সত্যজিৎ রায় যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে দেখে এসেছেন, সেখানকার কুকুরগুলোও কত ভালো অভিনয় করে। সেসব কুকুরের কোনো কোনোটার জনপ্রিয়তা বিখ্যাত অভিনেতাদের কাছাকাছি। ওদের পারিশ্রমিকও নাকি পাকা অভিনেতাদের সমান। ওরা কীভাবে অভিনয় করে, ক্যামেরার সামনে কী উপায়ে ওদের কাজে লাগানো হয়, শুটিংয়ের আগে ওরা কীভাবে রিহার্সেল করে—সেসব খুঁটিয়ে দেখে এলেন সত্যজিৎ। পরে যখন প্রথম সিনেমা বানাতে যান সত্যজিৎ রায়, তখন ওই কুকুরগুলোর কথা মাথায় রেখেই চেষ্টা করেছিলেন দেশীয় কুকুরকে অভিনয় করানোর।
সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ছিল পথের পাঁচালী। কেন্দ্রীয় চরিত্র অপু আর দুর্গা। উপন্যাসে তাঁদের একটা পোষা কুকুর ছিল, নাম ভুলু। সিনেমার অন্তত একটা দৃশ্যে ভুলুকে দেখাতে চাইলেন সত্যজিৎ। কিন্তু মুশকিল হলো হলিউডের মতো শিক্ষিত কুকুর এ দেশে পাবেন কোথায়। শেখানো-পড়ানো বিদেশি কুকুরকে তো আর দেশি কুকুরের পাট দেওয়া যায় না। তাই একটা দেশি কুকুরকেই ধরে-বেঁধে অভিনয় করাতে হবে।
এক ময়রা এসেছে গাঁয়ে মিষ্টি বিক্রি করতে। পিঠের বাঁকে মিষ্টির হাঁড়ি ঝুলিয়ে সারা গ্রাম মিষ্টি বেচে বেড়াচ্ছে লোকটা। অপু-দুর্গাদের সংসারে বড্ড অভাব। ভাতই খেতে পায় না ঠিকমতো, মিষ্টি কেনার সাধ্য কোথায়! তাই ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে মিষ্টিওয়ালার পিছু পিছু। গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা হুড়োহুড়ি করে মিষ্টি কিনবে, কীভাবে কিনবে, কীভাবে খাবে—এসব দেখেও মজা পাওয়া সম্ভব। সত্যজিৎ চাইলেন, এই দৃশ্যে থাকুক কুকুরটাও। রিহার্সেলও করলেন কুকরটাকে নিয়ে। সব ঠিকঠাক। কিন্তু ক্যামেরা চালু হওয়ার পর বেঁকে বসল কুকুরটা। কিছুতেই অপু-দুর্গার পেছনে ঘুরবে না! তখন ছিল ফিল্মি ক্যামেরা যুগ, অর্থাৎ ভিডিও রেকর্ড হতো ফিল্মে। ফিল্ম বিক্রি হতো ফুট হিসাবে। একেকটা দৃশ্য ধারণ করতে ব্যয় হতো কয়েক শ ফুট ফিল্ম। সে ফিল্মের আবার অনেক দাম। পরপর ১১ বার চেষ্টা করলেন সত্যজিৎ, প্রায় হাজার ফুট ফিল্ম নষ্ট হলো। কিন্তু কুকুরটাকে টলানো গেল না। শেষমেশ অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হলো। সন্দেশ কিনে দুর্গার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো। সঙ্গে কুকুরের মালিকও রইল অপু-দুর্গার সঙ্গে। সবার আগে কুকুরের মালিক, তারপর অপু, তার পেছনে সন্দেশ হাতে দুর্গা। সন্দেশের লোভে কুকুর ঘুরতে শুরু করল অপু-দুর্গার পিছু পিছু। সত্যজিৎ মনের মতো দৃশ্য ধারণ করলেন।