কীভাবে এল অলিম্পিক

প্যারিস অলিম্পিকরয়টার্স

কত আর, মাত্র পৌনে তিন হাজার বছর আগের কথা। দেবরাজ জিউস আর মর্ত্যমানবী অ্যাল্কমেনের সন্তান হেরাক্লস দায়িত্ব পেলেন এলিস রাজ্যের রাজা ইজিয়াসের আস্তাবল পরিষ্কার করার। যদিও কাজটা বেশ নিষ্ঠার সঙ্গেই করলেন তিনি, কিন্তু ইজিয়াস হেরাক্লসকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দিতে চাইলেন না। বড়সড় একটা ভুলই হয়ে গেল ইজিয়াসের। ক্ষুব্ধ হেরাক্লস হত্যা করলেন তাঁকে। আর এলিস লুণ্ঠন করে সবকিছু নিয়ে চলে গেলেন পিসা শহরে।

পিসার বেশ কাছেই অলিম্পিয়ার বিশাল বনভূমি। এখনকার মানচিত্রে যাকে পাওয়া যাচ্ছে দক্ষিণ গ্রিসের পেলোপন্নেস পর্বতমালার পশ্চিম উপকূলে। হেরাক্লস এখানেই একটা জায়গা নির্বাচন করলেন, নিজ হাতে জলপাইয়ের চারা লাগিয়ে বোঝাতে চাইলেন, জায়গাটিকে তিনি পবিত্র মানেন। এরপর জায়গাটুকু বেড়া দিয়ে ঘিরে বাইরের অংশে আয়োজন করলেন পিতা জিউসের সম্মানে দৌড় প্রতিযোগিতার আসর।

লিভারপুলে ১৮৬২-১৮৬৭ সালের বার্ষিক ‘গ্র্যান্ড অলিম্পিক ফেস্টিভ্যাল’ আবার আয়োজিত হতো জন হালি আর চার্লস পিয়েরি মেলির উদ্যোগে। উইলিয়াম পেনি ব্রুকস শ্রপশায়ারের মাচ ওয়েনলকে শুরু করেন ওয়েনলক অলিম্পিয়ান গেমস।

গ্রিসের তখনকার নগররাষ্ট্রগুলো থেকে প্রতিযোগীরা তো এলেনই, কেবল দেখার জন্যও এল হাজার হাজার মানুষ। এক স্টাড বা আমাদের মাপে বললে ১৯২ মিটার। সেই দৌড়ে জিতলেন করোবাস, যিনি আবার কাজ করতেন এলিস নগরের রাষ্ট্রীয় রাঁধুনি হিসেবে। তাঁর মাথায় তুলে দেওয়া হলো লরেলপাতার মুকুট। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ পিন্ডারের দাবি, এভাবেই অলিম্পিকের শুরু।

গ্রিক ঐতিহাসিক পসানিয়াসের লেখায় আবার পাওয়া যাচ্ছে, ডাক্টাইল হেরাক্লিস (ইনি কিন্তু দেবতা জিউসের পুত্র নন) তাঁর দুই ভাইয়ের সঙ্গে নেমেছিলেন এক দৌড় প্রতিযোগিতায়। অলিম্পিয়ার পাদদেশ থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতা দিয়েই নাকি শুরু অলিম্পিক! ঘেঁটেঘুঁটে এমন আরও গন্ডাখানেক উপকথা-রূপকথা পাওয়া যায় প্রাচীন অলিম্পিকের সূচনা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত কোনটা সত্যি, তা নিয়ে তর্কবিতর্ক করা যাবে হয়তো, তবে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, গ্রিকরা তখন অলিম্পিককে ধর্মীয় কর্তব্যই ভাবত।

অলিম্পিকের দ্বিতীয় দিনটা যেমন যেত দেবরাজ জিউস আর অলিম্পিয়ার পৌরাণিক রাজা পেলোপন্নেসের সম্মানে বলি দিয়ে। কখন অলিম্পিকের মহোৎসব বসবে, এই দিনক্ষণও ঠিক করা হতো চাঁদ দেখে। আগস্টের শেষাশেষি থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধ—এর মাঝামাঝি ঘটে যাওয়া গ্রীষ্মকালীন অয়নকালের পর দেখতে পাওয়া দ্বিতীয় পূর্ণ চাঁদের দিন, এমন জটিল হিসাব-নিকাশ শেষেই বসত অলিম্পিকের আসর। প্রথম দিককার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত কেবল জন্মসূত্রে গ্রিকরাই। তবে প্রথমে মেসিডোনিয়া আর পরে রোম যখন গ্রিস জয় করল, তারপর ১০ সদস্যের এক অলিম্পিক কমিটি নিয়মটায় একটু শিথিলতা আনল, ‘গ্রিক হতে হবে না বাপু। গ্রিক ভাষা বলতে পারলেই হবে।’

প্যারিস অলিম্পিক সমাপনী অনুষ্ঠান
রয়টার্স

প্রথম ১৩ আসরে কেবল দৌড় প্রতিযোগিতাই হতো। আর দৌড়ে বিজয়ীরা বনে যেতেন রীতিমতো নায়ক, অলিম্পিকের পরবর্তী আসর বসত তাঁদের নামে। গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোর কাছেও অলিম্পিক ছিল মর্যাদার লড়াই। সারা বছর তো যুদ্ধবিগ্রহ করেই নতুন নতুন রাজ্য জয়ের ফন্দি আঁটতেন তাঁরা, তবে অলিম্পিকের সময়ে সব ধরনের যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল। যে কারণে অলিম্পিক জয়টাও নিজেদের প্রতিপত্তি বোঝানোর একটা মাধ্যম ভাবতেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

এত ধর্মীয়, সামাজিক প্রভাব জড়িয়ে যার সঙ্গে, সেটা যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে, তা আর আশ্চর্য কী! সেটা প্রতিযোগীর সংখ্যায় যেমন, তেমনি খেলার পরিধিতেও। ধীরে ধীরে দৌড়ের সঙ্গে কুস্তি যোগ হলো, এল ঘোড়দৌড়, বক্সিং, চাকতি নিক্ষেপ, বর্শা নিক্ষেপও। প্রতি চার বছর পরপর বসত অলিম্পিকের আসর, মধ্যবর্তী সময়টাকে বলা হতো অলিম্পিয়াড। এমনও শোনা যায়, তখনকার দিনে গ্রিকরা দিন-তারিখ গণনা করত এই অলিম্পিয়াড ধরেই।

এই করে করে খ্রিষ্টপূর্ব ৬ থেকে ৫ শতক সময়টায় অলিম্পিক দেখল উত্থানের চূড়া। তবে পতন দেখতেও সময় লাগেনি। রোমানরা গ্রিস জয় করল যখন, তখন থেকেই পাগানদের সব কৃষ্টি-সংস্কৃতির চর্চা বন্ধে উঠেপড়ে লাগল। বাদ গেল না অলিম্পিকও। সময়ব্যাপ্তি নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে, তবে বেশির ভাগের মতেই সময়টা ৩৯৩ খ্রিষ্টপূর্ব সাল। ব্যস, এভাবেই লেখা হলো প্রাচীন অলিম্পিকের ইতি।

***

তবে দৌড়ানো, চাকতি ছোড়ার মতো খেলাধুলা তো আর বন্ধ করা যায়নি কখনোই। কেবল এক ছাতার নিচে পুরো অ্যাথলেটকে আনা যাচ্ছিল না। সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ আইনজীবী রবার্ট ডোভার বেশ কিছু খেলা নিয়ে ‘কটসওল্ড গেমস’ নামে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন, আধুনিক অলিম্পিকের পূর্বসূরি বলা যায় যাঁকে। ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের পর, ১৭৯৬-১৭৯৮ সালে বার্ষিকভাবে ফ্রান্সেও বসেছিল এমন ‘হরেক রকমের খেলার মিলনমেলা’ আসর। ১৭৯৬ সালের সেই আসর থেকেই ক্রীড়াক্ষেত্রে শুরু হয় মেট্রিক সিস্টেমের ব্যবহার।

পরের শতকে এ রকম আয়োজন ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের অনেক দেশেই। তবে আয়োজনগুলো হতো ব্যক্তিগত উদ্যোগেই। সুইডেনের স্টকহোম আর র৵াম্লোসায় অলিম্পিক আয়োজিত হতো গুস্তাফ জোহান আর তাঁর সঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষকতায়। লিভারপুলে ১৮৬২-১৮৬৭ সালের বার্ষিক ‘গ্র্যান্ড অলিম্পিক ফেস্টিভ্যাল’ আবার আয়োজিত হতো জন হালি আর চার্লস পিয়েরি মেলির উদ্যোগে। উইলিয়াম পেনি ব্রুকস শ্রপশায়ারের মাচ ওয়েনলকে শুরু করেন ওয়েনলক অলিম্পিয়ান গেমস।

আরও পড়ুন

তবে এর কোনোটাই নয়, আধুনিক অলিম্পিকের সূচনা মানা হয় ১৮৯৬ সালে গ্রিসে বসা আসরকে। গ্রিকরা অলিম্পিক ফেরাতে চাইছিল অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় থেকেই। ১৮৩৩ সালে গ্রিক কবি প্যানাগিওটিস সুৎসোস তাঁর ‘ডায়ালগ অব দ্য ডেড’ কবিতায় লেখেন অলিম্পিকের পুনরুত্থান ঘটানোর আরজি। গ্রিক ধনকুবের ইভানজিওলস জাপ্পাস কিং অটো অব গ্রিসকে লেখা চিঠিতে জানান, অলিম্পিক গেমস আয়োজনের যাবতীয় খরচপাতি বহন করতে তিনি রাজি। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই ১৮৫৯ সালে এথেন্সের সিটি স্কয়ারে বসে অলিম্পিক গেমসের প্রথম আসর। অলিম্পিকে জাপ্পাসের অবদান এখানেই শেষ নয়, প্যানাথেনিয়াক স্টেডিয়াম সংস্কার করেন গাঁটের পয়সা খরচ করে, যেন অলিম্পিকের পরবর্তী আসরগুলো সেখানেই হতে পারে।

আরও পড়ুন

এরপরই দৃশ্যপটে আগমন ব্যারোঁ পিয়েরি দ্য কুবার্তির। ১৮৯০ সালে ওয়েনলক অলিম্পিয়ান সোসাইটির আয়োজন দেখে তাঁর মনে আসে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি গঠনের ভাবনা। এর চার বছর পর সত্যি সত্যি গড়েও ফেলেন কমিটি। ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসে হওয়া অলিম্পিক কমিটির প্রথম কংগ্রেসেই ঠিক হয়, ১৮৯৬ সালে এথেন্সে বসবে অলিম্পিকের আসর। প্রাচীন অলিম্পিকের সঙ্গে মিল রেখে এবারও অলিম্পিক আসবে চার বছর পরপর।

মাঝখানে বিশ্বযুদ্ধের জন্য তিনটি আসর বাদ দিলে অলিম্পিক এই নিয়মই মেনে চলেছে এখন পর্যন্ত। ওহ, আরেকবার নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিক হয়েছিল এর পরের বছর। কারণটা তুমিও আন্দাজ করতে পারছ নিশ্চয়ই। তখন কোভিড-১৯ এসেছিল।

আরও পড়ুন