রাজা চার্লসের মুকুটের দাম কত

রাজা চার্লস ও রানি কামিলাছবি: বিজনেস ইনসাইডার

যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের বর্তমান রাজা কিং চার্লস দ্য থার্ড। রানি এলিজাবেথ যে মুকুট ও রত্নগুলো ব্যবহার করতেন, উত্তরাধিকারী হিসেবে সেগুলো এখন রাজা ব্যবহার করেন। এই ঐতিহ্যবাহী রত্নখচিত মুকুট এবং রত্নগুলো প্রথম ব্যাপকভাবে দেখা যায় রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে। মুকুটে হীরা জহরতের ছড়াছড়ি দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, ব্রিটিশ রাজপরিবারের রাজমুকুট ও রাজরত্নগুলোর দাম কত?

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে রাজপরিবারের ‘গোপন সম্পদ’ ‘বিলাসিতা’ নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। রানি এলিজাবেথ মারা যাওয়ার পর যখন রাজা চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান হলো, তখন রত্নের ছড়াছড়ি অনেকের মতে, ‘সীমা ছাড়িয়ে গেল’।। পুরো অনুষ্ঠানটাই যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রত্ন প্রদর্শনী।

৬ মে ২০২৩ যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে যখন রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান হলো, তখন এখানে থাকা মুকুট, রাজদণ্ড, গোলক এবং আংটিগুলোর যে ঝলকানি দেখা গেছে, তার মূল্য হিসাব করা থেকে অনেকেই বিরত থাকতে পারেনি। এত রত্ন দেখলে দাম হিসাব না করে যে কারও পক্ষে থাকা কঠিন।

রত্ন ইতিহাসবিদ ও লেখক জোসি গুডবডি নিজের পডকাস্ট দ্য জুয়েলারিয়ানে প্রায়ই রাজপরিবারের রত্নসম্পদ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘রাজপরিবারের রত্নের মূল্য নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব।’

‘অনেক রত্ন শত শত বছর ধরে তাঁদের কাছে আছে। সময়ের সঙ্গে সেগুলো পরিবর্তিত হয়েছে। নতুন কিছু রত্ন তাঁদের হাতে এসেছে, কিছু রত্ন এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। রত্নের প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হয়, অন্যরা এই রত্নের বিনিময়ে যে পরিমাণ অর্থ দিতে রাজি থাকেন বা বিমা কোম্পানি যতটুকু ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে রাজি থাকে।

রাজা যে মুকুটটি মাথায় পরেন, তাকে বলে ক্রাউন জুয়েলস। এই মুকুটের প্রকৃত মূল্য অনুমান করেছে একটি বিমা কোম্পানি। তাদের প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, ক্রাউন জুয়েলস বা ব্রিটিশ রাজমুকুট ও রত্নসম্ভারের ক্ষতিপূরণ মূল্য হতে পারে প্রায় ৫ বিলিয়ন পাউন্ড।

এত বিশাল মূল্য নির্ধারণের কারণে এই রত্নগুলোর জন্য বিমা করাতে হলে বছরে প্রিমিয়াম দিতে হতে পারে প্রায় ১৮.৯ মিলিয়ন পাউন্ড। আর শুধু রাজ্যাভিষেকের দিনের জন্য বিমা করাতে চাইলে খরচ পড়বে ৫১ হাজার ৭০০ পাউন্ড।

ক্রাউন জুয়েলস
ছবি: উইকিপিডিয়া/ ডেনিস জারভিস

অ্যাডমিরাল ইন্স্যুরেন্স-এর হেড অব হাউসহোল্ড নোয়েল সামারফিল্ড বলেছেন, ‘ক্রাউন জুয়েলসে ১০০টির বেশি বস্তু এবং ২৩ হাজারের বেশি রত্ন রয়েছে। যা এক কথায় ‘অমূল্য’। এর কোনো আনুষ্ঠানিক মূল্য নেই। কারণ রাজপরিবার কখনোই এটি বিক্রির কথা ভাবতে পারে না। তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এগুলোর মূল্য ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন পাউন্ড। এর চেয়েও বেশি হতে পারে।

১৯৬০ সালে ব্রিটিশ কূটনীতিক লর্ড এডওয়ার্ড টুইনিং তাঁর বই ‘আ হিস্টরি অব দ্য ক্রাউন জুয়েলস অব ইউরোপে’ এই রত্নগুচ্ছ নিয়ে বলেছেন, ‘এটি এত ভারী যে ধরে রাখা কঠিন। মাথায় এটি পরা খুব বিরক্তিকর। মাথায় ভারের জন্য পরে থাকা কষ্টকর। আর এটি এত দামি যে কেনা অসম্ভব।’

এই বইটি বাণিজ্যিকভাবে সফল বা বেস্টসেলার হয়েছে। এটি দিয়ে বোঝা যায়, রাজ পরিবারের রত্নের প্রতি মানুষের কৌতূহল অনেক বেশি।

৬ মে ২০২৩ রাজা চার্লস অভিষেকের দিনে রাজপরিবারের ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার জনসমক্ষে এসেছিল।

রাজা চার্লসে রাজ্যাভিষেকের দিনে দুটি রাজমুকুট পরেন। এর মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র ও আনুষ্ঠানিক হলো সেন্ট এডওয়ার্ড’স ক্রাউন, যা ১৬৬১ সালে রাজা চার্লস দ্বিতীয়ের জন্য তৈরি হয়েছিল। এই মুকুট কেবল রাজ্যাভিষেকের মুহূর্তেই ব্যবহার করা হয়।

এই সোনার মুকুটটির ওজন ২.০৭ কেজি। এটির শুধু সোনার বর্তমান বাজার মূল্যে হিসাব করলে দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ১৭ হাজার পাউন্ডের বেশি। কারিগরি, রত্ন এবং ঐতিহাসিক মূল্য এই হিসাবে ধরা হয়নি। রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেকের পর ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে ছাড়ার সময় যে মুকুটটি পরেছিলেন, সেটিতে ছিল ২,৮৬৮টি হীরা, ১৭টি নিলা, ১১টি পান্না, ২৬৯টি মুক্তা এবং ৪টি রুবি।

এই অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান রত্ন হিসেবে ছিল একটি রাজদণ্ড, যা রাজা চার্লস দ্বিতীয়ের রাজ্যাভিষেকের পর থেকে প্রতিটি রাজ্যাভিষেকেই ব্যবহার করা হয়েছে। এই রাজদণ্ডে আছে ১.৩২ কেজি ওজনের সোনা, ওপরে আছে একটি ক্রস। যেটিতে বসানো আছে পান্না, রুবি, নিলা, হীরা ও মুক্তা।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মাথায় ক্রাউন জুয়েলস
ছবি: বিজনেস ইনসাইডার

রাজ্যাভিষেকে শুধু রাজা চার্লসই রাজমুকুট পরেননি, তাঁর স্ত্রী কামিলা আনুষ্ঠানিকভাবে রানি কামিলা হয়েছেন এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তিনি পরেন ‘কুইন মেরিস ক্রাউন’। যা তৈরি হয়েছিল ১৯১১ সালে রাজা জর্জ পঞ্চমের রানি মেরির জন্য।

এই মুকুটে ২ হাজার ২০০টি হীরা বসানো আছে। তবে এটিতে বিতর্কিত রত্ন ‘কোহিনুর হীরা’ ছিল না। এই হীরাটি বিশ্বের বৃহত্তম হীরাগুলোর একটি। ঔপনিবেশিক আমলে ভারত থেকে লুটপাট করা বস্তুর মধ্যে আছে এটি। অনেকে বলেন, এটি ১৮০০-এর দশকে ভারত থেকে চুরি করে নেওয়া হয়েছিল।

এর পরিবর্তে এই মুকুটে বসানো হয়েছে কুইন এলিজাবেথ দ্বিতীয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহের কালিনান থ্রি, ফোর ও ফাইভ নামের হীরা। এর মধ্যে থ্রি ও ফোরকে রানি এলিজাবেথ ব্রোচ হিসেবে পরতেন। মজার ছলে এটিকে বলতেন ‘গ্র্যানিস চিপস’। এগুলোর মোট ওজন ১৫৮ ক্যারেট এবং আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি পাউন্ডের বেশি।

রানি কামিলা
ছবি: উইকিপিডিয়া

এখন পর্যন্ত রাজমুকুট বারবার নতুনভাবে রূপান্তর করা হয়েছে। উত্তরাধিকারসূত্রে এগুলো বারবার হাতবদল হয়েছে। তাই এর সঠিক আর্থিক মূল্য নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব। তবে ইতিহাস বলছে, যে কোনও রাজতন্ত্রের পতনের পর সব কিছুরই একটা দাম নির্ধারিত হয়। যেমন টিফানির প্রতিষ্ঠাতা চার্লস লুইস টিফানি ১৮৮৭ সালে একটি নিলামে ফরাসি রাজমুকুটের এক-তৃতীয়াংশ কিনে নিয়েছিলেন।

যতদিন ব্রিটিশ রাজতন্ত্র টিকে থাকবে, ততদিন এই রাজরত্নগুলো সুরক্ষিত থাকবে। রাজপরিবার বা রাজতন্ত্র যতদিন আছে, এই রত্নগুলো ততদিন আসলে অমূল্যই থেকে যাবে।

আরও পড়ুন