আ জার্নি বাই কিআ মিটিং
কিশোর আলোর মিটিংয়ের প্রতি আমার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই। মাঝেমধ্যেই আব্বুর মুখে শুনতাম ‘মিটিং আছে’, ‘মিটিংয়ে আছি’, ‘মিটিং শেষ হোক’। কিন্তু মিটিং ব্যাপারটা আসলে কী, সেটা তখনো বুঝে উঠিনি। শুধু বুঝলাম, পুরো জিনিসটা খুব সিরিয়াস, সবাই একটু গম্ভীর হয়ে যায় মিটিং–বিষয়ক কথা বলার সময়। এই ভুল একদিন ভাঙল, কিশোর আলোর মিটিংয়ে এসে। মিটিংয়ের নাম কিআড্ডা।
২০১৬ সাল, আমি তখন মাত্র ক্লাস সেভেনে উঠলাম। বিশিষ্ট কিআভক্ত, কিন্তু কিআড্ডা নিয়ে আমার কোনো ধারণাই নেই। হঠাৎ একদিন ফেসবুকে দেখি, ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে মিটিং নম্বর ২৯। বুঝতে পারলাম, মিটিং–জাতীয় কিছু একটা হবে কিআ অফিসে। খুব অবাক হলাম। কিশোর আলোর মুরব্বিরা মিটিং করবেন, সেটা কেন ঘোষণা দিয়ে জানানো হচ্ছে? একটু স্ক্রল করে নিচে নেমে দেখি, এই মিটিং তো আমাদের বয়সী বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে। একটু নড়েচড়ে বসলাম। এই সুযোগ মিটিং দেখার। কিন্তু মিটিং তো বহুদূর, ঢাকায়। আমি তখন থাকি ময়মনসিংহে, এত দূর তো আব্বু মানবেন না। তবু সাহস করে বলে ফেললাম। আব্বুও দেখলাম রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু যাব কীভাবে? আব্বু থাকেন ঢাকায়। বাসার অন্য সদস্যরা ব্যস্ত। আমার সঙ্গে এই সময়ে ঢাকা যাওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। আব্বু বলেন, ‘অনেক বড় হইছিস, একাই চলে আয়।’
ব্যাপক উত্তেজনা নিয়ে রওনা দিলাম। ছোট্ট আমি একা একা বাসে চড়ে চলে এলাম ঢাকায়। পরদিন ঢাকায় খুব বৃষ্টি। ছাতা মাথায় গম্ভীর সেজে গেলাম সে সময়ের কিআ মিটিং রুমে, সিএ ভবনের চারতলায়। পৌঁছে অবাক হয়ে দেখি সবাই বেশ খুশি খুশি। জুতা খুলে একে একে সবাই বসে পড়ল মিটিং রুমের ফ্লোরে। কী অদ্ভুত ব্যাপার। আমি তো ভেবেছিলাম, গম্ভীর মুখে গোলটেবিল সামনে রেখে চেয়ারে বসে মিটিং করব। কিন্তু এ তো দেখি আনন্দ–উল্লাসের মিটিং। গান, হাসি, জ্ঞানের গল্প ভরপুর। তিন থেকে চার ঘণ্টা বুঁদ হয়ে রইলাম মিটিংয়ে। বুঝতে পারলাম, মিটিংয়ে আসা কিআ পাঠকদের পৃথিবীটা আসলে কত বড়। তবে এই মিটিং রুম যে আমার পুরো কৈশোর দখল করে নেবে, সেটা তখনো বুঝে উঠতে পারিনি।
হঠাৎ একদিন যেভাবে কিআ মিটিংয়ে এসেছিলাম, পালালামও হঠাৎ। ১০০ নম্বর মিটিং দেখার সুযোগ হলো না। আমি এখন থাকি সমুদ্রে ঘেরা এক দেশে।
প্রতি মাসে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা যাওয়াটা একটু মুশকিলের ব্যাপার। পরের বছর পুরোপুরিভাবে ঢাকায় চলে এলাম। নিয়মিত হলাম কিআড্ডায়। ক্লাস এইট কিংবা নাইনে পড়ার বয়সটাতে কিআড্ডা ছিল আমার সবচেয়ে বড় ‘পালানোর রাস্তা’। ক্লাস, হোমওয়ার্ক আর বই পড়ার বাইরে আমার আর কিছুই করার ছিল না সেই সময়টায়। তাই পুরো মাস অপেক্ষা করতাম মিটিংয়ের জন্য। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভুল বের করতাম কিআর নতুন সংখ্যা থেকে, যেন মিটিংয়ে ভুলটা ধরিয়ে দিতে পারি। একটার জায়গায় দুটি লেখা লিখে বসে থাকতাম, মিটিংয়ে জমা দেব বলে। ব্যাপক উত্তেজনা।
একটু বড় হওয়ার পর সুযোগ এল মিটিং ব্যবস্থাপনায় অংশ নেওয়ার। মিটিংয়ের নিয়মকানুন যেন সবাই মেনে চলে, সেটা নিশ্চিত করাই ছিল স্বেচ্ছাসেবকের কাজ। প্রথমবার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর খুশিতে আমার বাকবাকুম অবস্থা। গলায় আইডি কার্ড ঝুলিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে একটু ভাব নেওয়া যাবে। তবে মিটিংয়ের দিন টের পেলাম, ব্যাপারটা এমন নয়। হাসি হাসি মুখে কাউকে আঙুল দিয়ে ভুলটা দেখিয়ে দেওয়া যে কত কঠিন! শুধু তা–ই নয়, মিটিংয়ে আসা অতিথিদের রিসিভ করা কিংবা চায়ের ব্যবস্থা করা—সবই স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ। মিটিং মিনিটস লেখার দায়িত্বটাও একবার পেলাম। ক্লাসে এক অক্ষরও নোট না নেওয়া আমি পুরো তিন ঘণ্টার মিটিংয়ের নোট নিলাম। বাসায় ফিরে পরের সংখ্যার জন্য একটা রিপোর্টও লিখে ফেললাম। অবিশ্বাস্য!
ফাস্ট ফরওয়ার্ড। করোনাভাইরাসের শেষে ২০২২ সালে আমরা নতুন করে মিটিং শুরু করলাম, নতুন ভবনে। কিআর সে সময়ের সহকারী সম্পাদক পাভেল ভাই মিটিং ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব দিলেন আমাকে। অন্যদিকে কিআর অন্য সহকারী সম্পাদক আদনান মুকিত ভাই বললেন, মিটিং মিনিটস যেন আমি সম্পাদনা করি। কাঁপা কাঁপা গলায় মিটিংয়ে কথা বলা আমি গোটা একটা মিটিং আয়োজন করব, লেখা সম্পাদনা করব? ঘোষণা দিলাম, আমার মতো বেকুবের পক্ষে এত বড় কাজ করা সম্ভব নয়। ভাই বললেন, পারবা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সত্যি সত্যিই এর পরের দেড় বছর পাভেল ভাইকে মিটিং পরিচালনায় সাহায্য করলাম। পাভেল ভাইয়ার অনুপস্থিতিতে একবার সঞ্চালনাটাও করে বসলাম। লেখা সম্পাদনার হাতেখড়িটাও খুব সম্ভবত মিটিং মিনিটস থেকেই হয়েছিল। সব মিলিয়ে কতটুকু পেরেছিলাম জানি না, তবে শিখেছিলাম অনেক কিছু।
হঠাৎ একদিন যেভাবে কিআ মিটিংয়ে এসেছিলাম, পালালামও হঠাৎ। ১০০ নম্বর মিটিং দেখার সুযোগ হলো না। আমি এখন থাকি সমুদ্রে ঘেরা এক দেশে। কিআর মিটিং বাদ দিয়ে এখন আমার করতে হয় অ্যাসাইনমেন্টের মিটিং, পার্টটাইম জবের মিটিং। এসব মিটিংয়ে হাসি হাসি মুখে সব ম্যানেজ করার স্কিল শেখানোর কৃতিত্ব অবশ্য এখনো কিআর। তবে যখনই সবার সামনে মাইক হাতে দুই লাইন কথা বলতে হয়, আমার গলা কাঁপে। আমার মনে হয়, কে কী ভাববে। আবার এটাও ভাবি, কিআর মিটিং রুমে তো কেউ কিছু ভাবত না, এখনো ভাববে না। বলেই ফেলি, যা বলতে চাই। এখানেও বলছি, আমি আসলে আমার গোটা কৈশোরটা কিশোর আলোর একটা মিটিং রুমে ফেলে চলে এসেছি।
লেখক: প্রদায়ক, কিশোর আলো, শিক্ষার্থী, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, রিতসুমেইকান এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি, জাপান