রবীন্দ্রনাথ অভিধানকে বলেছেন ‘ভাষার সিন্দুক’। বাংলা ভাষার সিন্দুক অর্থাৎ অভিধানে শব্দের সংখ্যা দেড় লাখের ওপরে। বাঙালি সব শব্দই যে একসঙ্গে ব্যবহার করে, তা কিন্তু নয়। শব্দের প্রয়োজন কারও বেশি, কারও কম। এটা নির্ভর করে ভাষা ব্যবহারকারীর শিক্ষা-দীক্ষা, পেশা, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদির ওপর।
ব্যবহার না করা শব্দগুলো জমা হয় অভিধানে। জমে থাকা কতক শব্দ হয়ে পড়ে প্রায় পুরোপুরি অচল। কতক শব্দ কালে কালে প্রতিভাবান ভাষা ব্যবহারকারীর হাতে পড়ে লাভ করে নতুন জীবন।
অভিধানের অচল শব্দ নিয়ে কিছু ঝামেলা রয়েছে। এমনিতেই শব্দের স্বভাব-চরিত্র বেশ জটিল। তার ওপর সব শব্দ সব সময় একা থাকে না। সন্ধি-সমাসের ফাঁদে পড়ে কিছু শব্দ ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন অর্থ নেয়। কিছু শব্দ সবটাই হারায়। আজকের গল্প দুরবস্থায় পড়া কিছু শব্দ নিয়ে।
ধব
ধব শব্দটা ভাষার সিন্দুকের কোন কোনায় পড়ে রয়েছে, তার সন্ধান পাওয়া বেশ মুশকিল। শব্দটা এখন অচল। মৃতও বলা যেতে পারে। তাই সাধারণ অভিধানে এর ঠাঁই হয়নি। অধিকাংশ বাঙালিই শব্দটাকে যে চেনেন, এমন মনে হয় না।
ধব শব্দটার দুরবস্থার জন্য দায়ী সমাস। সমাসের ফাঁদে পড়ে ধব শব্দটা আপন অস্তিত্ব হারিয়ে ‘বিধবা’ ও ‘সধবা’ শব্দ দুটির মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।
ধব শব্দটি সংস্কৃত। অর্থ হলো স্বামী বা পতি। অন্যদিকে ধব নাই যাঁর তিনি হলেন বিধবা আর ধব সঙ্গে আছেন যাঁর তিনি সধবা। দুটি শব্দই বহুব্রীহি সমাসের মারপ্যাঁচে তৈরি। প্রশ্ন হতে পারে, ধব শব্দটা কি এই প্যাঁচ থেকে কোনো দিন বেরোতে পারবে কিংবা বের হওয়ার আর কি কোনো দরকার আছে?
ভাষার রহস্য সহজে বুঝে ওঠা মুশকিল। কোনো দিন কোনো কবি কিংবা গদ্যলেখক যদি বিধবা শব্দের বদলে ‘ধবহীনা’ লেখেন, সেদিন ধব শব্দটাকে খানিকটা হলেও চেনা যাবে অথবা ধব শব্দটার মানে কী, এমন প্রশ্ন করা সম্ভব হবে।
জয়কার
অনেকের কাছেই জয়কার অচেনা একটি শব্দ। আসলেই তাই। শুধু জয়কার শব্দের এখন আর ব্যবহার নেই। তবে শব্দটির আগে জয় শব্দটি বসলেই তা সবার চেনা হয়ে উঠবে। কারও কোনো বিশাল, মহৎ কিংবা বিস্ময়কর কাজের জন্য চতুর্দিকে জয়জয়কার পড়ে যায়। চারদিকে তখন তার জয়জয়কার। জয়জয়কার শব্দের অর্থ এককথায় প্রকাশ করা বেশ কঠিন। শব্দটির মধ্যে থাকে বহু মানুষের ব্যাপক অভিনন্দন বার্তা।
অন্যদিকে জয়কার শব্দের অর্থ অতিশয় সরল। ‘জয় হোক’ আনন্দসূচক এই কথাটাই হলো জয়কার। জয়কার দিয়ে কন্যাপক্ষ বরকে বরণ করত। এলাকায় নেতার আগমনে—এখন যেমন অমুকের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম বলে যে ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়—সেটাই জয়কার করা। তবে বাঙালি এখন স্লোগান দেয়, জয়কার করে না।
জয় ও জয়কার জোড়া লেগে যে জয়জয়কার, তা অনেক সময়ে জয়জয়াকার হয়ে যায়। এটি অর্থহীন ভুল শব্দ।
মাংস
পুঁচকে কাচকি থেকে দশ-বারো কেজি ওজনের রুই-কাতলা সবই মাছ। বড় রুইয়ের টুকরো খেয়ে আমরা কখনো বলি না—রুইয়ের মাংসটা বেশ ভালো লাগল। মাংস বলতে আমরা জানি হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের মাংস। কিন্তু জানার তো কোনো শেষ নেই, জানার অনেক কিছু বাকি থাকে। আর মাংস শব্দের কথা জানলে তো চমকে উঠতে হবে।
মাংস সংস্কৃত শব্দ। মূল অর্থ মাছের মাংস, আমিষ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, একদা মাছেরও মাংস হতো, তবে এখন আর হয় না। সংস্কৃতে গোটা মাছকেও মাংস বলা হতো। ফলের শাঁসও ছিল মাংস। আমের শাঁস তখন মাংসই ছিল।
মাংস অত্যন্ত রহস্যময় একটা শব্দ। মৎস্য দেহ ছেড়ে মাংস পরে পশুর মাংসে রূপান্তরিত হয়। বাংলায় এসে মাংস কখনো আর মাছ হয়নি।
সাপুরুষ
সাপুরুষ শব্দটা সংস্কৃত। এককালে বাংলায় চলত। এখন আর চলে না। মোটকথা, শব্দটা অচল। মৃতও বলা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো তাহলে মৃত শব্দ নিয়ে কেন এই টানাটানি?
সাপুরুষ শব্দটা এককালে বাংলা শব্দভান্ডারের মধ্যে ছিল। কিন্তু এখন নেই। তাই বলে শব্দটার খোঁজখবর যে রাখব না, এমন তো নয়। মাতৃভাষার সম্পত্তির, সম্পদের খোঁজখবর রাখব না তা-ও কি কখনো হয়, হতে পারে?
সাপুরুষের মতো একটি শব্দ বাংলায় আছে, সেটিও সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত। শব্দটি হলো কাপুরুষ। সাহসহীন, ভীরু, অধম প্রকৃতির মানুষকে আমরা কাপুরুষ বলি।
কাপুরুষ শব্দের মূল অর্থ কুিসত পুরুষ। সাপুরুষ অবশ্য কাপুরুষের বিপরীতার্থক শব্দ নয়। সাপুরুষ শব্দের মূল অর্থ ঈষৎ পুরুষ। পুরো পুরুষ নয়, খানিকটা পুরুষ। অর্থাৎ তার মধ্যে মেয়েলিভাবের প্রাবল্য বেশি।
পাটকেল
বাংলা প্রবাদে পাই ঢিলটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। শুধু প্রবাদেই পাটকেল শব্দটা আলাদাভাবে পাওয়া যায়, নইলে সর্বত্র ইটপাটকেল। একসময় বিশেষণ হিসেবে পাওয়া যেত—পাটকেলে রং। এখন তা-ও আর দেখা যায় না। মোটকথা, পাটকেল শব্দটা এখন একেবারেই পরাশ্রয়ী, ইটকে আশ্রয় করেই তার টিকে থাকা।
বস্তুত আলাদা শব্দ হলেও পাটকেলের সম্পর্ক ইটের সঙ্গেই। ইট থেকেই পাটকেলের সৃষ্টি। যেটা আমরা অনেকেই জানি না কিংবা জানার দরকারও হয় না—তা হলো ইটের টুকরোর নামই পাটকেল, আকারে খোয়ার চেয়ে বড়, আধলার চেয়ে ছোট। বাংলা প্রবাদটির সাধারণ অর্থ তাই—আঘাতটি বড় হলেও প্রত্যাঘাতটি ছোট হলেও কিন্তু হবে।
আমরা তো এখন কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি। ইংরেজিতে যেটা ব্রিক রেড, বাংলায় সেটাই পাটকেলে রং।