‘রূপকথা? ছোঃ, এত বড় হয়ে যাওয়ার পর আবার রূপকথার কচকচি ভালো লাগে নাকি? সেই বাচ্চাকালে লাগত বটে, কিন্তু এখন আর এসব রূপকথা-টুপকথা শোনার বয়স আছে?’ এসব বলে যতই নাক সিটকাও; আমি কিন্তু ঠিক জানি তাবৎ অ্যাসাইনমেন্ট, পরীক্ষা, ক্লাস, হোমওয়ার্ক—এত সব উৎপাতের মধ্যেও যখন কানের কাছে কেউ বলে ওঠে, ‘সে অনেক অনেককাল আগের কথা। এক দেশে ছিল এক রাজপুত্তুর...’ তখন তোমার চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে টগবগ শব্দে ঘোড়া ছুটিয়ে মাঠ কাঁপিয়ে ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাওয়া রাজপুত্র ডালিমকুমার।
কিংবা কোনো এক মন খারাপের বিকেলে যখন কিছু ভালো লাগে না, তখন আকাশের ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে থাকা মেঘের দিকে তাকিয়ে তোমার চোখ ঠিক খুঁজে নেয় লাল কমল আর নীল কমলের শোঁ শোঁ উড়ে যাওয়া পঙ্খিরাজ ঘোড়া আর রাজকন্যা কঙ্কাবতীর পোষা শুকপাখিকে।
শত শত বছর ধরে মনভোলানো ইয়া বড় বড় দাঁত আর এত্ত বড় বড় চোখওয়ালা ভয়ংকর রাক্ষস আর লাল-নীল ফুলপরিদের কথাই বলো বা পশ্চিমের বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট আর মৎস্যকন্যা এরিয়েল কিংবা হালের ফ্রোজেন–এর অ্যানা-এলসা বা হাউ টু ট্রেন ইয়োর ড্রাগন–এর টুথলেস; গল্প, বই, সিনেমা—সব মাধ্যমেই রূপকথার মায়াময় ঘোরমাখানো জগৎ বছরের পর বছর ধরে মুগ্ধ করে রেখেছে ছেলে–বুড়ো সবাইকেই। এত বছরেও এর আবেদন তো কমেইনি, উল্টো ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
আমাদের বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধ লেগে থাকা রূপকথাগুলোর কথাই ধরি। ‘কলাবতী রাজকন্যা’, ‘রূপ-তরাসী’, ‘সাত ভাই চম্পা’ কিংবা ‘শীত-বসন্ত’ গল্পগুলোর নাম শুনলেই তো কেমন আদরমাখা ঘোর লেগে আসে চোখে। পড়তে পড়তে মনে প্রশ্ন জাগে, এই মিষ্টি গল্পগুলো একদম প্রথম কবে বলা হয়েছিল? এদের আদি উৎসই–বা কী?
এই প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজাখুঁজির কম চেষ্টা করেননি গবেষকেরা। পেয়েছেনও। তাঁরা বলছেন, একেক দেশের একেক স্বাদের আর একেক ঘ্রাণের রূপকথা থাকলেও, এর পেছনের ঘটনাটা কমবেশি সব জায়গাতেই একই। ধরে নাও, আমাদের বাংলারই একটা গ্রাম। সময়টা বেশ আগের। আগের মানে অনেক আগের। ‘সে অনেক অনেককাল আগের কথা’ বলতে যে সময়টাকে বোঝায়, তারও আগের জমানা। বাংলায় তখন রাজার রাজত্ব। প্রজারা চাষ করে, নদীতে নৌকা বায়, মাছ ধরে, কাপড় বোনে। বাংলার তো সেই প্রাচীনকাল থেকেই রমরম অবস্থা। চাষিরা যেখানে হাত দেন সোনা ফলে, জেলের জালে মাছ ওঠে রাশি রাশি। কাজকর্ম শেষে রাতের ফকফকা জোছনার আলোয় পা ছড়িয়ে বসে দাদি-নানিরা গল্প শোনান। কাচ্চাবাচ্চারা তো বটেই, তাদের বাবা-মায়েরাও ঘুম ঘুম চোখে এসে বসেন গল্পের মজায়। তাঁদের কাছে স্বপ্নের মানুষ, ভয়ের মানুষ, বিস্ময়ের মানুষ—সবই তো রাজা আর রাজার আশপাশের মানুষেরাই। তাই গল্পের স্বপ্নমাখা মায়ালোক তৈরি করতে গিয়ে গল্পের পাত্রপাত্রীও হয়ে যায় রাজা-রানি, রাজপুত্র-রাজকন্যা, উজিরপুত্র-কোটালপুত্র। স্বপ্নের গল্প বলেই এ গল্পগুলো দেশের হয়েও দেশের নয়, সমাজের হয়েও সমাজের নয়, মানুষের হয়েও শুধু মানুষের নয়। অবিশ্বাস্য আর উদ্ভট সব ঘটনা এখানে ঘটে যায় একনিমেষেই। রাজার কুমারের হৃৎপিণ্ড থাকে বোয়াল মাছের পেটের ভেতরে, মানুষ মুহূর্তেই হয়ে যায় ফুল, দুয়োরানির কোলজুড়ে জন্ম নেয় পশুর ছানা।
তবে সব রূপকথা যে এভাবে মুখে মুখে চলে এসেছে, তা-ও নয়। বাংলা রূপকথার বিরাট একটা অংশের উৎস হচ্ছে সংস্কৃত পঞ্চতন্ত্র ও পালি জাতক। আমাদের পুঁথিসাহিত্যেও থরে–বিথরে ছড়ানো আছে রূপকথার মুক্তা। মধ্যপ্রাচ্যের আরব্য উপন্যাস ও পারস্য উপন্যাস থেকে অনেক গল্প অবলীলায় ঢুকে পড়েছে বাংলার সাহিত্যভান্ডারে। বাংলায় ব্যবসা করতে আর রাজত্ব করতে এসেছে অনেক দেশের অনেক বর্ণের অনেক ভাষাভাষী জাতি, তাদের সঙ্গে এসেছে তাদের আচার, সংস্কার, বিশ্বাস; আর সেই সঙ্গে ঢুকে পড়েছে তাদের রূপকথারাও।
কত রকমের রূপকথা! কোনো রূপকথায় রক্তিম আভা, কোনোটায় নীলাভ আলোর ছটা, কোনোটা হাসিখুশি, কোনোটা গোমড়ামুখো, আবার কোনো কোনোটার বুকে গভীর ক্ষত। এই সব রকমের রূপকথাকে গ্রামবাংলার একদম বুক থেকে তুলে আনার ভারটা প্রথম নেন লালবিহারী দে। তিনি ছিলেন একজন রেভারেন্ড, ধর্মপ্রচারক। এ কাজে বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরতে ঘুরতেই তাঁর মাথায় আসে রূপকথা সংগ্রহের কথা। ১৮৭৫ সালে Folk Tales of Bengal নামে বাংলা রূপকথার একটি ইংরেজি সংকলন প্রকাশ করেন তিনি। ১৯০৭ সালে ঠাকুরমার ঝুলি সম্পাদনা করেন তার উত্তরসূরি দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার। লালবিহারীর পথে লালবিহারীর পরে কাজ করেছেন বলে উত্তরসূরি বলছি বটে, কিন্তু রূপকথা-সাহিত্যে দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের স্থান তাঁরও অনেক ওপরে। সাহিত্যের অভিজাত সমাজে প্রথমবার বাংলার রূপের কথাকে এনে তার মাথায় মুকুট পরানোর কৃতিত্ব দক্ষিণারঞ্জনেরই। তাঁর ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, ঠানদিদির থলে আর দাদামশায়ের থলের মতো বইগুলো গ্রামবাংলার হাট–ঘাটের প্রাণের কথাকে বাংলা কথাসাহিত্যে শক্তপোক্ত জায়গা করে দিয়েছে। অনেক পরে এ নিয়ে আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন আশরাফ সিদ্দিকীও।
রূপকথার দুটি ধরন আমরা সব দেশের সাহিত্য ঘাঁটলেই পাই। একটা ধরন হচ্ছে লোকজ, বংশপরম্পরায় মুখে মুখে প্রবহমান গল্প। আর অন্যটা হলো সাহিত্যিক রূপকথা, রূপকথার লোকজ ধরন-ধারণ মেনে আজকের লেখকের লেখা গল্প। বাংলায় দ্বিতীয় ধরনটির শুরুটা হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর হাত ধরে। তাঁর ‘টুনটুনি’র গল্প তো সবার পড়া। তাঁর দেখানো পথ ধরে এসে বাংলা সাহিত্যে যে কত কত মিষ্টি রূপকথার জাল বোনা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই।
বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিকগুলো আর একালের দারুণ সব বই তো পড়বেই, কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার-থ্রিলারের জগতে বুঁদ হয়ে এক কোণে পড়ে থাকা ঠাকুরমার ঝুলি আর গ্রিম ভাইদের রূপকথাকে কিন্তু ভুলে যেয়ো না। ভেতরের কল্পনাপ্রবণ তুমিটাকে সবুজ–সতেজ রাখতে, স্বপ্নালু রাখতে নিয়মিত রূপকথার ডোজ গেলা খুব খুব জরুরি। ঠাকুরমা-ঠাকুরদার ঝুলি শেষ করে হানা দিতে পারো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুল, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেনের রাজার পোশাক বা কুৎসিত হাঁসের ছানা বা অস্কার ওয়াইল্ডের মন কেমন করা রূপকথার জগতে। আমাদের হুমায়ুন-সত্যজিতের রূপকথার রসে টইটম্বুর গল্প কম বটে, কিন্তু যা আছে, তার সবই সোনা। তাঁদের পড়া হয়ে গেলে তুমি চোখ মেলতে পারো আরও সামনে, চেখে নিতে পারো জাপানের রূপকথা বা ইংল্যান্ডের রূপকথার সংকলন আর ননী ভৌমিকের মিষ্টি অনুবাদের রাশিয়ান রূপকথা। রূপকথার জগতে ছড়ানো অসংখ্য সোনার কাঠি আর রুপার কাঠির ঝলকানিতে তোমার চারপাশ আলোয় আলোয় ভরে উঠুক, উঠুক ঝলমলিয়ে।