দেশের রক ও মেটাল ব্যান্ডগুলো দারুণ একটা সময় কাটাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। একদিকে বছরজুড়ে একের পর এক কনসার্ট, অন্যদিকে গানের অ্যালবাম কিংবা সিঙ্গেল—দুটিই রিলিজ পাচ্ছে সমানতালে।
কয়েক বছর আগেও যেন ডুবতে বসেছিল দেশের ব্যান্ড সংগীত। আর্টসেল, নেমেসিস কিংবা নগরবাউলের মতো পুরোনো ও জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলোকেই শুধু দেখা যেত কনসার্টগুলোতে। তবে এখন বদলেছে পুরো চিত্র। কিশোর-তরুণদের মধ্যে নতুন করে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যান্ড। ইয়ারফোন কিংবা হেডফোনে সেসব ব্যান্ডের গান চলছে লুপে।
এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘কার্নিভাল’। তাদের গান ‘ভ্রম’, ‘আমার সত্য’ কিংবা ‘সেই সব দিনরাত্রি’ জায়গা করে নিয়েছে টিনএজারদের প্লে লিস্টের ওপরের দিকে। কিছুদিন আগে কিআড্ডায় এসেছিলেন কার্নিভাল ব্যান্ডের সদস্যরা, শুনিয়েছেন তাঁদের গল্প।
‘ইন্দ্রালয়’ থেকে ‘মোহমুক্তি’
কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয়তা পেলেও কার্নিভালের শুরুটা প্রায় দেড় যুগ আগে। ২০০৬ সালে যাত্রা শুরুর পর প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ পেতে পেরিয়ে যায় তিন বছর। প্রথম অ্যালবাম ইন্দ্রালয় মুক্তি পায় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। অ্যালবামের নয়টি গানের মধ্যে একটি ছিল ‘আমার সত্য’। স্পটিফাই অ্যাপে ১০ লাখ বার শোনা হয়েছে গানটি, ইউটিউবে সংখ্যাটা ঠিক দ্বিগুণ! ১৪ বছর পর এসেও দারুণ জনপ্রিয় এই গান।
প্রথম অ্যালবামের পর একে একে আরও তিনটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছে কার্নিভাল। আত্মোৎসর্গ (২০১২) ও ডিজফাংশনাল মোশন পিকচার–এর (২০১৪) পর সর্বশেষ ২০২০ সালে মুক্তি পেয়েছে মোহমুক্তি। কার্নিভালের সব কটি অ্যালবামে নয়টি গান থাকলেও মোহমুক্তিতে গান ছিল ছয়টি। মজার ব্যাপার হলো, গান কম হলেও এখন পর্যন্ত এটিই কার্নিভালের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যালবাম।
মোহমুক্তি অ্যালবাম প্রকাশের পরই হু হু করে বাড়তে থাকে কার্নিভালের শ্রোতা, বাড়তে থাকে জনপ্রিয়তা। এই অ্যালবামের গান ‘ভ্রম’ ইউটিউবে শোনা হয়েছে ২৬ লাখ বার, আর স্পটিফাই অ্যাপে ১২ লাখের বেশি!
সংখ্যাগুলো অবাক করা হলেও কার্নিভালের গানগুলো লাখ লাখ বার শোনার হিসাবটা কিন্তু একদমই ভ্রম নয়, পুরোটাই সত্য।
কার্নিভালের মানুষজন
২০০৬ সালে ব্যান্ড প্রতিষ্ঠার পর লাইনআপ বদলেছে বেশ কয়েকবার। এই মুহূর্তে কার্নিভালের যে লাইনআপ, সেটা হয়েছে ২০১০ সালের পর। বর্তমান লাইনআপের সদস্য চারজন। ড্রামার খালিদ আশরাফ, ভোকাল ও গিটারিস্ট তিনু রশিদ, গিটারিস্ট সালমি রহমান এবং বেজ গিটারিস্ট শারার শায়র। ব্যান্ডের আরেকজন গিটারিস্ট মৌসুম ধামাই আছেন দেশের বাইরে। আপাতত চারজন মিলেই চালিয়ে যাচ্ছেন ‘কার্নিভাল’ উৎসব। আর ব্যান্ডের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রুদান আল আমিন।
যেভাবে শুরু
ছোটবেলায় অনেক কিছু হতে চাইতেন এই ব্যান্ডের সদস্যরা। কেউ চেয়েছিলেন কুস্তিগির হতে, কারও আবার শখ ছিল গোয়েন্দা হওয়ার। ফায়ার ট্রাকচালক হয়ে প্যাঁ–পোঁ করে গাড়ি চালানোর ইচ্ছাটাও ছিল একজনের। একটু বড় হতেই রক মিউজিকের প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করে তিনু রশিদদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে শুরু হয় বন্ধুদের সঙ্গে জ্যামিং সেশনে যাওয়া।
কার্নিভালের ড্রামার খালিদ আশরাফের ছোটবেলার একটা গল্প শোনাই তোমাদের। তিনি ড্রামস শিখেছিলেন বাসা থেকে লুকিয়ে। ড্রামস স্টিক কেনার জন্য বাসা থেকে টাকা চাওয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না। তাই কলেজে যাতায়াতের জন্য যে টাকা পাওয়া যেত, সেটা বাঁচিয়েই চলত ড্রামস প্র্যাকটিস। একদিন এলাকার এক অনুষ্ঠানে ড্রামস বাজানোর সময় খালিদ দেখেন, বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর ড্রামস বাজানো শুনছেন। খুব ভয়ে ভয়ে সেদিন বাসায় ফিরেছিলেন খালিদ। অবাক করা ব্যাপার হলো, বাবা সেদিন কিছুই বলেননি। এর পর থেকে সব সময়ই খালিদের গানবাজনার পাশে ছিলেন তাঁর বাবা।
ব্যান্ডের চারজনের বড় হওয়াটা আলাদা হলেও পরিচয়টা এলাকাসূত্রে। চারজনের মধ্যে তিনজনেরই বাসা ছিল ঢাকার মগবাজারে। এলাকায় দেখাসাক্ষাৎ থেকে পরিচয়। তবে চারজন মিলে প্রথম কাজটা ছিল একটি মিক্সড অ্যালবামের। তখন থেকেই তাঁদের মাথায় বাসা বেঁধেছিল একটা ব্যান্ডের স্বপ্ন। তারপর একে একে কার্নিভালে আসা।
এক নাম, দুই বানান
কার্নিভাল ব্যান্ডের ইংরেজি বানানটা বেশ অদ্ভুত। শুরুতে কার্নিভাল লেখা হতো ‘C’ দিয়েই। কিন্তু একটি মিক্সড অ্যালবামে কাজ করার সময় নাম পাল্টানোর প্রয়োজন হয়। কারণ, অ্যালবামের সংগীত প্রযোজনাকারী সংস্থার নামও ছিল কার্নিভাল। বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন ব্যান্ডের সবাই। হুট করে ব্যান্ডের নাম পুরোপুরি বদলে ফেলা তো মুশকিল। এক রাত চিন্তা করে পরদিন অফিসে গিয়ে জানানো হলো কার্নিভালের নাম পাল্টে ফেলা হয়েছে। ‘Carnival’ থেকে বদলে ব্যান্ডের নাম হলো ‘Karnival’।
গানের ভাবনা ও দর্শকদের ভালোবাসা
দারুণ সব গান কীভাবে তৈরি করে কার্নিভাল? প্রক্রিয়াটা কী? উত্তরটা শুনি ব্যান্ডের সদস্যদের মুখে, ‘আমরা শুরুটা করি মিউজিক দিয়ে। তারপর লেখা হয় গানের কথা। গান তৈরির পেছনে লম্বা একটা সময় ধরে আমরা অনেক গান শুনি। নিজস্ব অনুভূতি নিয়ে গান তৈরি করি আমরা। জোর করে গান করাই লাগবে—এমন কোনো চাপ নিতে চাই না।’
নিজেদের অনুভূতির গান শ্রোতাদের মুখে শুনতে কেমন লাগে? ব্যান্ডের সদস্যদের কথাতেই বোঝা গেল, শ্রোতারা তাঁদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, ‘কনসার্টে যখন দর্শকেরা আমাদের সঙ্গে গান গান, আমাদের গান পছন্দ করেন, তখন নিজেদের মধ্যে অন্য রকম একটা তৃপ্তি কাজ করে। আমরা যাঁরা শিল্পী, আমাদের মধ্যে এখনো একটি শিশু বেঁচে আছে, যাকে বলে “দ্য কিড সার্ভাইভড”। আমাদের দর্শকদের সঙ্গে কিন্তু আমাদের বয়সের পার্থক্য অনেক বেশি। তবু আমরা তাঁদের সঙ্গে মিশতে পারি। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?’
নতুন গান, নতুন অ্যালবাম
শেষ অ্যালবাম মোহমুক্তি প্রকাশের পর কেটে গেছে তিন বছরের বেশি সময়। তাই নতুন অ্যালবামের খবর জানতে চেয়েছিলাম একটু আগে আগে। ব্যান্ডের ভোকাল তিনু রশিদ অবশ্য একটু ভিন্ন উত্তর দিয়েছেন, ‘আমাদের অন্যতম জনপ্রিয় গান “ভ্রম” তৈরির পেছনে কাজ করতে হয়েছে প্রায় সাত বছর। একটা গানকে জোর করে শেষ করতে গেলে, সেটা নষ্ট হয়ে যায়। আমরা সেটা চাই না, তাই কোথাও আটকে গেলে আমরা সেটা যেমন আছে, তেমনই রেখে দিয়ে সামনে এগিয়ে যাই। তাই ভালো গান তৈরি করার জন্য সময় প্রয়োজন।’
সময় নিয়ে আরও দারুণ গান আমাদের শোনাক কার্নিভাল। তুমি যদি কার্নিভালের নতুন শ্রোতা হয়ে থাকো, তবে শুনে আসতে পারো তাদের পুরোনো গানগুলো। স্পটিফাই ও ইউটিউবে শোনা যাবে কার্নিভালের সব কটি গান।