গ্রিক পুরাণের ৫ কিংবদন্তি

গ্রিক পুরাণ মূলত দেব–দেবী ও জাদুকরি প্রাণী নিয়ে গল্প ও কিংবদন্তির সংকলন। এসব কিংবদন্তি গল্প হিসেবে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়েছে। শক্তিশালী হারকিউলিস, দেবরাজ জিউস, পঙ্খিরাজ ঘোড়া পেগাসাস কিংবা পাতালের দেবতা হেডাস—সবই গ্রিক পুরাণের চরিত্র। এসব চরিত্র নিয়ে যুগে যুগে লেখা হয়েছে আরও হাজারো গল্প, উপন্যাস কিংবা মহাকাব্য। তৈরি হয়েছে মুভি। আধুনিক যুগেও এসব কিংবদন্তি নিয়ে মানুষের আগ্রহ মিইয়ে যায়নি; বরং নানা রঙে নানা ঢঙে বলা হয়েছে বারবার।

হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছিল গ্রিক পুরাণের গল্পগুলো। কে বা কারা এসব রচনা করেছেন, তার সঠিক তথ্য ইতিহাসে তেমন পাওয়া যায় না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে গল্পগুলো। এসব গল্পের বেশির ভাগজুড়েই ছিল ভয়ংকর সব যুদ্ধের বর্ণনা। কখনো মানুষ, কখনো দেব–দেবীরা লড়ছেন ভয়ংকর সব প্রাণীর বিরুদ্ধে। বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা, নৈতিকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে এসব কাহিনিতে। গ্রিক পুরাণে দেখা যায়, মানুষের মতো দেবতাদেরও কর্মফল ভোগ করতে হয়। ভালো কাজের জন্য পুরস্কার আর খারাপ কাজের জন্য তিরস্কার জোটে তাঁদের ভাগ্যে। অর্থাৎ এসব গল্পে মানবসমাজের প্রতিচ্ছবিই পাওয়া যায় স্পষ্টভাবে। গ্রিসের বিভিন্ন মন্দির ও মাটি খুঁড়ে পাওয়া নানা পুরাকীর্তিতে পাওয়া গেছে অনেক গল্পের বর্ণনা। প্রাচীন গ্রিসের ধর্মচর্চার বড় একটা অংশজুড়ে ছিল এসব কিংবদন্তি। চলো, গ্রিক পুরাণের পাঁচটি কিংবদন্তি নিয়ে জানি।

থিসাস ও মিনোটার

এ যুদ্ধের খলনায়ক মিনোটার নামের এক দানব, যার শরীর মানুষের মতো হলেও মাথা ছিল ষাঁড়ের। পাতালের গোলকধাঁধায় বাস করত ভয়ংকর এই দানব। তার হাত থেকে রক্ষা পেতে রাজ্যের লোকেরা নির্দিষ্ট সময় পরপর নিজেদের সন্তান রেখে আসত গোলকধাঁধার মধ্যে। মিনোটার এক এক করে খেয়ে ফেলত সেসব শিশুকে।

গোটা রাজ্যে ভীষণ আতঙ্ক বিরাজ করছিল। রাজা থিসাস সিদ্ধান্ত নেন, আর নয়, এবার নিজেই যাবেন দানবকে শেষ করতে। কিছু সৈন্য সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে গেলেন গোলকধাঁধায়। দেখাও পেলেন দানবের। বিশাল আকারের ষাঁড়মানব শিং বাঁকিয়ে ছুটতে লাগল রাজার দিকে। রাজা থিসাসও কম যান না। চকিতে সরে গিয়ে নিজের তরবারিটা আমূলে বিদ্ধ করে দিলেন মিনোটারের হৃৎপিণ্ডে। হতভাগ্য মিনোটার মুহূর্তেই মারা যায়। রাজা বন্দী শিশুদেরও উদ্ধার করেন। কিন্তু ভয়ানক সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরোবেন কীভাবে? রাজা থিসাস যেমন সাহসী, তেমনি ছিলেন বুদ্ধিমান। গোলকধাঁধায় ঢোকার সময় সুতা বেঁধে এসেছিলেন প্রবেশপথে। সেই সুতা ধরেই আবার ফিরে চললেন শিশুদের নিয়ে। নিরাপদে বেরিয়ে এসে শিশুদের ফিরিয়ে দিলেন যার যার মা-বাবার কাছে। রাজ্য থেকে কেটে গেল আতঙ্কের মেঘ।

সিলা, ক্যারাবডিস ও ওডিসিয়াসের যুদ্ধ

প্রাচীন গ্রিসের সমুদ্রের এক সরু প্রণালিতে থাকত দানব সিলা ও ক্যারাবডিস। প্রকাণ্ড সাপের মতো ছয়টি মাথার জাদুকরি প্রাণী সিলা। সামনে জাহাজ বা নৌযান পড়লেই তা মাথার বাড়িতে ধ্বংস করে দিত সে। আর ক্যারাবডিস তৈরি করত ঘূর্ণিপাক। কোনো মানুষই তাদের সামনে পড়ে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারত না।

ভয়ংকর এই দুই প্রাণীর সামনে একবার পড়ে গেলেন রাজা ওডিসিয়াস। হঠাৎ প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্র উত্তাল হলো ক্যারাবডিসের তাণ্ডবে। কিন্তু ঘাবড়ে যাওয়ার লোক নন ওডিসিয়াস। ত্বরিতবেগে জাহাজ তীর ঘেঁষে চালানোর নির্দেশ দিলেন নাবিকদের। ঝড়ের মধ্যে ওডিসিয়াসের জাহাজ সিলাকে পাশ কাটিয়ে চলতে লাগল দ্রুতবেগে। কিন্তু সিলাও ছাড়ার পাত্র নয়। জাহাজ থেকে একযোগে ছয় মাথা দিয়ে গিলে নিল ছয়জন নাবিককে। ভয় পেলেও অন্য নাবিকেরা দক্ষতার সঙ্গে জাহাজকে নিয়ে আসে প্রণালির বাইরে। প্রথমবারের মতো সিলা ও ক্যারাবডিসের হাত থেকে বেঁচে যান রাজা ওডিসিয়াস ও তাঁর দল। পরের রাস্তাটুকুতে আর বিপদে পড়তে হয়নি। নিরাপদে ঘরে ফেরেন তাঁরা সে যাত্রায়।

হেরাক্লিস ও হাইড্রার যুদ্ধ

গ্রিক পুরাণে ৯ মাথার এক ভয়ংকর সাপের নাম হাইড্রা। জলাভূমিতে বাস করত। আর হেরাক্লিস বা হারকিউলিস ছিলেন গ্রিক দেবতা জিউসের সন্তান। তবে পুরোপুরি দেবসন্তানের মর্যাদা ছিল না তাঁর। মা মানুষ হওয়ায় হেরাক্লিস দেবতাদের মতো অমরত্ব পাননি। অমরত্বের জন্য হেরাক্লিসকে ১২টি কঠিন কাজ দেওয়া হয়। এর একটা ছিল হাইড্রাকে পরাস্ত করা।

আরও পড়ুন

হাইড্রার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আগুনের বর্শা ছুড়ে মারেন হেরাক্লিস। জবাবে হাইড্রা হেরাক্লিসকে আক্রমণ করতে এলে তরবারি দিয়ে কেটে ফেলেন মাথা। কিন্তু মরে যাওয়ার বদলে হাইড্রার কাটা মাথা থেকে গজিয়ে ওঠে আরও দুটি মাথা। আসলে হাইড্রার জাদুকরি শক্তি ছিল এটি। যতবারই মাথা কাটা হোক না কেন, দ্বিগুণ হয়ে গজিয়ে যাবে সেটা।

যাহোক, হেরাক্লিসের সঙ্গে ছিল বন্ধু লোলাস। হাইড্রার মাথা গজানো বন্ধ করার একমাত্র অস্ত্র হলো আগুন। হেরাক্লিস হাইড্রার মাথা কাটার সঙ্গে সঙ্গে কাটা স্থান আগুনে পুড়িয়ে দিতে থাকে লোলাস। দীর্ঘ সময় ধরে এ বহুমুখী দানবের সঙ্গে এভাবে লড়াই করে দুই বন্ধু। অবশেষে একসময় পরাজিত হয়ে মারা যায় হাইড্রা। বিজয়ের আনন্দ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে দুই বন্ধু।

বেলারফোন ও পেগাসাসের বীরত্ব

ছাগলের দেহ, পিঠের ওপর ছাগলের মাথা, লেজের জায়গায় বিষধর সাপ আর মুখটা সিংহের মতো—এ–ই ছিল কাইমেরার দৈহিক গঠন। ভয়ংকর এই দানব মুখ দিয়ে ড্রাগনের মতো আগুন বের করতে পারত। রাজ্যের রাজা এ দানবকে মারতে বেলারফোনকে পাঠান। বেলারফোন তাঁর উড়ন্ত ঘোড়া পেগাসাসকে নিয়ে কাইমেরাকে হত্যা করতে বেরিয়ে পড়েন। কাছে গিয়ে বেলারফোন আকাশ থেকে তির আর বর্শা ছুড়তে থাকেন কাইমেরার দিকে। ভয়ংকর এক যুদ্ধের পর বেলারফোন জয়ী হন। মারা যায় কাইমেরা।

পার্সিসাস ও মেডুসার লড়াই

গ্রিক পুরাণের অন্যতম দানব মেডুসার মাথায় চুলের বদলে লিকলিক করত অজস্র সাপ। ছিল ভয়ংকর দাঁত। চোখের দৃষ্টিতে ছিল ভয়ংকর জাদুকরি শক্তি। কেউ সে চোখের দিকে তাকালে সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হতো পাথরের মূর্তিতে।

রাজাকে খুশি করার জন্য পার্সিসাস নামের এক যোদ্ধা এই দানবকে হত্যা করতে বেরিয়ে পড়েন। মেডুসার আবাসস্থলে ঢোকার আগে জাদুর শিরণাস্ত্র পড়ে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলেন পার্সিসাস। এরপর চুপিসারে পৌঁছে যান ঘুমন্ত মেডুসার পাশে। চেহারার দিকে সরাসরি তাকালেই যে পাথর হওয়ার আশঙ্কা আছে, এ কথা জানতেন তিনি। তাই পার্সিসার তাঁর চকচকে ঢাল ব্যবহার করে মেডুসার মাথার দিকে তাকান। এরপর তরবারির কোপে আলাদা করে ফেলেন মেডুসার মাথা। প্রমাণ হিসেবে সেটা ব্যাগে পুরে নিজের জাদুকরি উড়ন্ত জুতা পায়ে ফিরে আসেন নিজ রাজ্যে।

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি কিডস ম্যাগাজিন