বৃষ্টিভেজা চেরাপুঞ্জি

যতবার আমি নদী, পাহাড়, সমুদ্র, বন, কিংবা ঝরনা দেখেছি, লিখতে চেয়েছি তাদের কথা; ততবার আমার মনে হয়েছে ভাষার এত সাধ্য নেই যে প্রকৃতির উপচেপড়া সৌন্দর্যকে সে বেঁধে ফেলে শব্দ দিয়ে। এবারও চেরাপুঞ্জির ঝরনাধারা আর পাহাড় থেকে পাহাড়ে ছুটে চলা মেঘের রাজ্যে দাঁড়িয়ে আমার আবারও মনে হলো সেই কথা—এই সৌন্দর্যকে বর্ণনা করব, সে সাধ্য আমার নেই।

যেখানে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে আমাদের ঢাকা; পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট আর ময়লা-আবর্জনায় ভরে যায় গলি থেকে রাজপথ; সেখানে বৃষ্টি দেখতে যাচ্ছি চেরাপুঞ্জি, ভাবতেই কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল। তার ওপর ঈদযাত্রায় রাস্তায় যে ভোগান্তি, সে কথা না হয় শিকেয় তুলে রাখি। কিন্তু বাস কাউন্টারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে মশার কামড়, নির্ঘুম রাত আর ইমিগ্রেশন পাড়ি দিতে গিয়ে বৃষ্টিতে জবুথবু হওয়ার পর যখন এসে দাঁড়াই উমক্রেম ফলসের সামনে, পাহড়ের বুক চিরে পাথরের বাধা ডিঙিয়ে জলরাশির গড়িয়ে পড়া সৌন্দর্য আর শব্দের মায়াময় বন্ধনে কোথায় যে ক্লান্তিগুলো উড়ে গেল, আমি জানি না। সময় স্বল্পতায় অন্য স্পটগুলোতে যাওয়ার তাড়া ছিল, তবু মনে হচ্ছিল, উমক্রেম ফলস যেন বারবার বলছে আমায়, ‘কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে’।

পাহাড়, জঙ্গল, কাঁটাতারের দেয়াল আর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সুপারির বন দেখতে দেখতে আমরা ছুটে চলি আরও সৌন্দর্যের খোঁজে। পান্থমাই, ফাটাছড়ি বা বড়হিল, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বাংলাদেশের জাফলং সীমন্তে দাঁড়িয়ে পিয়াইন নদের ওপার থেকে যে ঝরনা আমাদের হাতছানি দেয়, তার কাছে না গেলে বোঝা দায় কেন তাকে লোকে বলে ‘মায়াবতী’। অপলক দৃষ্টিতে আমরা দেখি বৃষ্টিভেজা মায়াময় মায়াবতী।

উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে গাড়ি আমাদের নিয়ে ছুটে চলে এলিফ্যান্ট ফলসের দিকে, যে ঝরনাধারায় হাতি স্নানের গল্প খাসি কিংবদন্তি থেকে আজও ঘুরেফিরে মানুষের মুখে মুখে। চারদিকে সবুজের সমারোহ আর উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা জলপ্রপাত, তার থেকে ভেসে আসা জলকণা পৌরাণিক গল্প হয়ে আটকে থাকে চোখের পাতায়।

হৃদয় আকৃতির শিলা
ছবি: গার্গী তনুশ্রী পাল

এবারের গন্তব্য ‘মাউলিনং ভিলেজ’, এশিয়ার একটি পরিচ্ছন্ন গ্রাম। আমাদের সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই সূর্য যেন ডুবে ডুবে যায়। তবু ছোট্ট কিন্তু পরিপাটি আর পরিচ্ছন্ন একটা খাবারের দোকানে আমাদের ডাল-ভাত জুটে। হাত-মুখ ধুতে গিয়ে দুদণ্ড থমকে দাঁড়াই। হাত ধোয়ার বেসিনের সামনে লেখা আছে, ‘ প্লিজ কাউন্ট অ্যাভরি সিঙ্গেল ড্রপ অব ওয়াটার’ যার অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি ফোঁটা জল যেন হিসাব করে খরচ করা হয়। মনে হলো, এই প্রথম জল ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্ক হলাম আমি। বৃষ্টির জলে ভিজে থাকে যে গ্রাম, জলের জন্য তার কত মায়া। ঘুরে ঘুরে দেখি বাড়িগুলোতে কোনো চাকচিক্য নেই। রাস্তায় নেই ময়লার স্তূপ। ড্রেনে জল জমে বাসা বাঁধেনি মশা বা অন্য কোনো জলের পোকা। বাগান আর বনানীর সঙ্গে মিলেমিশে আছে ছোট ছোট বাড়ি, যেন এক শান্তির নিকেতন।

আরও পড়ুন

সন্ধ্যা নামতে না নামতেই আমরা পৌঁছে যাই মাওকডপ ড্যাম্পেপ ভ্যালিতে (Mawkdok Dympep Valley)। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ভিউ পয়েন্টে যখন দাঁড়াই, ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নিভে নিভে যাওয়া সূর্যের আলোতে দেখি পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ছে মেঘ। নীল চাদুয়া হয়ে আকাশটা যেন চেয়ে আছে মায়ের মতো। মেঘগুলো কখনোবা মুখ ঢাকছে শাড়ির আঁচলে, কখনোবা আমাদের ছুঁয়ে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও। কী যে অপরূপ দৃশ্য, বলে বোঝানো যাবে না।

পাহাড় বেয়ে আসা মিনারেল ওয়াটার
ছবি: গার্গী তনুশ্রী পাল

আম, খেজুর, গোলাপ, টিউলিপবাগান—এমন আরও ফুল-ফলের বাগানের নাম শুনেছি; কিন্তু ‘গার্ডেন অব কেইভ’ বা গুহার বাগান—এমন বাগানের নাম আমার শোনা হয়নি আগে। আমাদের গাড়ির চালক যখন আমাদের সেভেন সিস্টার্স ফলস অথবা পার্ক—এ দুয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বললেন, তখন প্রতিনিয়ত আমাদের দেখা পার্কগুলোর চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠল। ফলে স্বভাবতই আমাদের ভোট পড়ল সেভেন সিস্টার্স ফলসের দিকে। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া আর দূরত্ব আমাদের নিয়ে গেল পার্কের দিকে। মনে হলো ফুচকা, চকলেট, বাদাম, ভেলপুরি, ঝালপুরির গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। কিন্তু না; এ পার্ক সে পার্ক নয়। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য যেন কাঁধে কাঁধ রেখে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ২ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে প্রাকৃতিকভাবে গড়া এ পার্কের কোনায় কোনায়।

আরও পড়ুন

পার্কের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে ঘূর্ণমান পায়ে হাঁটার পথ। চুনাপাথর শিলার প্রাকৃতিক ক্ষয় দ্বারা গড়ে উঠেছে যে গুহা; পাথরের ফোকর গলে সেখানে পৌঁছে যায় সূর্যের আলো। কোথাও ঘুটঘুটে অন্ধকার, কোথাও ক্ষীণ আলোয় অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে ঝরনার জল।

চেরাপুঞ্জি যেন এক ‘ভূস্বর্গ’
গার্গী তনুশ্রী পাল

জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে মেঘালয়ের খাসি উপজাতির মানুষেরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এই গুহায় লুকিয়ে থাকত। এই গুহাগুলো তাদের ঝড়বৃষ্টি থেকে রক্ষা করত আর চারপাশের ঘন জঙ্গল থেকে তারা পেত বেঁচে থাকার খাবার। অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে এখানকার শিলাগুলো নানান আকৃতি ধারণ করেছে। যার একটি হৃদয় আকৃতির শিশু শিলা। ঘন বন, বিস্ময়কর গুহা, অবিরাম জলপ্রপাতই শুধু নয়, পাহাড়ের বুক চিরে সুঠাম ধারায় গড়িয়ে পড়ছে সুপেয় ‘মিনারেল ওয়াটার’। ২০১০ সালে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় এ ‘ভূস্বর্গ’।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য গুয়াহাটি। পাহাড়ের বুক চিরে চলে গেছে পিচঢালা পথ। যত দূর চোখ যায়, দুপাশে কেবল সবুজ আর সবুজ। একরাশ মুগ্ধতায় ডুবে থাকি আমরা। গাড়ি ছুটে চলে গুয়াহাটির পথে।

ঢাকা থেকে সাশ্রয়ী, আরামদায়ক, বিলাসী—তিনভাবেই ভ্রমণ করা যায় শিলং-চেরাপুঞ্জি। বর্ষা মৌসুমকেই বলা হয় চেরাপুঞ্জি ভ্রমণের উৎকৃষ্ট সময়।

আরও পড়ুন