শিরোনাম দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, ঘটনা ঘটে গেছে। একসময় আমরা বলতাম সবজান্তা গুগল মামা। অথচ লেখার শিরোনামে গুগল মামার জায়গা দখল করে নিয়েছে চ্যাটজিপিটি। ইন্টারনেটেও তা-ই করছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বেশ কিছুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত এই চ্যাটজিপিটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো বটেই, পত্রিকা থেকে শুরু করে টিভি-সংবাদ—সবখানেই কথা হচ্ছে এ নিয়ে। বিদেশের সংবাদমাধ্যমে যেমন দেখা যাচ্ছে, তেমনি দেশি সংবাদমাধ্যমগুলোতেও উঠে আসছে চ্যাটজিপিটির নানা দিক। গত ফেব্রুয়ারিতে শুধু প্রথম আলোতেই চ্যাটজিপিটির কথা এসেছে বেশ কয়েকবার। তোমরাও চিঠিতে জানতে চেয়েছ এ বিষয়ে।
এত আগ্রহের কারণও আছে। মুক্তি পাওয়ার মাত্র পাঁচ দিনেই চ্যাটজিপিটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখের বেশি। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব, এমনকি গুগলকেও পেছনে ফেলে সবচেয়ে দ্রুত এত ব্যবহারকারী অর্জন করেছে চ্যাটজিপিটি। এর মাধ্যমে রেকর্ডের খাতায় নাম লিখিয়েছে এই প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। দুই মাসের মধ্যে চ্যাটজিপিটি পৌঁছে গেছে ১০ কোটি মানুষের কাছে।
তো এই চ্যাটজিপিটি আসলে কী? কোত্থেকে এল এটা?
সে কথা জানব। দেখব এটা কীভাবে কাজ করে; আর কেনই-বা সবার মুখে মুখে ঘুরে ফিরছে এর নাম।
দুই
২০১৬-১৭ সালের কথা। বাংলাদেশের মানুষ তখনো প্রযুক্তির সঙ্গে এতটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যায়নি। অনলাইনে ক্লাস বা মিটিং কিংবা বাসায় বসে অফিস করা তখনো স্বপ্ন। অথচ এর কবছর পরেই করোনা মহামারিতে বদলে যায় অনেক কিছু। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে তত দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জোরেশোরে গবেষণা চলছে। এসব গবেষণা নিয়ে মানুষের অত মাথাব্যথা ছিল না। সেটা শুরু হয় আলফা গো-র কারণে।
আলফা গো নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটি মূলত একটি ‘গো’ খেলার প্রোগ্রাম। খেলাটি দাবার মতোই, তবে এর চালের ধরনে কিছুটা ভিন্নতা আছে। এই প্রোগ্রামের সূচনা যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর হাতে। ২০১০ সালে ‘ডিপমাইন্ড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তাঁরা। এটি নিউরাল নেটওয়ার্কনির্ভর একটি বুদ্ধিমত্তা। ভিডিও গেম খেলতে পারে। এখানে নিউরাল নেটওয়ার্ক বিষয়টি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা যাক।
মানুষের মাথায় ১২০ বিলিয়নের বেশি নিউরন আছে। আমরা যখন চিন্তা করি বা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি, অনেকগুলো নিউরন একসঙ্গে মিলে কাজ করে। এ জন্য মানুষের চিন্তাক্ষমতা এত শক্তিশালী। কৃত্রিমভাবে এ রকম একটা মডেল তৈরির চেষ্টা করেন প্রযুক্তিবিজ্ঞানীরা। এই মডেলে অনেকগুলো নোড যুক্ত থাকে। প্রতিটি নোডকে তোমরা একটা কম্পিউটার বা সার্ভারের সঙ্গে তুলনা করতে পারো, বাস্তবে যদিও বিষয়টা একটু জটিল। সহজে বোঝার জন্য ভাবতে পারো, এ রকম মডেলে অনেকগুলো কম্পিউটার একসঙ্গে মিলে একটা সমস্যা নিয়ে কাজ করে। তাই অনেক জটিল সমস্যা নিয়ে কাজ করা যায়।
যাহোক, ২০১৪ সালে গুগল কিনে নেয় ডিপমাইন্ডকে। এর দুই বছর পর, ২০১৬–তে আলফা গো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গো খেলোয়াড় লি সিডলকে হারিয়ে দেয় গো খেলায়। এখানে বিষয়টা হলো, শুধু পুরোনো চাল বিশ্লেষণ করে এই খেলায় জেতা সহজ নয়। বোঝা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নানা দিক—মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং ইত্যাদি আবার আলোচনায় আসে। মানুষ বুঝতে পারে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সামনেই। যেখানে মুছে যেতে পারে যন্ত্র ও মানুষের মধ্যকার সীমারেখা।
এ সময় স্যাম অল্টম্যান, গ্রেগ ব্রকম্যান, রিড হফম্যান, জেসিকা লিভিংস্টোন, পিটার থিল ও ইলন মাস্ক একসঙ্গে হন। তাঁরা ভাবেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, সাধারণ মানুষের জন্য তো সমস্যা। তাঁরা তখন একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। নাম দেন ওপেন এআই। চ্যাটজিপিটি এই ওপেন এআইয়েরই বানানো। এর বর্তমান প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিস, ইনফোসিস ও ওয়াইসি রিসার্চ। এর সদর দপ্তর সান ফ্রান্সিসকোতে। ২০১৮ সালে ইলন মাস্ক টেসলার জন্য ওপেন এআই থেকে সরে যান। পরে আবার ওপেন এআইয়ের কর্তাব্যক্তিরা মাইক্রোসফট থেকে বিনিয়োগ পেতে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানও তৈরি করেন।
সবাই মিলে নেমে পড়েন কাজে। এদিকে ২০১৭ সালে গুগলের কয়েকজন গবেষক ‘ট্রান্সফরমার’ নামে নিউরাল নেটওয়ার্কের একটি নতুন মডেল বের করেন। এই মডেল একটি বড় বাক্য বা অনুচ্ছেদের কোথায় কোন শব্দ বা বাক্যাংশ আছে, সেটা বের করতে পারে। দুটো ভিন্ন বাক্যের অর্থের ভিন্নতা বুঝতে পারে। গবেষকেরা এ নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। সেটা প্রকাশের পরপর সবাই ঝুঁকে পড়ে এদিকে।
পরের দুবছরে ওপেন এআই তৈরি করে জিপিটি (Generative Pre-trained Transformer) ও জিপিটি-২। এখানে একটা দারুণ কাজ করেন ওপেন এআইয়ের গবেষকেরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে শেখানোর উপায়—মেশিন লার্নিং দুভাবে হতে পারে। সুপারভাইজড—মানে, কেউ এর দেখাশোনা করবেন, নির্দেশনা দেবেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটিকে। আর দুই. আনসুপারভাইজড। মানে, কারও নির্দেশনা ছাড়া, নতুন তথ্য নিয়ে, সেটা বিশ্লেষণ করে বুদ্ধিমত্তাটি নিজে নিজেই শিখতে পারবে। এই দ্বিতীয় পথে হাঁটতে শুরু করে জিপিটি ও জিপিটি-২। এর ফলে তাকে আর বলে দিতে হয় না, বিশেষভাবে কোন তথ্যগুলো সে শেখার কাজে লাগাবে। বরং যে কারও সঙ্গে কথা বলতে বলতে, মানে চ্যাট করতে করতেই সে নতুন বিষয়গুলো শিখে নিতে পারে। এভাবে ওপেন এআইয়ের পরের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল ‘জিপিটি-৩’ মানুষের মতো ‘কথা’ বলার ক্ষমতা অর্জন করে।
এরপর গত নভেম্বরে আসে চ্যাটজিপিটি। তারপরের কথা তো আগেই বলেছি। এবার তাহলে একটু দেখে নেওয়া যাক চ্যাটজিপিটি কীভাবে কাজ করে।
তিন
চ্যাটজিপিটির (ChatGPT) পূর্ণরূপ চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইন্ড ট্রান্সফর্মার। এটি একটি ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল। চাইলে এটিকে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলও বলা যায়। কারণ, আমরা যেভাবে কথা বলি, বুঝি, ভাব প্রকাশ করতে পারি, ঠিক সেভাবেই এটি ভাষা ব্যবহার করতে পারে।
এই মডেলে আছে একাধিক নিউরাল নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্কের স্তরগুলোকে প্রশিক্ষণ দিতে ব্যবহৃত হয়েছে বিশালাকার টেক্সট (লেখা) ডেটাসেট। মানে, লিখিত প্রচুর তথ্য। এতে আছে বিভিন্ন বই, নিবন্ধ, পত্রিকার কলাম এবং ইন্টারনেটজুড়ে ছড়িয়ে থাকা শত-সহস্র-কোটি ব্লগ পোস্ট।
এগুলো ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটিকে শেখানো হয়েছে, স্বাভাবিক কথোপকথনে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে কীভাবে কথা বলে। একটি প্রশ্নের উত্তরে কীভাবে একেক জন একেক ধরনের উত্তর দিতে পারে। বাক্যের গঠনশৈলীর পেছনে থাকা অনুভূতিও ধরতে পারে এটি। প্রতিটি সংলাপ বা কথার পেছনের কন্টেক্সট বা প্রাসঙ্গিকতা বোঝার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে মেশিন লার্নিং। এর ফলে চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কেউ যখন কথা বলে বা চ্যাট করে, তখন এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অন্য আট-দশটি চ্যাটবটের মতো অবুঝ রোবটের ভাষায় এককথায় শুধু সাদামাটা তথ্য আউটপুট দেয় না। কথোপকথনের আগের কথাগুলোর সঙ্গে মিল রেখেই নতুন প্রশ্নের জবাব দেয়।
সোজা কথায়, আমরা মানুষেরা যেভাবে কোনো প্রশ্নের উত্তরে সামনের জনের কথা বলার অনুভূতি, বাচনভঙ্গি, ওই ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক এবং আগের কথাবার্তা ও সম্পর্কের ধরন ইত্যাদি মাথায় রেখে জবাব দিই, চ্যাটজিপিটিও তা-ই করে। এটি বাক্যের ভাবভঙ্গির পাশাপাশি প্রবাদ-প্রবচন, শব্দের আঞ্চলিক ব্যবহার ইত্যাদি বুঝতে পারে। তবে বলে রাখা প্রয়োজন, এসব এটি করতে পারে মূলত ইংরেজিতে। (কেন, তাতে একটু পরে আসছি।)
তবে চ্যাটজিপিটির এভাবে মানুষের মতো ভাবের আদান–প্রদান করার ক্ষমতা যতটা না আশ্চর্যজনক, তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর এর জ্ঞানের সীমা।
জিপিটি (GPT) মডেলের প্রথম সংস্করণটি ১১৭ মিলিয়ন প্যারামিটার নিয়ে কাজ করতে পারত। প্যারামিটার মানে, খুঁটিনাটি যেসব বিষয় এটি হিসাবে রাখছে। এর সর্বশেষ সংস্করণ ‘জিপিটি-৩’ প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন প্যারামিটার নিয়ে কাজ করছে! তা ছাড়া প্রতিনিয়তই এই মডেল ইন্টারনেট থেকে নতুন নতুন তথ্য জানছে ও শিখছে। গুগল মামার কাছে যেমন ইন্টারনেটের সব তথ্য আছে, চ্যাটজিপিটির কাছেও আছে প্রায় সব বিষয়ের জ্ঞান। বোনাস হিসেবে চ্যাটজিপিটির রয়েছে নতুন তথ্য বা কনটেন্ট তৈরির ক্ষমতা। গুগলকে কিছু জিজ্ঞেস করলে এটি কেবল ইন্টারনেটে থাকা কনটেন্ট নিয়ে এসে দেখায়। আর চ্যাটজিপিটি এই তথ্য ব্যবহার করে তার সারসংক্ষেপ, বিশ্লেষণ এমনকি নিজস্ব অভিমতও দিতে পারে।
বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দিই। চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় ৭টি দর্শনীয় স্থানের একটা তালিকার কথা যদি গুগলকে জিজ্ঞেস করা হয়, তবে গুগল ইন্টারনেট থেকে এমন কিছু ওয়েবসাইট সার্চ রেজাল্টে দেখাবে, যেগুলোতে চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থানগুলোর কথা উল্লেখ আছে। হতে পারে সেখানে চট্টগ্রামের এমন ৫টি জায়গার নাম আছে বা ১০টি, অথবা ২০টি। তা ছাড়া সার্চ রেজাল্টে থাকা কনটেন্টগুলো শুধু চট্টগ্রাম নয়, পুরো বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানের তালিকাও হতে পারে। হয়তো এর মধ্যে চট্টগ্রামের কয়েকটি জায়গার কথা আছে। তাই গুগল এটাও দেখাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সাতটি দর্শনীয় স্থান বেছে নিতে হলে এই সব ওয়েবসাইট ঘেঁটে সাতটি জায়গার নাম বের করতে হবে। অর্থাৎ, গুগলকে যা জিজ্ঞেস করা হয়, অনেক সময় একদম ঠিক সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না। সঠিক তথ্যের জন্য অনেক সময় সার্চ রেজাল্টের ওয়েবসাইটগুলো পড়তে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা অনেক সময়সাপেক্ষ।
কিন্তু ঠিক একই প্রশ্ন যদি চ্যাটজিপিটিকে করা হয়, সেটি সরাসরিই চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় সাতটি জায়গার নাম বলে দেবে। একনজরেই মিলবে সব তথ্য।
শুধু এ রকম তথ্যই নয়। ধরো, চ্যাটজিপিটির কাছে ঢাকা থেকে ওই সাতটি জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার জন্য দুই দিনের একটি ভ্রমণ পরিকল্পনা চাইলে তুমি। সেটি কিন্তু যাতায়াত পথ থেকে শুরু করে ঠিক কোন সময় কোন জায়গায় গেলে দুই দিনে সব কটি জায়গা ঘুরে আসা যাবে, তার পূর্ণ একটা পরিকল্পনাও বানিয়ে দেবে।
লেখানির্ভর এ রকম তথ্যের পাশাপাশি টেকনিক্যাল কাজও করতে পারে চ্যাটজিপিটি। ধরো, ঢাকা থেকে গিয়ে তোমরা পাঁচ বন্ধু চট্টগ্রামের ওই জায়গাগুলো দুই দিন ঘুরে দেখলে। এখন তুমি যদি চ্যাটজিপিটিকে এমন একটি প্রোগ্রাম তৈরি করতে নির্দেশ দাও, যার মাধ্যমে দুই দিনের জন্য পাঁচজনের সব ব্যক্তিগত খরচ ও পুরো দলের খরচের হিসাব রাখা যাবে, তাহলে চ্যাটজিপিটি সেটাও করে দিতে পারবে। জাভাস্ক্রিপ্ট, সিএসএসসহ একটি পূর্ণাঙ্গ এইচটিএমএল কোড আউটপুট দেবে চ্যাটজিপিটি। এইচটিএমএল কোড দিয়ে ওয়েবসাইটের মূল কাঠামো বানানো হয়। আর সিএসএস ও জাভাস্ক্রিপ্ট দিয়ে সাজানো হয় এর সবকিছু। তার মানে, এই কোড যেকোনো ওয়েবসাইট বা ব্রাউজারে এইচটিএমএল ফাইল হিসেবে সেভ করলে একটি চমৎকার ক্যালকুলেটর তৈরি হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে প্রতিদিনের খরচ ইনপুট করলেই ভ্রমণের মাথাপিছু খরচসহ অন্যান্য খরচও বের করা যাবে মুহূর্তেই। অর্থাৎ কোনো রকম কোডিং জ্ঞান ছাড়াই তুমি একটি প্রোগ্রাম বা টুল বানিয়ে ফেলতে পারবে চ্যাটজিপিটির সাহায্যে।
এগুলো ছাড়াও চ্যাটজিপিটি একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আউটপুট দিতে পারে। ধরো, তুমি ট্যুর থেকে বাড়ি ফিরে চট্টগ্রামের ওই জায়গাগুলোয় কী কী দেখেছ, সেটা নিয়ে একটা ভ্রমণকাহিনি লিখে ফেলতে চাও। তোমার হাতে লেখার সময় নেই। কোনো সমস্যা নেই, চ্যাটজিপিটিকে বললেই হবে!
চ্যাটজিপিটি ইতিমধ্যে জানে, ওই জায়গাগুলোতে দেখার মতো কী কী আছে। তাই তুমি ওই দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে আসার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে বললে এটি ঠিকই তোমার হয়ে পুরো অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বিশাল রচনা লিখে ফেলবে। লেখাটি পড়ে মনে হবে, তুমি নিজে যা যা দেখেছ, সে সম্পর্কে নিজের মুখ থেকেই শুনছ। কারণ, এ পরিকল্পনা চ্যাটজিপিটি-ই বানিয়ে দিয়েছিল। তাই এটি জানে, তুমি কোন জায়গার পর কোথায় গিয়েছিলে এবং দিনের কোন সময়টায় গিয়েছিলে। আর সময় জানে বলে সে সময় আবহাওয়া বা প্রকৃতি সম্পর্কেও তথ্য থাকবে ওর কাছে। ফলে চ্যাটজিপিটির লেখা অভিজ্ঞতা মোটামুটি তোমার অভিজ্ঞতার মতোই হবে।
এসব ছাড়াও ডেটা স্ক্র্যাপিং, নতুন আইডিয়া তৈরি ও সৃজনশীল ইনপুটও দিতে পারে চ্যাটজিপিটি। আসলে চ্যাটজিপিটি কী করতে পারে, তার চেয়ে কী করতে পারে না, সেগুলো বলতে গেলে হয়তো সময় কম লাগবে। তবে এর মানে এই নয় যে চ্যাটজিপিটি একদম স্বয়ংসম্পূর্ণ বা নিখুঁত।
চ্যাটজিপিটি বাংলাসহ অন্যান্য প্রায় সব ভাষাই বোঝে। তবে এর সবচেয়ে ভালো আউটপুট পাওয়া যায় ইংরেজিতে। এটার কারণ বোঝা সহজ। এটিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এ ভাষায়। আবার অনেক ব্যবহারকারী এ ভাষায় এটির সঙ্গে চ্যাট করেছে। বাংলা বা অন্যান্য ভাষায় সে পরিমাণ প্রশিক্ষণ বা চ্যাট করেনি মানুষ। করলে একসময় এসব ভাষায়ও এটি দক্ষ হয়ে উঠবে।
তা ছাড়া চ্যাটজিপিটি সব বিষয়ে জানলেও ইন্টারনেটে তথ্যের উৎসের কোনগুলো গ্রহণযোগ্য, সে বিষয়ে এখনো ঠিক পরিপক্ব হয়ে ওঠেনি। তাই অনেক সময় তথ্যের মধ্যে কিছু ভুল থেকে যায় এখনো।
তবে চ্যাটজিপিটি তুলনামূলক নতুন এবং কেবল তৃতীয় প্রজন্মে আছে। অ্যান্ড্রয়েড ৩.০ হানিকম্বের কথা মনে আছে? অ্যান্ড্রয়েডের তৃতীয় সংস্করণের সঙ্গে বর্তমানের অ্যান্ড্রয়েড ১২-এর তুলনা করলে তোমাদের অনেকেই হয়তো অ্যান্ড্রয়েড ৩–কে অব্যবহারযোগ্য বলবে। চ্যাটজিপিটির বা জিপিটির উন্নয়নের গতি অ্যান্ড্রয়েডের চেয়ে অনেক দ্রুত। সূচকীয়।
জিপিটির মাত্র তৃতীয় সংস্করণেই চ্যাটজিপিটি ইন্টারনেটের সবকিছু জেনে গেছে। এটি তথ্যনির্ভর মোটামুটি সবই করতে পারে। যদি প্রাথমিক এই সংস্করণগুলোতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এত কিছুতে এত দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তবে এই সবজান্তা চ্যাটজিপিটির ভবিষ্যৎ সংস্করণ যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় কী যোগ করবে, তা নিয়ে ভাবা একই সঙ্গে যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি দুশ্চিন্তারও।
তবে দুশ্চিন্তার বিষয়টি অনেকটাই কমে যাবে, যদি তুমি প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারো। নতুন প্রজন্মের সেই দক্ষতা আছে। তোমরা যারা কিশোর আলোর পাঠক, তোমরা অনেক স্মার্ট, অনেক বুদ্ধিমান। ফাইভারের মতো জনপ্রিয় ফ্রিল্যান্সিং ওয়েবসাইটে এখন নতুন কাজের সুযোগ এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে চ্যাটজিপিটি অ্যাপ্লিকেশন, মিডজার্নি আর্টিস্ট, চ্যাটবট ডেভেলপার ইত্যাদি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এ রকম আরও অনেক নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে। গুগলও কিছুদিন আগে চ্যাটজিপিটির মতো ‘বার্ড’ নামের একটি চ্যাটবটের ঘোষণা দিয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের প্রোগ্রামিং দক্ষতা লাগবে, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা লাগবে। আর এ ধরনের নতুন প্রযুক্তিকে বরাবরই স্বাগত জানিয়েছে নতুন প্রজন্ম। গড়ে তুলেছে নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা।
তোমরাও নিশ্চয়ই সেটি করবে। তোমাদের হাত ধরে চ্যাটজিপিটি হয়তো বাংলায় দক্ষ হয়ে উঠবে কিংবা তোমরাই হয়তো বানাবে এর চেয়েও উন্নত কোনো প্রযুক্তি। কী বলো?
ভালো কথা, তুমিও যদি চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথা বলতে চাও, তাহলে চলে যাও chat.openai.com-এ। একটু গল্প করে আসো। আশা করা যায়, নতুন এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বন্ধুটিকে তোমার মন্দ লাগবে না!