কারাগার বললে চোখের ভেতর কেমন ছবি ভেসে ওঠে তোমাদের? সাজা পাওয়া অপরাধীরা গাদাগাদি করে লোহার শিকের ভেতর আটকে আছেন, শিকের ভেতর থেকে একটু বাইরে বের হতে কেউ হয়তো ক্রমাগত দরজায় ধাক্কাধাক্কি করছেন; কেউ পালানোর চেষ্টা করছেন। আর এই অপরাধীদের পাহারায় আছেন অস্ত্রধারী অসংখ্য কারারক্ষী—ছবিটা এমনই তো, নাকি! কিন্তু এই কারাগারে এসবের কোনো বালাই নেই। নেই লোহার শিক। চারদিক শান্ত। এখানে যে অপরাধীরা বন্দী থাকেন, কারাগারের ভেতর তাঁরা বিলাসবহুল জীবন কাটানোর সুযোগ পান। সর্বোচ্চ সুরক্ষিত এই কারাগার থেকে কোনো বন্দী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কোনো দিন। তাঁদের অধিকাংশই এখানে আনন্দ নিয়ে থাকেন। এমনকি এখানে নেই কোনো অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী। জানো কি, কোথায় এই বিলাসী কারাগার?
নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে সড়কপথে কয়েক ঘণ্টার পথ। যবখেত, খামার, পাইনের বন পেরিয়ে শহরের শেষ দিকে প্রায় ৭৫ একর জমির ওপর নির্মিত এই কারাগার। এই কারাগারের নাম হ্যালডেন প্রিজন। বন্দীদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্য নিয়ে নরওয়ের তৃতীয় বৃহত্তম কারাগারটি ২০১০ সালে নির্মিত হয়। বলা হচ্ছে, এটিই বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক কারাগার। এটি নরওয়েজিয়ান বিচারব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে, যেখানে কয়েদিদের শাস্তির পরিবর্তে পুনর্বাসনের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়।
প্রকৃতির কাছাকাছি এই কারাগার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৩৮ মিলিয়ন পাউন্ড। বর্তমান অর্থমূল্যে যা প্রায় ১ হাজার ৮৯২ কোটি ৬৯ লাখ ৭১ হাজার ১৮৩ টাকা। বন্দীদের কারাবাসের অনুভূতি কমাতে ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ কমাতে এবং তাঁদের মানসিকতা আশপাশের প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য বিশেষ নকশায় তৈরি করা হয়েছে এই কারাগার। এই নকশার কারণে ২০১০ সালেই কারাগারটি আর্নস্টেইন আর্নেবার্গ পুরস্কার জিতেছে।
২০১০ সালের ১ মার্চ হ্যালডেন কারাগারে প্রথম বন্দী রাখা শুরু হলেও ওই বছরের ৮ এপ্রিল নরওয়ের তৎকালীন রাজা পঞ্চম হ্যারল্ড আনুষ্ঠানিকভাবে এই কারাগারের উদ্বোধন করেন। এই কারাগারে একসঙ্গে ২৪৮ থেকে ২৫২ জন কয়েদি থাকতে পারেন। প্রত্যেক বন্দীর জন্য ১১০ বর্গফুটের নিজস্ব সেল (ছোট ঘর) আছে। প্রতিটি সেলের সঙ্গে টয়লেট, গোসলের শাওয়ার, একটি ফ্রিজ, আলমারি, টেবিল, ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি আছে। এ ছাড়া সেল থেকে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। সব কয়েদির জন্য আছে সোফা ও সুসজ্জিত রান্নাঘর। যদিও এই কারাগার থেকেই কয়েদিদের খাবার সরবরাহ করা হয়, তারপরও কোনো কয়েদি চাইলে আলাদাভাবে বাজার করে নিজে নিজে রান্না করে খেতে পারেন। এই কারাগারে একজন কয়েদির এক রাত থাকতে কর্তৃপক্ষের খরচ হয় প্রায় ৪৪ হাজার টাকা (৩২০ পাউন্ড)। আর বছরে এই কারাগারের পেছনে খরচ হয় প্রায় ১ কোটি ৫৯ লাখ ৯ হাজার ৬২৮ টাকা (১ লাখ ১৬ হাজার পাউন্ড)। যেখানে যুক্তরাজ্যে একটি জায়গার গড় খরচ প্রায় ৬১ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৮ টাকা (৪৫ হাজার পাউন্ড)।
হ্যালডেন কারাগারের প্রধানকে বলা হয় গভর্নর। এই কারাগারের গভর্নর হলেন আরে হোইদল। তিনি বলেন, ‘এই কারাগারে কয়েদিদের স্বাভাবিকতার ধারণা দেওয়া হয়। দেয়ালের পেছনের জীবন যতটা সম্ভব দেয়ালের বাইরের জীবনের মতো হওয়া উচিত। তাঁরা যখন মুক্তি পাবেন, তখন তাঁরা যেন স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন, সে বিষয়ের ওপর এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা বন্দীদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিই। কেউ মেকানিকস, কেউ কার্পেন্টার, কেউবা শেফ হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করেন।’
বন্দীরা ক্ষুব্ধ হন না? তাঁরা সহিংস হয়ে ওঠেন না? এ প্রশ্নের জবাবে হোইদল বলেন, ‘আমরা সহিসংতা চাই না। আমরা শান্ত ও শান্তিপূর্ণ বন্দী চাই। বন্দীরা এখানে শেষ কবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তা আমাদের মনে নেই। কারণ রক্ষী ও বন্দীরা এখানে একসঙ্গে কাজ করেন। তাঁরা একসঙ্গে খান, একসঙ্গে ভলিবল খেলেন এবং একসঙ্গে অবসর সময় কাটান। বিষয়টি বন্দীদের শান্ত থাকতে ও সংশোধিত হতে অনুপ্রাণিত করে।’
হোইদল বলেন, এই কারাগারকে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের একটি আবাসিক হোটেলের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যদিও ওই সব হোটেলের কক্ষগুলো এই কারাগারের সেলের চেয়েও ছোট ও কম সুন্দর।
নরওয়ের আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বলে কিছু নেই। এই দেশে সর্বোচ্চ সাজা ২১ বছর। এখানে সব অপরাধীই একদিন মুক্তি পেয়ে যান। এই দেশে কারাগারে মূলত শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের দিকে জোর দেওয়া হয়।
হ্যালডেন কারাগারে প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় বন্দীদের সেলের তালা খুলে দেওয়া হয়। সোয়া আটটার মধ্যে নিজ নিজ কাজ শুরু করতে হয়। বিকেলে এক ঘণ্টা বিশ্রাম। আর রাত সাড়ে আটটায় আবার সেলে বন্দী রাখা হয়।
এখানকার কয়েদিদের জন্য আছে জগিং ট্র্যাক ও রক ক্লাইম্বিং দেয়াল। আছে ইংরেজি শেখানোর প্রশিক্ষক। এ ছাড়া এখানে কয়েদিরা হস্তশিল্পসহ নানা রকম কাজ শিখতে পারেন। কাঠ ও পাথর খোদাইয়ের কাজ থেকে শুরু করে গান শেখানো ও রান্না শেখানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে বন্দীদের জন্য। এসব কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য তাঁদের অর্থও দেওয়া হয়। গ্রাফিক ডিজাইন স্টুডিও ছাড়াও আছে মিক্সিং স্টুডিও। এই স্টুডিওতে বন্দীরা গান রেকর্ড করেন। এসব গান স্থানীয় একটি রেডিও স্টেশন প্রতি মাসে সম্প্রচার করে। কারারক্ষী ও বন্দীদের সমন্বয়ে একটি ব্যান্ড দল ছাড়াও আছে সুসজ্জিত স্পোর্টস টিমও। টিভি দেখা ও ভিডিও গেমসও খেলেন তাঁরা।
হত্যা মামলায় ১৫ বছরের সাজাপ্রাপ্ত ফ্রেডরিক এই কারাগারে আসার পর গ্রাফিক ডিজাইন স্টুডিওতে কাজ শিখেছেন। আটটি পরীক্ষায় পাস করে এ বিষয়ে ডিপ্লোমাও অর্জন করেছেন। তিনি বলেন, ‘অযথা বসে থেকে কী লাভ। এর চেয়ে বরং এই কাজ শিখলে মুক্তির পর একটা ভালো চাকরি পাওয়া যাবে।’
হ্যালডেন কারাগার কয়েদিদের সঙ্গে তাঁদের পারিবারিক যোগাযোগও নিশ্চিত করে। প্রতি তিন মাসে একবার সন্তানদের সঙ্গে থাকতে বন্দীরা ‘ড্যাডি ইন প্রিজন’ প্রকল্পে আবেদন করতে পারেন। এরপর তাঁদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পরীক্ষায় পাস করতে হয়। পাস হলে তাঁরা তাঁদের সঙ্গী ও সন্তানদের সঙ্গে কারাগারের মধ্যে একটি আরামদায়ক বাসায় কয়েক দিন কাটাতে পারেন। বন্দীদের সন্তানেরা কারাগারে এসে যেন খেলাধুলা ও পড়াশোনা করতে পারে, সে ব্যবস্থাও আছে এখানে। আছে পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগও।
হোইদল বলেন, এই কারাগারকে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের একটি আবাসিক হোটেলের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যদিও ওই সব হোটেলের কক্ষগুলো এই কারাগারের সেলের চেয়েও ছোট ও কম সুন্দর।
হ্যালডেনে দীর্ঘদিন ধরে থাকা একজন বয়স্ক বন্দী বলেন, ‘হ্যালডেনে থাকা অন্য কারাগারের চেয়ে স্বস্তির। অনেকে মনে করে, পাঁচ তারকা হোটেলে আছি। কিন্তু জেল মানে তো জেলই। তাঁরা এখানে মূলত আমাদের আটকে রেখেছে।’
হ্যালডেন কারাগারে ২৫২ জন কয়েদির জন্য ২৯০ জন কর্মী আছেন। এর মধ্যে ১৯০ জন কারা কর্মকর্তা। কারারক্ষীদের ৫০ শতাংশই নারী। অন্যরা কর্মশালার প্রশিক্ষক, শিক্ষক ও প্রশাসক হিসেবে কাজ করেন। এখানকার কারারক্ষীর ভূমিকা যুক্তরাজ্যের কারারক্ষীর ভূমিকার চেয়ে আলাদা। যুক্তরাজ্যে কারা কর্মকর্তারা কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন। কিন্তু নরওয়েতে একজন কারা কর্মকর্তাকে দুই থেকে তিন বছর প্রশিক্ষণ নিতে হয়। অসলোয় নরওয়েজিয়ান সংশোধনমূলক পরিষেবার ইউনিভার্সিটি কলেজ আছে। এখানে প্রতিবছর ১ হাজার ২০০ জনের বেশি আবেদনকারীর মধ্য থেকে নির্বাচিত মাত্র ১৭৫ জন কারা কর্মকর্তা হওয়ার জন্য পড়াশোনা করার সুযোগ পান।