গাছপালা ধ্বংস করেছে। ধান চাষের জমিতে এখন সবাই বাধ্য হয়ে লবণ চাষ করছেন। এই এলাকার বন ঝড় থেকে এলাকার মানুষকে রক্ষা করতে পারে। তাই কয়েকজন নারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা বন রক্ষায় পাহারা দেবেন। টেকনাফে অধিকাংশ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সাগরে মাছ ধরেন। এই এলাকায় চাষের সুযোগ কম। সাগরের পানি জমিতে শুকিয়ে অনেকেই লবণ উৎপাদন করেন। বাশার খুঁজে পেয়েছেন, এখানে বাড়তি আয়ের আশায় মানুষ ড্রাগন ফল চাষ করেন।

সাইকেল চালিয়ে সামনে এগোনোর সময় বড় একটি বাধার মুখোমুখি হন বাশার। এক-একটা গল্পের বিস্তৃতি এত বেশি, সাইকেল থামিয়ে গল্প শুনে সামনে এগোনো যায় না। তথ্যচিত্রে গল্প তুলে আনতে দীর্ঘ পরিকল্পনা লাগে। মান ধরে রাখতে প্রচুর কাজ করার দরকার হয়। অনেক বেশি অর্থেরও প্রয়োজন হয়। তাই বাশার সাইকেল থামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গল্পগুলোকে ভিজ্যুয়ালি ধারণ করার জন্য পরিকল্পনা করবেন। দলে কিছু দক্ষ লোক দরকার। তাঁদেরকে খুঁজে বের করবেন। কিছু টাকা জোগাড় হলে আবার সাইকেল নিয়ে বের হবেন।

এ ছাড়া হাওর ও বন্যাকবলিত এলাকায় ভাসমান স্কুলের খোঁজ পেয়েছেন। বন্যাপ্রবণ এলাকায় শিশুদের শিক্ষার একটি টেকসই সমাধান ভাসমান স্কুল। নৌকায় চেপে ছোট ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে, এটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন বাশার। ঘুরতে ঘুরতে বৃষ্টির পানি সারা বছর সংগ্রহের ব্যবস্থা সম্পর্কে জেনেছেন। এসব নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের অভিযোজনের গল্প তুলে আনতে চান। মানুষের টিকে থাকার গল্প বলতে চান।

কপ-২৮–এ এই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের কথা আরও প্রচার হবে বলে মনে করেন বাশার। আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর দুবাইয়ে পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

তথ্যচিত্র তৈরির সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ হচ্ছে। বাশারের দল একটি ম্যাপ সংকলন নিয়ে কাজ করছে। যেখানে জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) বা ম্যাপিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। এই ম্যাপে সারা দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখানো থাকবে। কোনো এলাকার তাপমাত্রার প্রবণতা, বৃষ্টির ধরনের পরিবর্তন ও অন্যান্য আবহাওয়াবিষয়ক চলকগুলোও থাকবে। ভবিষ্যতে ওই এলাকার আবহাওয়ার প্রবণতাও ম্যাপে দেখানো থাকবে। কানাডার একটি গবেষক দল ম্যাপ তৈরির কাজে সহায়তা করছে। ম্যাপটি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি ও পলিসি থিঙ্কট্যাংকগুলোয় বিতরণ করা হবে।

এই কার্যক্রমে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার (ইউবিসি) শিক্ষক ও প্রশাসনের কাছ থেকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেয়েছেন বাশার। আর মা-বাবার সব রকম সমর্থন তো আছেই। তথ্যচিত্র তৈরিতে সহায়তার জন্য বাশার ফান্ড রেইজ করছেন। বাশারের কাজকে সমর্থন করা যাবে এ লিংকে: https://www.indiegogo.com/projects/pedaling-for-climate-bangladesh-s-untold-stories#/