কেমন হবে নতুন শিক্ষাপদ্ধতি
তোমাদের জন্য অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। ইতিমধ্যে তোমরা নিশ্চয় শুনেছ, আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে আগামী বছর। তা হলো শিক্ষা খাতের আমূল পরিবর্তন। যেখানে বদলে যাবেন শিক্ষক, বদলে দেবেন শিক্ষার্থীর জ্ঞান-দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জনের প্রক্রিয়া, যেখানে পাল্টে যাবে শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, পাঠ্যবই, পরীক্ষা, মূল্যায়নপদ্ধতিসহ আরও অনেক কিছু। আর এ বিষয়গুলো তোমাদের জানাতেই আজকের এ আয়োজন।
তোমরা হয়তো জানো, ‘শিক্ষাক্রম’ (Curriculum) হলো একটি দেশের শিক্ষা খাতের সংবিধান। সময়ের প্রয়োজনে, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, সংস্কার বা পরিমার্জনের প্রয়োজন হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিনবার (১৯৭৬, ১৯৯৫, ২০১২) এ কাজ করা হয়েছে। এবার ২০২৩ সালে চতুর্থবারের মতো নতুন শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যেখানে এই প্রথম প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অভিন্ন শিক্ষাক্রমে প্রচলিত উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তে যোগ্যতাভিত্তিক শিখন ও মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নতুন যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া।
কবে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম
নতুন রূপরেখা অনুসারে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে ২০২৩ সালে। এ বছর প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। এরপর ধাপে ধাপে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষাক্রম চালু হবে ২০২৪ সালে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে স্কুলপর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে নতুন এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আনা হবে। এরপর ২০২৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে আর ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম।
পাঠ্যবই কেমন হবে?
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক সব স্তরের পাঠ্যবইয়ে কমবে মুখস্থ করার প্রবণতা। এর পরিবর্তে বেশি থাকবে বিশ্লেষণমূলক আর অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন কার্যক্রম। আগের মতো তথ্য দিয়ে ভরপুর থাকবে না বইগুলো। যেমন গল্প-কবিতার লেখক পরিচিতিতে সাল, তারিখ ধরে বিস্তারিত থাকবে না। বইয়ের বিন্যাসগত এবং ছবি ও অলংকরণেও থাকবে পরিবর্তন। শিক্ষার্থীরা যাতে পাঠ্যবইয়ে চারপাশের বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রতিফলন পায়, তার উল্লেখ থাকবে। বর্তমান সময়, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অনেক বিষয়, যা শিক্ষার্থীদের জীবন-দক্ষতা অর্জনে অপরিহার্য, সেগুলো পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখে প্রথম শ্রেণি ও ষষ্ঠ শ্রেণির বইগুলো লেখা হয়েছে। অন্যান্য শ্রেণির বই লেখার কাজও চলছে পুরোদমে। এদিকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে মাধ্যমিক স্তরের ৬১টি স্কুল ও মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণির নতুন বই দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে এই কার্যক্রম। প্রাথমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর লেখা প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করা হবে এ বছরের আগস্টের শেষ সপ্তাহে বা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। এ কার্যক্রম চলবে ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে আগামী বছর প্রথম শ্রেণিতে পরীক্ষামূলক সংস্করণের পাঠ্যবই দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। সারা বছর এর ওপর প্রতিবেদন নিয়ে ২০২৪ সালের জন্য চূড়ান্ত করা হবে। এভাবে ধাপে ধাপে ২০২৭ সালের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী সব শ্রেণির জন্য নতুন পাঠ্যবই প্রণীত হবে।
কী কী বিষয় পড়তে হবে
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক: প্রাক্-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরাই শ্রেণিকক্ষে শেখাবেন। নতুন শিক্ষাক্রমে ভাষা ও যোগাযোগসহ শেখার জন্য যে ১০টি ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো শিক্ষকেরা ‘শিক্ষক গাইডের’ আলোকে এই স্তরের শিক্ষার্থীদের সমন্বিতভাবে অনুশীলন করাবেন। তবে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর জন্য আটটি বিষয় ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি। তবে সব বিষয়ের জন্য শিক্ষার্থীরা বই পাবে না। এর মধ্যে এখনকার মতো প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই পাবে। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতেও এখনকার মতো ছয়টি বই থাকবে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং ধর্মশিক্ষা। বাকি দুটি বিষয় শিক্ষকেরা ‘শিক্ষক গাইড’–এর আলোকে পড়াবেন।
মাধ্যমিক: বর্তমান শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু অভিন্ন বিষয়ের বই সব শিক্ষার্থীকেই পড়তে হয় এবং নবম শ্রেণিতে গিয়ে তারা বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকেই ১০টি অভিন্ন বই পড়তে হবে। সেগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম, স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। আগের মতো বাংলা প্রথম পত্র, বাংলা দ্বিতীয় পত্র কিংবা ইংরেজি প্রথম পত্র ও ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র—এ রকম আলাদা বই বা পত্র থাকছে না। প্রথম পত্র ও দ্বিতীয় পত্র মিলিয়েই একটি বই ও একটি পত্র। একইভাবে পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান মিলে ‘বিজ্ঞান’ এবং সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিত মিলে হচ্ছে ‘গণিত’ বিষয়। অন্য বিষয়গুলো অনেকটা আগের মতো থাকলেও নতুন হিসেবে যুক্ত হচ্ছে ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ নামক বিষয়।
উচ্চমাধ্যমিক: এই স্তরের শিক্ষার্থীরা একাদশ ও দ্বাদশ মিলে দুই বছরে ছয়টি বিষয়ের মোট ১২টি পত্রের ওপর পড়াশোনা করবে, এর মধ্যে বাংলা, ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি—এই তিনটি বিষয় সব শিক্ষার্থীর জন্যই আবশ্যিক। দশম শেষ করে একাদশ শ্রেণিতে ওঠার সময়ই শিক্ষার্থী তার পছন্দ ও যোগ্যতা অনুযায়ী বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার যেকোনো একটি শাখা প্রধান হিসেবে বেছে নেবে। প্রতিটি শাখার মধ্যে অনেকগুলো বিষয়ের গুচ্ছ থাকবে। প্রতিটি বিষয়ের আবার তিনটি করে পত্র থাকবে। যেমন বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীরা পদার্থ, রসায়ন, গণিত ও জীববিজ্ঞান থেকে যেকোনো তিনটি বিষয় পছন্দ করতে পারবে এবং প্রতিটি বিষয়ের জন্য প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্র থাকবে। তবে মজার ব্যাপার হলো, ইংলিশ মিডিয়ামের ‘ও’ লেভেলের মতো উচ্চমাধ্যমিকে আবশ্যিক বিষয় বাদে নৈর্বাচনিক বিষয়ের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী চাইলে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার যেকোনো শাখা থেকে যেকোনো বিষয় নিয়েও পড়ার সুযোগ পাবে। অর্থাৎ কেউ বিজ্ঞানের বিষয়গুচ্ছকে প্রধান হিসেবে নিয়ে যদি মনে করে তার সাহিত্য বা অর্থনীতি শেখারও আগ্রহ আছে, তাহলে সেটি নেওয়ার সুযোগ পাবে। একইভাবে মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষার কোনো শিক্ষার্থী যদি মনে করে সে গণিত শিখবে, পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান শিখবে, তাহলে তাদের সেভাবে বিষয় বাছাই করার সুযোগ দেওয়া হবে।
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে কীভাবে
প্রাক্-প্রাথমিক-তৃতীয় শ্রেণি: নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুসারে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না। বিদ্যালয়েই শ্রেণিশিক্ষকেরা ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি নিরূপণ করবেন। অর্থাৎ এই শ্রেণিগুলোতে সাময়িক, ষাণ্মাষিক বা বার্ষিক—এ ধরনের কোনো পরীক্ষা হবে না, শতভাগ মূল্যায়ন শিখনকালীনই হবে।
চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণি: চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান—এই পাঁচ বিষয়ের ওপর ৬০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। সিলেবাস শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে যে মূল্যায়ন, সেটাকেই বলা হচ্ছে সামষ্টিক মূল্যায়ন। এ বিষয়গুলো ছাড়া বাকি তিনটি বিষয়—শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্পকলা এগুলোর শতভাগ মূল্যায়ন শিখনকালীনই করা হবে।
ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণি: ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান—এই পাঁচ বিষয়ের ওপর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া বাকি তিনটি বিষয় জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিখনকালীন শতভাগ মূল্যায়ন করা হবে।
নবম-দশম শ্রেণি: নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান—এই পাঁচ বিষয়ের ওপর ৫০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং বাকি ৫০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। এ ছাড়া বাকি তিনটি বিষয় জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে শতভাগ মূল্যায়ন করা হবে। দশম শ্রেণি শেষে দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর পাবলিক পরীক্ষা হবে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের অধীন বর্তমান এসএসসি পরীক্ষার আদলে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তবে এ পরীক্ষার নাম পরিবর্তন হতে পারে।শিখনকালীন মূল্যায়ন কীভাবে হবে
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি: একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এই তিনটি আবশ্যিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ শতাংশ। নৈর্বাচনিক বা বিশেষায়িত বিষয়ে কাঠামো এবং ধারণায়ন অনুযায়ী হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। প্রায়োগিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। এর মধ্যে একাদশ শ্রেণিতে ছয়টি পত্রের ওপর পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে থাকবে—বাধ্যতামূলক তিনটি পত্র (বাংলা, ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি) এবং তার পছন্দের শাখার তিন বিষয়ের প্রথম পত্রের পরীক্ষা। এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের অধীন। এই পরীক্ষার নম্বর বোর্ডে সংরক্ষিত থাকবে। এরপর দ্বাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর পছন্দের শাখার প্রতিটি বিষয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্র মিলিয়ে মোট ছয়টি পত্রের পরীক্ষা হবে। তখন বাধ্যতামূলক বিষয়গুলোর আর পরীক্ষা হবে না। এভাবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষার নম্বর মিলিয়ে চূড়ান্ত হবে একজন শিক্ষার্থীর উচ্চমাধ্যমিকের ফল। তবে এ পরীক্ষাগুলোরও নতুন নামকরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শিখনকালীন মূল্যায়ন কীভাবে হবে
নতুন শিক্ষাক্রমের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে শিখনকালীন মূল্যায়ন। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বেশির ভাগ মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে। অর্থাৎ বিষয়-শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সারা বছর ধরে অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কাজ, প্রকল্পভিত্তিক শিখনচর্চা, খেলাধুলা, গ্রুপ ওয়ার্ক, কুইজ, পোস্টার প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাবেন এবং তাদের কাজের মূল্যায়ন করবেন। আর মূল্যায়ন মানেই কিন্তু এখনকার মতো প্রচলিত পরীক্ষা নয়, নম্বর নয়, গ্রেডিং নয়। নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে, সে সম্পর্কে শিক্ষক মন্তব্য করবেন। মন্তব্যগুলো হতে পারে, ‘খুব ভালো’, ‘ভালো’, ‘সন্তোষজনক’ এবং ‘আরও শেখা প্রয়োজন’—এ রকম। ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শ্রেণিতে প্রথম-দ্বিতীয় হওয়া বা নম্বর ও গ্রেডিংয়ের পেছনে ছোটার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সেটি আর থাকছে না। এ পদ্ধতিতে শিক্ষকদের ভূমিকাই হবে মুখ্য। তাদের বহুমাত্রিক, সৃজনশীল, দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ ও মানবিক গুণসম্পন্ন আদর্শ শিক্ষক হতে হবে। তবে সহপাঠীরাও তাদের সতীর্থদের মূল্যায়ন করার সুযোগ পাবে। যেমন ‘প্রকল্পভিত্তিক শিখনচর্চা’য় একজন শিক্ষক তাঁর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে প্রকল্পভিত্তিক শেখার কাজ দেবেন। কাজটি করার পর শিক্ষার্থীরা তা শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করবে। তার ভিত্তিতে শিক্ষক নম্বর দেবেন। আবার দলের ভেতর থেকেও শিক্ষার্থীরা একে অপরের কাজ মূল্যায়ন করতে পারবে।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি কি বাতিল হচ্ছে
২০২২ সালে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালুর এক যুগ পূর্তি হতে চলেছে। ২০১০ সালে বাংলা এবং ধর্ম শিক্ষা বিষয়ে এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ দেশে চালু হয় সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি। নানা আলোচনা-সমালোচনা পেরিয়ে ধাপে ধাপে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব কটি পাঠ্য বিষয়কেই সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির আওতায় আনা হয়। যদিও বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষায়—অধিকাংশ শিক্ষকের সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝতে না পারা, নোট-গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়া, উত্তরপত্র মূল্যায়নে যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা বজায় রাখতে না পারার বিষয়গুলো উঠে এসেছিল। বর্তমানে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির বিষয়ে কোনো কিছু বলা নেই। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এ পদ্ধতি হয়তো আর থাকছে না। কারণ, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা বা দক্ষতাভিত্তিক যোগ্যতা অর্জনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে হাতে-কলমে শিক্ষা অর্জন করবে। তা ছাড়া তাদের মূল্যায়নের অধিকাংশই হবে শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়ন, যাতে প্রশ্নের ধরনও থাকবে ভিন্ন রকম। ফলে সহজেই অনুমেয় যে বর্তমানে সৃজনশীল পদ্ধতিতে একটি উদ্দীপক বা দৃশ্যকল্প দিয়ে তার সঙ্গে চার দক্ষতার (জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা) যে চারটি প্রশ্ন করা হয়, সে রকম পদ্ধতি হয়তো থাকছে না। এর ফলে শিখন ও শিক্ষণপদ্ধতিতে পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একঝলকে নতুন শিক্ষাক্রমের বিশেষত্ব
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অভিন্ন শিক্ষাক্রম এটাই প্রথম।
নতুন শিক্ষাক্রম যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক, আগের মতো উদ্দেশ্যভিত্তিক নয়। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা মুখস্থনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে শিক্ষণীয় বিষয়ের পুরোটা হাতে-কলমে শিখবে। আর এ শিখন-শেখানো কার্যক্রম কেবল শ্রেণিকক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। শ্রেণিকক্ষের বাইরে, বাসায়, বাসার চারপাশে, স্কুলের চারপাশে বা বৃহত্তর সমাজেও তার শিখন উপাদান থাকবে এবং শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্প, অ্যাসাইনমেন্ট, দলগত কাজ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জন করবে।
মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাতেও নতুন শিক্ষাক্রমের মূল বিষয়গুলো পড়ানো হবে এবং সঙ্গে তাদের নিজস্ব কিছু বিষয়ও থাকবে।
শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুর সহজ উপস্থাপন, রং ও ছবির ব্যবহার, তত্ত্ব ও তথ্যের বোঝা কমানোসহ আরও এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে নতুন পাঠ্যবই তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তা শিক্ষার্থীদের কাছে বোঝা না হয়ে আনন্দময় হয়, হাতে-কলমে সহজে শেখানো যায় এবং একই সঙ্গে কোচিং ও নোট-গাইডনির্ভরতা কমে আসে।
প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না।
উঠে যাচ্ছে প্রাথমিক সমাপনী (পিইসি), ইবতেদায়ি ও জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা।
দুটি সার্টিফিকেটের জন্য মোট তিনটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমান এসএসসি/সমমানের সার্টিফিকেটের জন্য শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর একটি পাবলিক পরীক্ষা এবং এইচএসসির সার্টিফিকেটের জন্য একাদশের সিলেবাসের ওপর একটি ও দ্বাদশের সিলেবাসের ওপর আরেকটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আর এই দুটি পাবলিক পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে তৈরি হবে এইচএসসির ফল।
মূল্যায়ন ও পরীক্ষাপদ্ধতিতে আসছে আমূল পরিবর্তন। জিপিএ পয়েন্ট ৫-এর পরিবর্তে ৪ করা হচ্ছে। চিরাচরিত স্কুলের পরীক্ষা, নম্বর, গ্রেডিং—এসবের পরিবর্তে শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়নকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে দুই দিন।
শিক্ষার্থীদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা ও নানান সৃজনশীল কাজের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা যেন ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ করতে পারে, বাড়ির কাজের অধিক চাপ না থাকে, সারা দিন ক্লাস ও শিক্ষকদের পেছনে দৌড়ে সময় নষ্ট না করতে হয় এবং শিক্ষার্থীরা যেন নিজেদের মতো করে কিছুটা সময় কাটাতে পারে, সে বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে।
নতুন শিক্ষাক্রমে করোনার মতো পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। দূরশিক্ষণের মাধ্যমেও যাতে লেখাপড়ার কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শিক্ষক সহায়িকা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তৃতীয় লিঙ্গের শিশু এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের তাদের ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো স্কুলে ভর্তি করার কথা বলা হয়েছে।