সম্প্রতি স্পেনের ক্যানারি দ্বীপের লা পালমা সৈকতে ভেসে এসেছে একটি মৃত তিমি। সাগরের তীরে প্রায়ই মৃত তিমি ভেসে আসার খবর পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য খবরের চেয়ে একটু ভিন্ন এবারের ঘটনাটি। মৃত এই স্পার্ম তিমির পেটে পাওয়া গেছে একধরনের সোনা। নাম অ্যাম্বারগ্রিস বা ফ্লোটিং গোল্ড। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ভাসমান সোনা’। অত্যন্ত মূল্যবান এ সোনা তৈরি হয় তিমির পেটেই। সাধারণত ১০০টি স্পার্ম তিমির মধ্যে মাত্র ১টিতে এ ধরনের সোনা তৈরি হয়। আর বিশ্বব্যাপী যত তিমি আছে, তার মাত্র এক শতাংশ স্পার্ম তিমি। সুতরাং বুঝতেই পারছ, এ সোনা হাতের নাগালে পাওয়া খুবই কঠিন। তাই এর দামও আকাশচুম্বী।
লা পালমা সৈকতে মৃত স্পার্ম তিমিটি ভেসে আসার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব লা পালমাসের প্রাণিস্বাস্থ্য গবেষক আন্তোনিও ফার্নান্দেজ রদ্রিগেজ। তিমিটির মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করেন তিনি । তিনি দেখতে পান যে কিছু একটা আটকে আছে তিমিটির অন্ত্রে। তাঁর মতে, অ্যাম্বারগ্রিসের কারণে তিমিটির অন্ত্র ভেঙে গিয়েছিল। ফলে প্রাণীটির মৃত্যু হয়।
অ্যাম্বারগ্রিস সাধারণত পারফিউম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। প্রতি পাউন্ড অ্যাম্বারগ্রিসের দাম কয়েক লাখ টাকা। ক্যানারি দ্বীপের তীরে পাওয়া তিমিটির পেটে প্রায় ২১ পাউন্ড (৯ দশমিক ৫ কেজি) অ্যাম্বারগ্রিস পাওয়া গেছে। এর বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ছয় কোটি।
আগেই বলেছি, মাত্র এক শতাংশ স্পার্ম তিমির পেটে তৈরি হয় অ্যাম্বারগ্রিস। কিন্তু কীভাবে তৈরি হয় এই মহামূল্যবান সোনা? সাধারণত স্কুইড, অক্টোপাস ও নানা প্রজাতির মাছ খেয়ে জীবন ধারণ করে স্পার্ম তিমি। সমুদ্রের ছয় হাজার ফুট গভীরতায় এদের বাস। খাদক হিসেবে এ প্রজাতির তিমির বেশ নামডাক আছে। খাবার সামনে পেলে যেন সবকিছু ভুলে যায়। কিন্তু খাবার খেলেই তো আর সব হজম করা যায় না। স্পার্ম তিমিও সব খাবার হজম করতে পারে না। এই হজম না হওয়া খাবার জমতে থাকে তিমির পেটে। ধীরে ধীরে তা হয়ে ওঠে পাথরের মতো শক্ত। আর এই শক্ত পাথরের মতো বস্তুকেই বলা হয় অ্যাম্বারগ্রিস।
তিমির পেটেই অ্যাম্বারগ্রিস আয়তনে বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে একসময় তিমির অন্ত্র ছিঁড়ে বেড়িয়ে যায় অ্যাম্বারগ্রিস। ফলে মৃত্যু ঘটে তিমিটির। লা পালমা সৈকতে পাওয়া তিমিরও সেই দশাই হয়েছিল। আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে। ‘না খেয়ে মানুষ মরে না, খেয়ে মরে।’ এই তিমির ক্ষেত্রে এ কথাই যেন বাস্তব হয়ে ফুটে উঠেছে।
আচ্ছা, তোমাদের মাথায় কি প্রশ্নটা একবারও এসেছে যে এই ছয় কোটি টাকা কার পকেটে যাবে? দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফার্নান্দেজ রদ্রিগেজ বলেছেন, তিনি নিজেই এই অ্যাম্বারগ্রিস বিক্রি করতে চান। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ক্যানারি দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত) অ্যাম্বারগ্রিস বিক্রি করা বৈধ। তবে বিক্রির টাকা তিনি নিজের পকেটে পুরবেন না। ২০২১ সালে একটি আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে লা পালমাসে। এতে দ্বীপের কিছু অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। মারা যান সেখানকার অনেক মানুষ। অনেকেই আহত অবস্থায় বেঁচে যান। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ওই দ্বীপের প্রায় ৯২৯ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছিল। সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভেতর এই টাকা বিলিয়ে দিতে চান রদ্রিগেজ। যদিও ক্ষতি হওয়া টাকার তুলনায় এ টাকা খুবই সামান্য। তারপরও অন্তত কিছু মানুষের তো সাহায্য হবে এই অর্থে।
আরেকটা তথ্য দিই। বর্তমানে স্পার্ম তিমি শিকার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কারণ, এই প্রজাতির তিমি বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে স্পার্ম তিমি শিকার কমেছে। ফলে বর্তমানে এ প্রজাতির তিমির সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু প্রজাতিটি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।