ইতিহাসের প্রথম পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন প্রাচীন মিসরীয়রা। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ বছর আগে মিসরে তৈরি হয়েছিল স্টেপ পিরামিড। এই পিরামিড তৈরির আগে মিসরে কখনো পাথরের বাড়িও তৈরি হয়নি। সবার থেকে ভিন্ন হওয়ার জন্য ফারাও জোসার এমন কিছু একটা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা অন্য কারও নেই। কিন্তু কী তৈরি করবেন, তা তিনি জানতেন না। দায়িত্ব দিলেন তখনকার সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিকে। নাম ইমহোটেপ। তিনি তৈরি করলেন ইতিহাসের প্রথম পিরামিড, স্টেপ পিরামিড। এখন এটি জোসারের পিরামিড নামে পরিচিত।
কিন্তু কীভাবে তখন ইমহোটেপ এই পিরামিড তৈরি করেছিলেন? ক্রেন বা তেমন কোনো আধুনিক প্রযুক্তি তখন ছিল না মানুষের কাছে। বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি এত দিন। কিছু হাইপোথিসিস অবশ্য প্রচলিত ছিল। কিন্তু নিশ্চিত করে বলার উপায় ছিল না।
সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী ঘোষণা করেছেন, তাঁরা এ রহস্যের সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা জানতে পেরেছেন কীভাবে ইমহোটেপ তৈরি করেছিল ইতিহাসের প্রথম পিরামিড! সেই গবেষণা সম্পর্কেই তোমাদের আজ জানাব।
এই বিজ্ঞানী দল মনে করেন, প্রাচীন মিসরীয়রা ভারী পাথর এবং অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী সরানোর জন্য একটা ভাসমান ব্যবস্থা তৈরি করতে বাঁধটি ব্যবহার করেছিল।
জোসারের পিরামিড ১৯৭ ফুট লম্বা ছিল। ছবিতে অবশ্য তা বোঝা যায় না। পিরামিড আসলে কত বড়, তা কোনো ছবি বা মুভি দেখে বোঝা যায় না। যা-ই হোক, জোসারের পিরামিড কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তা আমরা না জানালেও পিরামিড তৈরিতে কী কী উপকরণ ছিল, তা কিন্তু জানতাম। কাদামাটির ইট ও পাথরের সাহায্যে তৈরি করা হয়েছিল এ পিরামিড। কিন্তু কীভাবে এত বড় পাথর ওই উঁচুতে উঠানো হলো, তা নিয়ে ছিল প্রশ্ন।
সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে ফ্রান্সের সিইএ প্যালিওটেকনিক ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানী। তাঁরা কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করে বিভিন্ন নির্মাণ পদ্ধতির মডেল তৈরি করেন। পিরামিডের আশপাশের অঞ্চলের একটা মানচিত্রও তৈরি করেন। এই জেসোর পিরামিডের পাশের একটা অবকাঠামো নিয়ে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। স্থানীয়ভাবে অবকাঠামোটি ‘গিসর এল-ঘের’ নামে পরিচিত। এরকম একটা অবকাঠামো এখানে কেন ছিল, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহু বছর গবেষণা করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। কিন্তু কম্পিউটার সিম্যুলেশনের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন, এই অবকাঠামো আসলে একসময় বাঁধ হিসেবে কাজ করেছে। নিকটবর্তী নদীর পানি এই বাঁধের সাহায্যে আটকে রাখা হতো।
এই বিজ্ঞানী দল মনে করেন, প্রাচীন মিসরীয়রা ভারী পাথর এবং অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী সরানোর জন্য একটা ভাসমান ব্যবস্থা তৈরি করতে বাঁধটি ব্যবহার করেছিল।
তবে পিরামিডের ওপরে যে ভাসমান পদ্ধতিতে পাথর ওঠানো হতে পারে, এমন ভাবনা বিজ্ঞানীরা আগেও ভেবেছিলেন। কিন্তু তেমন কোনো শক্ত প্রমাণ পাননি। বর্তমানে পাওয়া এই যুক্তি কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা তোমরা নিজেরাই বিচার করতে পারবে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পিরামিডের নিচে ৯২ ফুট গভীর গর্ত আছে। বাঁধের সাহায্যে আটকানো পানি সেই গর্তে গিয়ে জমা হতো। এই পানি কাজ করতো অনেকটা লিফটের মতো। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাথর ওপরের দিকে উঠত। গর্ত থেকে আবার পানি বের করার পদ্ধতিও তাদের জানা ছিল।
কিন্তু এই গবেষণা কতটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো তোমাদের কাছে? আগেই বলেছি, পিরামিড নির্মাণে পানির ভূমিকা রয়েছে এমন পরামর্শ এটাই প্রথম নয়। তবে এবার বিজ্ঞানীরা গবেষণায় উন্নত প্রযুক্তির কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করেছেন, যা আগে করা হয়নি। অন্য গবেষকেরা এই বিজ্ঞানীদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। একজন প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন, পিরামিডের ওপরে পাথর ওঠানোর মতো অতটা পানি রাখার মতো গর্ত পিরামিডে ছিল না। ফলে সম্প্রতি গবেষণার এই ফলাফল পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য করতে দরকার আরও গবেষণা।
বিজ্ঞান অবশ্য এভাবেই কাজ করে। একবারে কোনো সমাধানে পৌঁছানো কঠিন। প্রথমে কেউ একজন একটা কাজ শুরু করে। তারপর সে কাজ নিয়ে অন্যরাও গবেষণা করে। ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হয় আসল সত্য। পৃথিবীর কথাই ভাবো। আগে মানুষ বিশ্বাস করত, পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে সূর্য। তারপর টাইকো ব্রাহে, কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালেলিওদের হাত ধরে আমরা জানতে পেরেছি, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। এ গবেষণাকেও আমরা সূচনা হিসাবে ধরে নিতে পারি। এই বিজ্ঞানীদল তাঁদের কাজ নিয়ে আরও গবেষণার কথা জানিয়েছে। হয়তো অন্য কোনো বিজ্ঞানী দলও এ ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। আর তাতে মানবজাতিরই লাভ। হয়তো একদিন আমরা আসলেই জানতে পারব, পিরামিড তৈরির রহস্য।
তাই বলে গবেষকদের এই গবেষণাকে ভুল বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কে বলতে পারে, হয়তো এভাবেই ইমহোটেপ তৈরি করেছিল ইতিহাসের প্রথম পিরামিড!
সূত্র: দ্য উইক জুনিয়র