৩০ ফেব্রুয়ারি একবার এসেছিল, আর কোনোদিন আসবে না
২০২৪ সালটি ছিল লিপইয়ার। বাংলায় বলা হয় অধিবর্ষ। প্রতি চার বছর পরপর অধিবর্ষ গণনা করা হয়। কেন, তা প্রায় সবাই জানে। তবু বোঝার সুবিধার্থে আরেকবার বিষয়টা ঝালাই করে নেওয়া যাক।
আমরা বছর গণনা করি ৩৬৫ দিনে। বছর কী? সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর একবার ঘুরে আসতে যতটা সময় লাগে। আসলে, পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে একবার ঘুরতে সময় নেয় ৩৬৫ দশমিক ২৪২৫ দিন। দশমিকের পরের অঙ্কটা প্রায় ৬ ঘণ্টার সমান। একদম সঠিকভাবে বললে, ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড। ৬ ঘণ্টা করে ৪ বছরে হয় (৪×৬) = ২৪ ঘণ্টা। এ কারণে প্রতিবছর এই ৬ ঘণ্টা হিসাবে না ধরে চার বছর পরে একটি দিন গণনা করে হিসাব সমন্বয় করা হয়। এভাবে সৌর ক্যালেন্ডারের মোট হিসাব ঠিক থাকে।
এই যে সৌর ক্যালেন্ডার, এর আরেক নাম জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করা হয় সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সময়। তিনি সে কালে প্রচলিত রোমান ক্যালেন্ডারের বিকল্প হিসেবে আরও বাস্তবসম্মত একটি ক্যালেন্ডার তৈরির উদ্যোগ নেন। এর ফলেই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার তথা আজকের সৌর ক্যালেন্ডারের মূল ভিত্তি গড়ে ওঠে।
সে কালে বছর শুরু হতো মার্চ মাসে। শেষ হতো ফেব্রুয়ারিতে। ফলে বাড়তি যে দিনটি, তা ফেব্রুয়ারিতে গণনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই দিনটি পালন করা হতো ২৪ ফেব্রুয়ারি। ‘লিপ’ কথাটি এসেছে লাতিন থেকে। এটাকে ‘বিস সেক্সটাস’ও বলা হতো সংক্ষেপে। মূল কথাটি হলো, ante diem bis sextum Kalendas Martias। ইংরেজিতে কথাটা হলো, আ সেকেন্ড সিক্সথ ডে বিফোর দ্য ক্যালেন্ডস। অর্থাৎ বছর শেষের আগে দ্বিতীয় ‘ষষ্ঠ’ দিন! এ কারণেই মাস শেষের প্রায় ৬ দিন আগে লিপ ইয়ার পালন করা হতো। শুধু লিপ ইয়ার যুক্ত করাই নয়, জুলিয়াস সিজার আরও একটি কাজ করেন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের সময়। তিনি জানুয়ারি থেকে বছর গণনা শুরু করেন।
ঘটনার ঘনঘটায় ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি ভাবলেন, এই ক্যালেন্ডারকে আরও নিখুঁত করা প্রয়োজন। সেটা ১৫৮২ সালের কথা। এ সময় তিনি লিপ ইয়ারকে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে নিয়ে যান ২৯ ফেব্রুয়ারি। আরও কিছু পরিবর্তন করেন তিনি। আধুনিক ক্যালেন্ডার আসলে এই গ্রেগরির প্রবর্তিত ক্যালেন্ডার, অর্থাৎ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার।
৩০ ফেব্রুয়ারির ঘটনা জানতে এইটুকু হলো ভূমিকা। এবার মূল ঘটনা শুরু।
২
১৭০০ সালে সুইডেন হঠাৎ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে আসতে চায়। সে জন্য তারা ভাবে, এ বছর থেকে আর লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ পালন করবে না। ১৭০০ সাল, ১৭০৪ সাল ও ১৭০৮ সালে তারা ফেব্রুয়ারি কাটায় শুধু ২৮ দিনে। অথচ ওই বছরগুলো ছিল অধিবর্ষ। এরপর শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। দেখা গেল, জরুরি কাজের চাপে ক্যালেন্ডারের কথা সবাই ভুলে গেছে।
কয়েক বছর পর সম্রাট দ্বাদশ চার্লস বুঝতে পারলেন ঝামেলাটা। দেখা গেল, সুইডেনের ক্যালেন্ডার এখন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারও নয়, গ্রেগরিয়ানও নয়! এই সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়? সব পরিবর্তন বাতিল করলেন সম্রাট। দিনের সামঞ্জস্য করতে গিয়ে দেখা গেল, সব মিলেছে; শুধু একটি দিন মিলছে না—১৭০০ সালের অধিবর্ষের দিনটি। সেই দিনটার হিসাব মেলাতে ১৭১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২৯ ফেব্রুয়ারির পরে আরও একটি দিন যোগ করা হলো। ৩০ ফেব্রুয়ারি!
অবশেষে সব ঝামেলা মিটল। ১৭৫৩ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এল সুইডেন।
এভাবে, ইতিহাসে একবারই এসেছিল ৩০ ফেব্রুয়ারি, সুইডেনে। সেই দিনটি আর কখনো, কোথাও আসবে না।
যাঁদের ২৯ ফেব্রুয়ারি জন্ম, জন্মদিন আসে চার বছর পরপর, তাঁদের হয়তো মনে অনেক দুঃখ। নিজেদের দুঃখ খানিকটা কাটাতে তাঁরা সেই মানুষগুলোর কথা ভাবতে পারেন, যাঁদের জন্ম হয়েছিল সুইডেনে, ৩০ ফেব্রুয়ারি। ইতিহাসে আর কোনোদিন তাঁদের জন্মদিন আসেনি।