লবণের এই ইতিহাস জানা আছে কি
লবণ আমাদের জন্য খুব প্রয়োজনীয় এক উপাদান। রান্নার স্বাদ বাড়াতে লবণ লাগবেই। লবণ শরীরের জন্যও খুব দরকারি। লবণের মূল উপাদানের মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম ক্লোরাইড। প্রকৃতিতে অপরিশোধিত লবণ রয়েছে সমুদ্রের পানিতে। রিফাইন বা পরিশোধন করে যে উপাদান পাওয়া যায়, তাকে আমরা বলি খাবার লবণ। ইংরেজিতে একে বলে টেবিল সল্ট।
সাধারণ লবণের সঙ্গে আয়োডিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় আয়োডাইড সল্ট বা আয়োডিন লবণ, যা আমাদের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি পূরণ করে। আয়োডিন আমাদের দেহের বৃদ্ধি এবং বুদ্ধির বিকাশে সাহায্য করে।
লবণের ইতিহাস অনেক পুরোনো। এখন থেকে ছয় হাজার বছর আগে হলস্টেট নামে ইউরোপের এক এলাকায় লবণের খনির সন্ধান পাওয়া যায়। বর্তমানে এটি অস্ট্রিয়ার অংশ। ইউরোপে সে সময় সলনিৎসাতা নামের এক এলাকা ছিল, যার অবস্থান এখনকার বুলগেরিয়ায়। আশপাশে লবণ বেচে রীতিমতো বড়লোক হয়ে গিয়েছিল এই এলাকার বাসিন্দারা।
খনি থেকে যে লবণ পাওয়া যায়, সেটির আবিষ্কারক চীনারা। সমুদ্র থেকে লবণ চাষের পদ্ধতিও চীনাদের আবিষ্কার। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ২ হাজার ৭০০ বছর আগে চীনা এক ওষুধবিজ্ঞানের বই পাওয়া গেছে, যেখানে ৪০ ধরনের লবণের উল্লেখ রয়েছে। একই সঙ্গে সেই বইয়ে লবণ উৎপাদনের দুটি পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে, যে পদ্ধতিতে আজও লবণ উৎপাদন করা হয়।
যেহেতু শুরুর দিকে লবণ খাবারের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়, তাই এর দামও বেশি হয়ে ওঠে। সে কারণে ইতিহাসে একটা সময় লবণ পাওয়া যেত, এমন এলাকায় শহর গড়ে ওঠা শুরু হয়। অস্ট্রিয়ার একটি শহরের নাম সালজবুর্গ। যার মানে লবণের শহর। এলাকাটি একটি লবণের খনির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ১৭ কিলোমিটারের এলাকাজুড়ে রয়েছে এই খনি।
এর কাছেই আছে হলস্টল শহর। জার্মান ভাষায় এর মানে হলো, লবণের ছোট্ট বা মফস্সল শহর। তেমনি স্কটল্যান্ডের সল্টকোটস লবণের এলাকা। গ্রিসের পিরুয়াস শহরের প্রাচীন নাম হালিপেডন, যার মানে লবণের খেত।
এখন থেকে হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন মিসরীয়রা লবণকে পবিত্র বলে মনে করত। তারা কেবল খাওয়ার জন্য লবণের ব্যবহার করত না, সেই সঙ্গে তারা প্রাণীদেহ সংরক্ষণের জন্য সেগুলো লবণে মাখিয়ে নিত। তারা জানত যে মৃতদেহে লবণ মেখে দীর্ঘদিন ভালো রাখা যায়। তারা মৃত মানুষকে কবর দেওয়ার সময় সেখানে খানিকটা লবণ রেখে দিত।
মিসরীয়রা লবণ মাখিয়ে খাবারও সংরক্ষণ করতে পারত। তারা মৃত মাছ ও পাখি লবণে মাখিয়ে সমাধিতে রেখে দিত। মিসরীয়রা মাছে লবণ মাখিয়ে বিক্রি করত ফিনিশীয়দের কাছে। ফিনিশীয়দের বাস ছিল আধুনিক লেবাননে।
যেহেতু লবণ অনেক প্রয়োজনীয় উপাদান, সে কারণে লবণ নিয়ে ব্যবসা হতো। তাই লবণ বিক্রির জন্য একটা আলাদা রাস্তা তৈরি করা হতো। রোমানরা ‘ভায়া সালারিয়া’ নামের একটা রাস্তা তৈরি করেছিল শুধু লবণ বয়ে নেওয়ার জন্য।
লবণ বহন করার জন্য আরেকটা রাস্তা আফ্রিকায় তৈরি হয়েছিল। সেই রাস্তা আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির মধ্যে টিম্বাকুটু দিয়ে থাঘাজায় চলে যেত। এই রাস্তা দিয়ে তুয়ারেগ নামের এক জাতি বছরে প্রায় ১৫ হাজার টন লবণ নিয়ে যেত।
লবণ মুদ্রা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীন রোমের সৈন্যরা বেতন হিসেবে লবণ পেতেন। ইংরেজিতে সোলজার মানে হচ্ছে সৈন্য আর স্যালারি মানে বেতন। এই দুটি শব্দ এসেছে সল্ট বা লবণ থেকে। আজ আমরা যে সালাদ খাই, সেই শব্দও এসেছে সল্ট থেকে সলটেড হয়ে।
লবণ যেহেতু খুব প্রয়োজনীয় উপাদান, তাই রাজারা এর ওপর কর বসাতেন। সে কারণে লবণ বিদ্রোহ খুব প্রচলিত এক বিদ্রোহ। ১৬ শতকে স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের বিরুদ্ধে ডাচরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে, যার একটি কারণ ছিল লবণ। বিদ্রোহীরা লবণ উৎপাদন করা বন্ধ করে দেয়, ফলে স্পেন দেউলিয়া হয়ে যায়।
ফ্রান্সের রাজা সাধারণ মানুষের ওপর গ্যাবেলে নামের একটা কর আরোপ করে। এটা ছিল লবণের ওপর আরোপ করা কর। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ ছিল এই কর।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে লবণের একটা বিশেষ ইতিহাস রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী ‘ডান্ডি মার্চ’ নামের এক লম্বা যাত্রা করেন, যেটিকে বাংলায় বলে ‘লবণ আইন অমান্য অভিযান’। দেশীয় লবণের ওপর ব্রিটিশদের আরোপ করা করের বিরুদ্ধে তিনি ৩৯০ কিলোমিটারের যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় গান্ধীর সঙ্গী হয়েছিল লাখ লাখ মানুষ।
আবার লবণের কারণেই অনেক যুদ্ধ হয়েছে, শহর সৃষ্টি হয়েছে। ইতালির ভেনিস শহরের সঙ্গে জেনোয়া নামের আরেকটি শহরের লড়াইয়ের কারণ ছিল স্রেফ এই লবণ।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যখন মস্কো দখল করতে যান, তখন তিনি ব্যর্থ হন। তাঁর এই অভিযানের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে অনেকে লবণকে দায়ী করে। লবণের অভাবে নেপোলিয়নের অনেক সেনার ক্ষতের চিকিৎসা হয়নি। ফলে হাজার হাজার সেনা মারা যায়।
তাই লবণ কেবল মানুষের জন্য নয়, ইতিহাসেও অনেক মূল্যবান।