রহস্য-রোমাঞ্চের মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স
সত্তরের দশকে অভিবাসী হিসেবে আমেরিকায় চলে আসেন আভি আরাড। ট্রাকচালক হিসেবে কাজ শুরু করলেন নিউইয়র্কে, পাশাপাশি লং আইল্যান্ডে হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেন পড়াশোনার জন্য। কমিকসের দারুণ ভক্ত ছিলেন আভি আরাড—সুপারম্যান ও স্পাইডার-ম্যানের কমিকসের পাগল ছিলেন ছোটবেলায়। কমিকসের চরিত্রগুলো নিয়ে ভালো জানাশোনা থাকার কারণেই কিনা যুক্তরাষ্ট্রে আসার কিছুদিন পর তিনি কাজ শুরু করলেন খেলনার ডিজাইনার হিসেবে। ম্যাটেল, হাসব্রো, টাইকোর মতো বড় কোম্পানি, যারা বার্বি বা ট্রান্সফরমারের মতো বিখ্যাত সব অ্যাকশন ফিগারের জন্য পরিচিত, তাদের সঙ্গে কাজ করছিলেন। এভাবেই নিউইয়র্কে তাঁর দিন কাটছিল। আভির বন্ধু কাজ করতেন মিডিয়ায়। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে একদিন সেই বন্ধু তাঁকে বললেন, ‘চলো, তোমাকে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।’ যাঁর সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেলেন আভিকে, তিনি ছিলেন বেশ ধনী একজন ব্যবসায়ী। নাম আইক পার্লমাটার। বিভিন্ন কোম্পানির পুরোনো পণ্য কম দামে কিনে নিতেন পার্লমাটার। অল্প কিছু লাভে আবার বিক্রি করতেন সেগুলো। পার্লমাটারও আভির মতোই অভিবাসী ছিলেন, আমেরিকায় যখন এসেছিলেন, তখন তাঁর অবস্থা ছিল আক্ষরিক অর্থেই কপর্দকশূন্য। মানুষ মারা যাওয়ার পর যে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান হয়, সেসব আয়োজনে গান গাইতেন, নিউইয়র্কের রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করতেন। পরে একটা গাড়ি কিনে সেটা দিয়ে বিক্রি করা শুরু করেন। একেবারে শূন্য থেকে উঠে আসা যাকে বলে।
আভি আরাডকে পার্লমাটার বললেন, কিছুদিন আগে টয় বিজ নামের একটা কোম্পানি কিনেছেন তিনি। আরাড আবিষ্কার করলেন, আরও বেশ কিছু চরিত্রের সঙ্গে মার্ভেলের চরিত্রগুলোর অ্যাকশন ফিগার বিক্রির লাইসেন্স আছে এই কোম্পানির। এসব নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না পার্লমাটারের। তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী—ক্যাপ্টেন আমেরিকা, হাল্ক আর স্পাইডার-ম্যান কে কিংবা কমিকসের দুনিয়ায় বিখ্যাত সব চরিত্র আসলে কারা, সেসব নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না তাঁর। যেহেতু আরাড একজন খেলনার ডিজাইনার এবং কমিক বইয়ের ভক্ত, সে কারণেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন পার্লমাটার। ধনী এই ব্যবসায়ীর অনুরোধে আরাড ১৯৯৩ সালে ডিজাইনার হিসেবে যোগ দিলেন টয় বিজে। কমিকসের চরিত্র নিয়ে আরাডের জানাশোনা আর পার্লমাটারের দারুণ ব্যবসায়িক দক্ষতা—দুইয়ে মিলে পরের কয়েক বছরে অ্যাকশন ফিগার বিক্রি করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করে টয় বিজ।
টয় বিজের ব্যবসা ভালো চললেও মার্ভেলের অবস্থা অত ভালো যাচ্ছিল না। ১৯৩৯ সাল থেকে কমিকস বিক্রি শুরু করে মার্ভেল। মার্টিন গুডম্যান তখন ‘টাইমলি কমিকস’ নামে একটা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫১ সালে নাম পরিবর্তন করে প্রথমে অ্যাটলাস কমিকস এবং ১৯৬১ সালে চূড়ান্তভাবে নাম পরিবর্তন করে পরিচিতি পায় মার্ভেল কমিকস নামে। ষাটের দশক থেকে ফ্যান্টাস্টিক ফোর, স্পাইডার-ম্যান, এক্স-মেন, থর, হাল্ক, আয়রন ম্যান, ব্ল্যাক প্যানথার, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, উলভারিন কিংবা ডক্টর স্ট্রেঞ্জের মতো চরিত্রগুলো নিয়ে পুরোদমে কমিকস বিক্রি করে যাচ্ছিল কোম্পানিটি। তারপরও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে অর্থনৈতিকভাবে খুবই খারাপ একটা অবস্থায় পড়ে তারা। এমন না যে এই পুরো সময়ে কমিক বইয়ের বিক্রি সব সময়ই ভালো ছিল। বরং এই সময়জুড়েই নিজেদের কমিক বইয়ের চরিত্রগুলো নিয়ে মুভি-টিভি সিরিজ বানানো এবং অ্যাকশন ফিগার বিক্রির লাইসেন্স বিভিন্ন মুভি স্টুডিও ও কোম্পানির কাছে বিক্রি করেছিল। টয় বিজ ছিল তেমনই একটা প্রতিষ্ঠান। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে মার্ভেল। ১৯৯৬ সালে নিজেদের দেউলিয়া হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয় তারা। বেশ লম্বা একটা আইনি লড়াইয়ের পর মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্টকে কিনে নেয় টয় বিজ। টয় বিজ ও মার্ভেল—এ দুটি কোম্পানিকে এক করে গঠন করা হয় নতুন আরেকটি কোম্পানি—মার্ভেল এন্টারপ্রাইজ। এই নতুন কোম্পানির একটা বিভাগ ছিল মার্ভেল স্টুডিওজ। মার্ভেল স্টুডিওজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালেই। মুভি ও টিভি সিরিজ তৈরির উদ্দেশ্যে মার্ভেল তাদের কমিকসের বিভিন্ন চরিত্রের স্বত্ব বিক্রি করত বিভিন্ন প্রোডাকশন কোম্পানির কাছে। প্রোডাকশন কোম্পানি বাছাই করা এবং এর সঙ্গে প্রিপ্রোডাকশন পর্যায়ের বিভিন্ন কাজ, যেমন স্ক্রিপ্ট লেখা, পরিচালক ঠিক করা, কোন চরিত্রকে কীভাবে ব্যবহার করা যাবে, সেসব নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া—এ ধরনের বিভিন্ন বিষয় তদারক করাই ছিল মার্ভেল স্টুডিওজের উদ্দেশ্য। আর এই বিভাগের দায়িত্ব এসে পড়ে আভি আরাড এবং মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্ট গ্রুপের প্রেসিডেন্ট জেরি ক্যালাব্রিজের কাঁধে।
মজার ব্যাপার হলো, ওই সময়ে কমিকসের চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে বানানো মুভিগুলোকে এতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হতো না। ১৯৯৮ সালের আগে মার্ভেল কমিকসের চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে কেবল একটা ফিচার ফিল্মই নির্মাণ করা হয়েছিল—১৯৮৬ সালের হাওয়ার্ড দ্য ডাক। বছরের সবচেয়ে জঘন্য মুভি হিসেবে এটা ১৯৮৬ সালের গোল্ডেন রাস্পবেরি অ্যাওয়ার্ড তো পেয়েছিলই, বক্স অফিসে এই মুভি ফ্লপ হওয়ার পর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল পিকচার্সের প্রোডাকশন হেড ফ্র্যাংক প্রাইস পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন। সে তুলনায় অবশ্য বেশ ভালো করছিল মার্ভেলের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ডিসি কমিকসের মুভিগুলো। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যে ডিসির সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি চরিত্র—ব্যাটম্যান ও সুপারম্যান নিয়ে মোট আটটি মুভি নির্মিত হয়েছিল। এর মধ্যে অনেকগুলো মুভিই ভালো করেছিল বক্স অফিসে। প্রশংসিত হয়েছিল সমালোচকদের কাছেও। আগে থেকেই অ্যাকশন ফিগার বিক্রি করে অনেক টাকা কামিয়েছিল টয় বিজ। পাশাপাশি মুভির ব্যাপারে মার্ভেলের অভিজ্ঞতাও খুব একটা ভালো ছিল না। তাই মার্ভেল স্টুডিওজ প্রতিষ্ঠার পরও আইক পার্লমাটারের চিন্তা ছিল ভিন্ন—মুভির জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে অ্যাকশন ফিগারের বিক্রি বাড়ানো যায়। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সনি যখন মার্ভেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় কমিকস চরিত্র স্পাইডম্যানকে নিয়ে মুভি বানানোর স্বত্ব কেনার আগ্রহ দেখায়, তখন তাঁর এই চিন্তায় বড়সড় একটা পরিবর্তন আসে। স্পাইডার-ম্যান ছিল, আভি আরাডের ভাষায়, মার্ভেলের ‘তুরুপের তাস’।
দুই
মার্ভেল স্টুডিওজ প্রতিষ্ঠার পর মার্ভেলের চরিত্র নিয়ে প্রথম যে মুভিটা বানানো হয়েছিল, সেটার নাম ব্লেড। ভ্যাম্পায়ার হান্টার ব্লেডকে নিয়ে ১৯৯৮ সালে নিউ লাইন মুভির বানানো এই মুভিটা বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অ্যাকশন, ভিজ্যুয়াল, প্রোডাকশন ডিজাইন ও স্টোরিটেলিং—সব মিলিয়ে কমিকসের পাতা থেকে তুলে আনা গল্পের মধ্যে একটা ভিন্ন স্বাদ পেয়েছিল দর্শকেরা। সে কারণেই একটা কাল্ট ফলোয়িং তৈরি হয়েছিল মুভিটার। এরপরের মুভিটা ছিল টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সের বানানো, মিউট্যান্ট গ্রুপ এক্স-মেন নিয়ে। মুভিটার প্রযোজক ছিলেন লরেন শুলার ডনার, যিনি তখন ইউ হ্যাভ গট মেইল–এর (১৯৯৮) মতো রমকম বা সেন্ট এলমোস ফায়ার (১৯৮৫)-এর মতো ‘কামিং অব এইজ’ মুভি বানিয়ে বেশ নাম কামিয়েছিলেন। মুভির জগতে পা দিতে আগ্রহী, এমন অনেকেই সে জন্য তাঁর সঙ্গে কাজ করতে মুখিয়ে থাকতেন। তাঁর স্বামী রিচার্ড ডনারও একজন বিখ্যাত পরিচালক ছিলেন—১৯৭৮ সালের সুপারম্যান মুভিটার পরিচালক ছিলেন তিনি। তাঁদের একটা প্রোডাকশন কোম্পানি ছিল, নাম দ্য ডনার্স কোম্পানি। ‘এক্স-মেন’ ফিল্ম ফ্র্যাঞ্চাইজের মুভিগুলোতে কোপ্রোডিউসার হিসেবে ফক্সের সঙ্গে কাজ করে এই কোম্পানি। ইউ হ্যাভ গট মেইল যখন বানানো হচ্ছিল, তখন দ্য ডনার্স কোম্পানি একজন প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্টকে নিয়োগ দেয়। তাঁর কাজ ছিল লরেনের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করা, তাঁর সঙ্গে শুটিংয়ে যাওয়া, তাঁর পোষা কুকুরের দেখাশোনা করা... এসব। এমনকি ইউ হ্যাভ গট মেইল-এর অভিনেত্রী মেগ রায়ানকে কীভাবে ই–মেইল ব্যবহার করতে হয়, সেটা শেখানোও তাঁর কাজ ছিল। কিন্তু এসবের বাইরে এই প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্টের যে বিষয়টা লরেনের সবচেয়ে ভালো লেগেছিল, সেটা হচ্ছে তাঁর গিকিনেস। স্ক্রিপ্ট পড়ে সেটার বিভিন্ন দিক নিয়ে নোট বা ইনপুট দেওয়ার কাজটা খুব আগ্রহ নিয়েই করতেন তিনি। এক্স-মেনের স্ক্রিপ্ট যখন লরেন পান, তখন ওই প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পুরো স্ক্রিনপ্লে পড়ে, স্ক্রিপ্টের বিভিন্ন বিষয়, যেমন ডায়ালগ বা কোনো একটা চরিত্রের কস্টিউম নিয়ে নিয়মিত নোট দিয়ে সাহায্য করছিলেন। এই কাজটা করার জন্য কমিকস এবং কমিকসের চরিত্রগুলো নিয়ে যে গভীর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, সেটা তাঁর ছিল। লরেনের নিজের ভাষায়, এক্স-মেনের জগৎ নিয়ে তাঁর যে জানাশোনা ছিল, সেটা লরেনের নিজের জানাশোনার চেয়ে অনেক বিস্তৃত ছিল। এসব কারণেই লরেন এক্স-মেন মুভির ক্রেডিটে অ্যাসোসিয়েট প্রডিউসার হিসেবে তাঁর নাম যুক্ত করে দেন। তরুণ এই প্রডিউসারের নাম কেভিন ফাইগি। আমরা যাঁকে আজকে মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের রূপকার হিসেবে জানি, সেই কেভিন ফাইগি তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম যে মার্ভেল মুভিতে কাজ করেছিলেন, সেটা ছিল এক্স-মেন।
২০০০ সালে মুক্তি পায় এক্স-মেন। এক্স-মেন-এর জনপ্রিয়তা একটা লম্বা ফ্র্যাঞ্চাইজ নির্মাণের পথ খুলে দেয় ফক্সের জন্য। আর আইক পার্লমাটারের কাছে সেটা ছিল অ্যাকশন ফিগারের বিক্রি বাড়ানোর একটা বেশ ভালো উপায়। ওই একই বছর আভি আরাড মার্ভেল স্টুডিওজে প্রডিউসার হিসেবে তাঁর সঙ্গে কাজ করার জন্য হায়ার করেন কেভিন ফাইগিকে। সনি তত দিনে ডিসির ‘ব্যাটম্যান’ ফ্র্যাঞ্চাইজির সফলতা দেখে একই রকম কোনো একটা চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে মুভি বানাতে চাইছিল। তাদের চোখ ছিল মার্ভেলের স্পাইডার-ম্যানের দিকে। আশির দশকে মার্ভেল যখন অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তারা সনির কাছে মাত্র ২ লাখ ২৫ হাজার ডলারের বিনিময়ে স্পাইডার-ম্যানের মুভি ডিভিডির মাধ্যমে ডিস্ট্রিবিউট করার স্বত্ব বিক্রি করে দেয়। সনি চাচ্ছিল স্পাইডার-ম্যানকে নিয়ে ফিচার ফিল্ম নির্মাণ করতে, যেটা তারা মুভি হলে রিলিজ করতে পারবে। প্রথমে নিজেদের ২৫টি চরিত্রের স্বত্ব মাত্র ২৫ মিলিয়ন ডলারে সনির কাছে বিক্রির প্রস্তাব দেয় মার্ভেল। কিন্তু সনি তখন স্পাইডার-ম্যান ছাড়া অন্য কোনো চরিত্রের স্বত্ব কিনতেই আগ্রহী ছিল না। এটা এখন হয়তো অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু মনে রাখা ভালো, তখনো মার্ভেলের কোনো কমিক বইয়ের চরিত্র মুভির স্ক্রিনে বড় পর্যায়ের সফলতা পায়নি। পরে পুরো মুভির যে আয়, তার কেবল ৫ শতাংশ মার্ভেল পাবে—এই শর্তে ১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে স্পাইডার-ম্যান–এর মুভির স্বত্ব কিনে নেয় সনি।
তখন সনির প্রোডাকশন কোম্পানি কলম্বিয়া পিকচার্সের চেয়ার ছিলেন অ্যামি প্যাসকাল। স্পাইডার-ম্যান-এর পরিচালক হিসেবে স্যাম রাইমিকে নিয়োগ করলেন তিনি। ২০০২ সালে মুক্তি পায় স্পাইডার-ম্যান। ১৪০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের এই মুভি বক্স অফিসে প্রায় ৮২৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে। হাইস্কুলপড়ুয়া পিটার পার্কার ও মেরি জেন ওয়াটসনের যে গল্প স্পাইডার-ম্যান-এ দেখানো হয়, সেটা দর্শকেরা কীভাবে নেবেন, তা নিয়ে সংশয় ছিল সনির। সুপারহিরো মুভির প্রচলিত সূত্রের বাইরে গিয়ে টিনেজ একটা ছেলের ক্রাশ, সুপারহিরো আর সাধারণ জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রাখা নিয়ে তার লড়াই এবং ফাদার ফিগারকে হারানোর দুঃখ—এসব ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল স্পাইডার-ম্যান-এ। অ্যাকশনে জোর দেওয়ার পরিবর্তে সুপারহিরোদের সাধারণ মানুষের কাতারে নিয়ে আসা এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে দেখার ব্যাপারটা মার্ভেল স্টুডিওজের নিজের তৈরি করা মুভিগুলোয় আমরা এরপর নিয়মিতই কিন্তু দেখতে থাকব।
মুক্তির পর স্পাইডার-ম্যান-এর অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা দেখে একই সঙ্গে উৎসাহ ও বিরক্তি ঘিরে ধরে আইক পার্লমাটারকে। মার্ভেলের চরিত্র ব্যবহার করে সনির মুভি বানানো এবং সনির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আয় করা মুভি হিসেবে সেটা জায়গা পাওয়ায় বিরক্ত হন তিনি। অপর দিকে মার্ভেলের চরিত্র নিয়ে বানানো মুভির প্রতি দর্শকের এত আগ্রহ উৎসাহী করে তোলে পার্লমাটারকে। তিনি ভাবলেন, মার্ভেল নিজেই যদি নিজের চরিত্রদের নিয়ে মুভি বানায়, তাহলে কেমন হয়? সে ক্ষেত্রে চিত্রনাট্য থেকে পরিচালক—সবকিছু থাকবে মার্ভেলের নিয়ন্ত্রণে। মুভি থেকে আসা অর্থও পুরোটাই থাকবে নিজেদের কাছে। ব্যাপারটা আদৌ করা সম্ভব কি না, সে চেষ্টা করে দেখতে চাইলেন পার্লমাটার। ২০০৩ সালে মার্ভেল স্টুডিওজের চিফ অপারেটিং অফিসার ডেভিড মেইজেলের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেন তিনি। মেইজেলের চেষ্টায় ৫২৫ মিলিয়ন ডলারের একটা লোন পায় মার্ভেল। উদ্দেশ্য, ৭ বছরে ১০টা সুপারহিরো মুভি বানানো। এই প্রথম নিজেদের চরিত্রগুলো নিয়ে নিজেরাই মুভি বানাবে মার্ভেল। ২০০৫ সালের পরিপ্রেক্ষিতে এটা প্রায় অবাস্তব চিন্তাই ছিল। কারণ, এর আগে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। একটা কমিকস বা বইয়ের চরিত্র কিংবা একটা উপন্যাস বা ভিডিও গেম নিয়ে মুভি বানানোর চিন্তা করা হলে সেটার স্বত্ব একটা মুভি স্টুডিওর কাছে লাইসেন্স করে দেওয়া হতো। মুভি বানানোর কাজ করত মুভি স্টুডিওগুলো আর সেটা থেকে আসা লাভের একটা অংশ পেত মূল গল্প বা চরিত্রের মালিক। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। তখন কে জানত, একটা কমিক বইয়ের কোম্পানি নিজেরাই নিজেদের ছবি প্রযোজনা করবে এবং হলিউডের মুভি প্রোডাকশনের পুরো ধারাকেই বদলে দেবে চিরদিনের জন্য!
তিন
মার্ভেল স্টুডিওজের নিজেদের তৈরি প্রথম মুভি ছিল ২০০৮ সালের আয়রন ম্যান। আয়রন ম্যান-এর প্রোডাকশন চলার সময়ই, ২০০৭ সালে কেভিন ফাইগি মার্ভেল স্টুডিওজের হেড অব প্রোডাকশন হিসেবে পদোন্নতি পান। ফাইগি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার ফিল্ম স্কুলের গ্র্যাজুয়েট। একাধারে ফিল্ম স্কুলের ব্যাকগ্রাউন্ড ও কমিক বুক গিক—জেসিকা জোনসের কো-ক্রিয়েটর ব্রায়ান মাইকেল বেন্ডিস তাঁকে মার্ভেল স্টুডিওজের মতো ফিল্ম স্টুডিওর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য উপযুক্ত নির্বাহী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ফাইগির বক্স অফিস রেকর্ডও সেটা প্রমাণ করে। মার্ভেল স্টুডিওজের মুভি আর কেভিন ফাইগির গল্প একটা আরেকটার সঙ্গে এমনভাবে জড়িত যে মার্ভেলের মুভিগুলোর গল্প বলার সময় বারবারই তাঁর কথা উঠে আসবে।
মার্ভেল স্টুডিওজ যখন নিজেরা মুভি বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কোন কোন চরিত্র নিয়ে মুভি বানানো হবে, তা নিয়ে একটা দ্বিধা ছিল। মার্ভেল দেখল, তাদের অনেক বহুল পরিচিত চরিত্রের স্বত্ব ইতিমধ্যেই অন্য কোনো মুভি স্টুডিওর কাছে আছে। যেমন স্পাইডার-ম্যান-এর স্বত্ব সনির কাছে, এক্স-মেন ও ফ্যান্টাস্টিক ফোর-এর স্বত্ব টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সের কাছে, ব্লেড-এর স্বত্ব নিউ লাইন মুভির কাছে। তাই মার্ভেল চাইলেও এখনই এসব চরিত্র নিয়ে নিজেরা মুভি বানাতে পারবে না। তবে আয়রন ম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, থর, হাল্ক, ব্ল্যাক উইডো ও হকআই—অ্যাভেঞ্জার্সের প্রায় সব সদস্যের স্বত্বই ছিল মার্ভেলের কাছে। কমিকপ্রেমীদের কাছে স্পাইডার-ম্যান কিংবা ফ্যান্টাস্টিক ফোর যত জনপ্রিয় ছিল, আয়রন ম্যান বা থর-এর মতো অনেক সুপারহিরোরাই তত জনপ্রিয় ছিল না। সে জন্য এসব চরিত্র নিয়ে মুভি বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়াটা একদিক থেকে বেশ ঝুঁকিপূর্ণই ছিল। কিন্তু তারপরও মার্ভেল ঠিক করল, এসব চরিত্র নিয়েই মুভি বানাবে তারা।
আয়রন ম্যান-এর পরিচালক হিসেবে মার্ভেল নিয়োগ দিয়েছিল জন ফ্যাভরোকে। অপেক্ষাকৃত নতুন পরিচালক ছিলেন ফ্যাভরো। কিন্তু পরিচালক নির্বাচনের ব্যাপারে মার্ভেলের এই মুনশিয়ানার ব্যাপারটা পরে ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পেরেছিলেন, মুভি মুক্তি পাওয়ার পর। আয়রন ম্যান হিসেবে ফ্যাভরো এমন কাউকে নিতে চাচ্ছিলেন, যিনি বিখ্যাত, কিন্তু খুব বেশি বিখ্যাত নন। বেশ কয়েকজন অভিনেতার কথাই ভাবছিল মার্ভেল, যার মধ্যে ছিলেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়রও। ড্রামা, কমেডি, অ্যাকশন—সবকিছু একসঙ্গে করতে পারবেন, এমন বহুমুখী অভিনেতা খুঁজছিল মার্ভেল। শেষ পর্যন্ত রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকেই চূড়ান্ত করল তারা। কাস্টিং ডিরেক্টর সারাহ ফিন অবশ্য এ জন্য স্ক্রিন টেস্টও নিয়েছিলেন। রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের সংলাপ বলার দক্ষতা আর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তাদের এই সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, সেটা প্রমাণ করল আয়রন ম্যান-এর বক্স অফিস রেকর্ড। ১৪০ মিলিয়ন ডলার প্রোডাকশন বাজেটের আয়রন ম্যান-এর আয় ছিল প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার। কেবল নিজেদের কমিক বুক চরিত্রগুলো নিয়ে মুভি বানানোর জন্য টাকা ধার করে দাঁড় করানো একটা নতুন মুভি স্টুডিওর জন্য এটা ছিল বিশাল ব্যাপার ।
আয়রন ম্যান মুক্তি পেয়েছিল ২০০৮ সালের মে মাসে। একই বছরের জুনে মুক্তি পায় দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক। আয়রন ম্যান-এর মতো বক্স অফিসে অতটা সাড়া না পেলেও ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক ছিল সেটাও। ২০১০ সালে মুক্তি পায় আয়রন ম্যান-এর সিকুয়েল আয়রন ম্যান ২, ২০১১ সালে থর ও ক্যাপ্টেন আমেরিকা: দ্য ফার্স্ট অ্যাভেঞ্জার। সব কটি মুভিই বক্স অফিসে ভালো করেছিল এবং ব্যাপারটা মার্ভেল স্টুডিওজকে একটা শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যেই ২০০৯ সালে মার্ভেল স্টুডিওজকে চার বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় ডিজনি। তখন মার্ভেল স্টুডিওজের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান কেভিন ফাইগি।
মার্ভেলের এই সফলতার পেছনে শুধু যে ইন্ডিভিজ্যুয়াল মুভিগুলোর গল্প বলার ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা নয়। মুভি তৈরির প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে আয়রন ম্যান থেকেই মার্ভেল তাদের প্রতিটি মুভিতে একটা ট্রেন্ড এনেছিল—পোস্ট ক্রেডিট সিন আর ইস্টার এগ। এসব বিষয় দর্শকের মনে একটা বিষয় শক্ত করে গেঁথে দিয়েছিল। সেটা হলো, মার্ভেল স্টুডিওজের মুভিগুলো একটা আরেকটা থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কোনো গল্প নয়, বরং প্রতিটা মুভি একটা ‘বিগার ইউনিভার্স’-এর একেকটা অংশের এক বা একাধিক চরিত্রের গল্প। প্রতিটা মুভি একটা ধারাবাহিক গল্পের অংশ। এখানে কোনো মুভির গল্পই অন্য মুভির গল্প থেকে আলাদা নয়। একটা মুভির কোনো ঘটনা, তা যত ক্ষুদ্র বা তুচ্ছই হোক না কেন, সেটা দিয়ে অন্য মুভিগুলোর গল্প প্রভাবিত হয় কোনো না কোনোভাবে। একটা মুভিতে একটা চরিত্রের করা কোনো একটা কাজ প্রভাব ফেলে পরের প্রায় সব মুভিতে। আবার কোনো কোনো সময় একটা মুভিতে দেখা যায় অন্য আরেকটা মুভির কোনো চরিত্রকে। একটা গল্পের ব্যাপ্তিকে আপাতত যতটা ছোট মনে হয়েছিল, ফিকশনাল ক্রসওভার সেই গল্পের ব্যাপ্তিকে আরও অনেক বিশাল বলে হাজির করে দর্শকের সামনে। মার্ভেলের মুভিগুলোর এই যে বিস্তৃত জগৎ, যার বিভিন্ন চরিত্রকে আমরা বিভিন্ন মুভিয় দেখেছি, সেই দুনিয়াকে আমরা এখন মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স (এমসিইউ) নামে জানি।এমসিইউর প্রথম পোস্ট-ক্রেডিট দৃশ্য আমরা দেখি আয়রন ম্যান-এর শেষে। পোস্ট-ক্রেডিট শব্দটা থেকেই পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। মুভি শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন কলাকুশলীদের নাম পর্দায় দেখানো হতে থাকে, সেটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর এক বা একাধিক অতিরিক্ত ক্লিপ থাকে মার্ভেলের প্রায় প্রতিটা মুভির শেষেই। আয়রন ম্যান-এর পোস্ট-ক্রেডিট দৃশ্যে আমরা দেখি, নিক ফিউরি আয়রন ম্যানের মালিবুর বাড়িতে এসে তার সঙ্গে অ্যাভেঞ্জার্স ইনিশিয়েটিভ নিয়ে কথা বলেন। একইভাবে দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক, থর আর ক্যাপ্টেন আমেরিকা-তেও পোস্ট-ক্রেডিট দৃশ্য দেখতে পাই। এসব পোস্ট-ক্রেডিট দৃশ্যের কোনো কোনোটা সরাসরি পরের মুভির গল্পের সঙ্গে আগের মুভির গল্পটাকে জুড়ে দেয়। যেমন আয়রন ম্যান ২-এর পোস্ট–ক্রেডিট দৃশ্যে দেখা যায়, এজেন্ট ফিল কোলসন নিউ মেক্সিকোর একটা জায়গায় গিয়ে বিশাল এক ক্র্যাটারের মাঝখানে একটা হাতুড়ি খুঁজে পায়। সেই হাতুড়ি যে আসলে থরের ম্যাজিক্যাল হ্যামার মিওনিয়ার, সেটা বোঝা যায় ঠিক পরের মুভি থর-এ। এমসিইউ যে একটা ‘ইন্টারকানেকটেড ইউনিভার্স’, এই ব্যাপারটা মার্ভেল তাদের একেবারে প্রথম মুভি থেকেই এভাবে দর্শকের মনে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
নিক ফিউরি আয়রন ম্যানকে যে অ্যাভেঞ্জার্স ইনিশিয়েটিভের কথা বলেছিল এবং দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক-এ টনি স্টার্ক জেনারেল রসকে যে ‘টিম’–এর ব্যাপারে জানিয়েছিল, সেই টিমকে দর্শক প্রথমবারের মতো দেখতে পান ২০১২ সালে, জস উইডনের দ্য অ্যাভেঞ্জার্স-এ। আগের পাঁচটা মুভিতে দেখা প্রায় সব চরিত্র এবং আয়রন ম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, থর, হাল্ক, ব্ল্যাক উইডো, হকআই—সব সুপারহিরোকে প্রথমবার একসঙ্গে ভিলেন লোকির মুখোমুখি হতে দেখা যায়। চার বছর ধরে ভিন্ন ভিন্ন মুভিতে দেখা প্রায় সব চরিত্রকে একসঙ্গে বড় পর্দায় দেখতে পাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে দর্শকের আগ্রহ আর উত্তেজনার পারদ যে কী তীব্র ছিল, সেটা বোঝা যায় দ্য অ্যাভেঞ্জার্স-এর বক্স অফিস কালেকশন থেকে। মুভিটি আয় করেছিল ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি এবং এর মাধ্যমে মার্ভেল থার্ড হায়েস্ট গ্রসিং মুভির জায়গাটা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। সামনে ছিল কেবল জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক আর অ্যাভাটার।
আয়রন ম্যান থেকে দ্য অ্যাভেঞ্জার্স পর্যন্ত ছয়টা মুভিকে এমসিইউর ফেজ ওয়ান হিসেবে ধরা হয়। একইভাবে ফেজ টু-তে ৬টা মুভি, ফেজ থ্রিতে ১১টা মুভি, ফেজ ফোরে ৭টা মুভি এবং ফেজ ফাইভে এখন পর্যন্ত ৩টি মুভি আছে। ফেজ ওয়ান, টু ও থ্রির ২৩টা মুভিকে একসঙ্গে বলা হয় ‘ইনফিনিটি সাগা’। আয়রন ম্যান থেকে যে গল্প শুরু হয়েছিল, ২৩টা মুভিজুড়ে সেই গল্প ডালপালা মেলেছে, বিস্তৃত হয়েছে এবং এই গল্পের একটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি দেখা গেছে ইনফিনিটি সাগার শেষের দিকের মুভিগুলো—অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার, অ্যাভেঞ্জার্স এন্ডগেম এবং স্পাইডার-ম্যান: ফার ফ্রম হোম-এ এসে।
ইনফিনিটি সাগার ‘ম্যাকগাফিন’ বলা যায় পাওয়ার স্টোনের মতো এসব ইনফিনিটি স্টোনকে। স্পেস, রিয়েলিটি, মাইন্ড, পাওয়ার, সৌল ও টাইম—এই ছয়টি ইনফিনিটি স্টোন সংগ্রহের জন্য যে থানোস অনেক দিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেটা ইনফিনিটি সাগার বিভিন্ন মুভিতেই বিভিন্ন সময় টিজ করা হয়েছে। এসব স্টোনের প্রতিটিই অসম্ভব শক্তিশালী এবং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের একেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ন্ত্রণ করে। থানোসের মতো কোনো একটা এন্টিটি যদি এই সব কটি স্টোনকে একসঙ্গে জড়ো করতে পারে এবং একটা ইনফিনিটি গন্টলেটে স্টোনগুলো রেখে সেটা হাতে পরতে পারে, তাহলে হাতের আঙুলের একটা চুটকি দিয়েই পুরো মহাবিশ্বের অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলা সম্ভব। এখানে ইনফিনিটি স্টোন জোগাড় করার পেছনে থানোসের উদ্দেশ্য হলো, মহাবিশ্বের অর্ধেক প্রাণকে মেরে ফেলা। তার যুক্তিতে, মহাবিশ্বে প্রাণের সংখ্যা অনেক বেশি, সে তুলনায় সম্পদ অনেক কম। এ কারণে মহাবিশ্বে নানা জায়গায় বড় বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাই মহাবিশ্বে ভারসাম্য আনতে অর্ধেক প্রাণকে মেরে ফেলতে চায় থানোস। ইনফিনিটি সাগার ‘ওভারআর্চিং ভিলেন’ থানোসকে ২০১২ সালের দ্য আভেঞ্জার্স’-এ প্রথম দেখানো হয়। নিউইয়র্ক সিটিতে লোকির আক্রমণের পেছনে যে থানোসের ভূমিকা ছিল, সেটা দর্শক বুঝতে পারে অ্যাভেঞ্জার্স-এর পোস্ট-ক্রেডিট দৃশ্য দেখে। অ্যাভেঞ্জার্স: এজ অব আলট্রন (২০১৫)-এর পোস্ট-ক্রেডিট দৃশ্যেও থানোসকে দেখা যায়, একটা ইনফিনিটি গন্টলেটসহ। থানোসকে দর্শক আরেকটু ভালোভাবে জানার সুযোগ পায় গার্ডিয়ানস অব দ্য গ্যালাক্সি–েত (২০১৪)। সেখানে দেখা যায়, ক্রি ফ্যানাটিক রোনান দ্য অ্যাকিউজারকে পাওয়ার স্টোন সংগ্রহ করে তার কাছে এনে দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিল থানোস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোনানের সঙ্গে বিরোধ হয় তার। বলে রাখা ভালো, ইনফিনিটি স্টোনগুলো জোগাড় করার চেষ্টার আগেও থানোস বিভিন্ন গ্রহে আক্রমণ করে। হত্যা করে পুরো গ্রহের অর্ধেক জনসংখ্যা। ইনফিনিটি স্টোনগুলো পেলে পুরো কাজটাই সে অনেক দ্রুত করতে পারবে, আর সে জন্যই তার এই চেষ্টা। থানোস শেষ পর্যন্ত সব কটি ইনফিনিটি স্টোন জোগাড় করতে সক্ষম হয় অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার–এ (২০১৮) এসে। অ্যাভেঞ্জারদের মধ্যে যে ভাঙন দেখা যায় ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার–এ (২০১৬), তার কারণে থানোসের সঙ্গে একজোট হয়ে লড়াই করতে পারে না তারা, যার ফলাফল হয় ভয়াবহ। থানোস এক ‘স্ন্যাপ’-এ পুরো মহাবিশ্বের অর্ধেক প্রাণকে মেরে ফেলে। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ যেহেতু এ সময় ছাইয়ের মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়, তার প্রভাব কী ভয়াবহ হয়, সেটা দেখা যায় অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম (২০১৯)-এ এসে। অ্যাভেঞ্জার ও অন্য সুপারহিরোদের মধ্যে যারা ‘স্ন্যাপ’-এর পরও টিকে ছিল, তারা আবার একজোট হয়ে ‘ব্যাটল অব আর্থ’-এ লড়াই করে থানোসের বিরুদ্ধে। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে থানোসের হাত থেকে স্টোনগুলো কেড়ে নিয়ে স্ন্যাপ করে আয়রন ম্যান। ছাইয়ের মতো মিলিয়ে যায় থানোস এবং তার পুরো আর্মি। মহাবিশ্বকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দেয় আয়রন ম্যান। স্ন্যাপে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা ফিরে আসে পৃথিবীতে। টাইম ট্রাভেল করে ক্যাপ্টেন আমেরিকা (যাকে ‘ম্যান আউট অব টাইম’ হিসেবে অ্যাভেঞ্জার্স-এ সম্বোধন করেছিল লোকি) ফিরে যায় চল্লিশের দশকে, তার প্রেমিকা (পরে স্ত্রী) পেগি কার্টারের কাছে। ক্যাপ্টেন আমেরিকার শিল্ড ও ম্যান্টল যায় স্যাম উইলসনের কাছে, আগে যে ফ্যালকন হিসেবে পরিচিত ছিল। ইনফিনিটি সাগার গল্পের সমাপ্তি অনেকটা এভাবেই হয়।
বক্স অফিসে মার্ভেলের জন্য অনেক বড় সফলতা ছিল অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার (২০১৮) আর অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম (২০১৯)। অ্যাভাটার–কে (২০০৯) পেছনে ফেলে মুভির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উপার্জন করা মুভির জায়গাটা দখল করেছিল অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম। ইনফিনিটি ওয়ার ও এন্ডগেম নিয়ে দর্শকের উত্তেজনা যেমন তীব্র ছিল, তেমনি সমালোচকদের কাছেও বেশ প্রশংসিত হয়েছিল মুভিগুলো। ‘ইনফিনিটি সাগা’ শেষ হওয়ার পরও মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের গল্প কিন্তু চলছে, শেষ হয়ে যায়নি। ফেজ ফোর থেকে শুরু হওয়া এসব গল্পের সম্মিলিত নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাল্টিভার্স সাগা’। ফেজ ফোর থেকে ফেজ সিক্স পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া সব মুভিই মার্ভেলের মাল্টিভার্স সাগার অংশ হবে। পাশাপাশি ফেজ ফোর থেকে ডিজনি প্লাস স্ট্রিমিং সার্ভিসে টিভি সিরিজও মুক্তি দেওয়া শুরু করেছে মার্ভেল, যেগুলো সরাসরি মুভির গল্পগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত।
চার
মার্ভেল স্টুডিওজের মুভি আর টিভি সিরিজের সফলতার গল্পের পেছনে কেবল আভি আরাড, ডেভিড মেইজেল কিংবা কেভিন ফাইগির মতো নির্বাহী কিংবা রবার্ট ডাউনি জুনিয়র (আয়রন ম্যান), ক্রিস ইভান্স (ক্যাপ্টেন আমেরিকা), মার্ক রাফেলো (হাল্ক) কিংবা ক্রিস হেমসওয়ার্থের (থর) মতো অভিনেতাদের ভূমিকা আছে, তা কিন্তু নয়। এসব চরিত্র যাঁরা তৈরি করেছেন, কমিকসের গল্পগুলো লিখেছেন, চরিত্রদের এঁকেছেন, মুভি বা টিভি সিরিজের স্ক্রিনপ্লে যাঁরা লিখেছেন, কিংবা যাঁরা পরিচালনা করেছেন, তাঁদের ভূমিকাও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্যান লি, জ্যাক কার্বি, স্টিভ ডিটকো, জো সাইমন, ল্যারি লিবালের মতো কমিক বুক লেখক ও শিল্পীদের কারণেই তুমুল জনপ্রিয় অনেক কমিক বুক চরিত্রের জন্ম হয়েছে। জন ফ্যাভরো (আয়রন ম্যান, আয়রন ম্যান ২), জস উইডন (অ্যাভেঞ্জার্স, অ্যাভেঞ্জার্স: এজ অব আলট্রন), রুসো ব্রাদার্স (ক্যাপ্টেন আমেরিকা: উইন্টার সোলজার, ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার, অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার, অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম), জো জনস্টন (ক্যাপ্টেন আমেরিকা: দ্য ফার্স্ট অ্যাভেঞ্জার), রায়ান কুগলার (ব্ল্যাক প্যান্থার, ব্ল্যাক প্যান্থার: ওয়াকান্ডা ফরেভার), স্কট ডেরিকসন (ডক্টর স্ট্রেঞ্জ), ডেস্টিন ড্যানিয়েল ক্রেটনের (শাং-চি অ্যান্ড দ্য লেজেন্ড অব দ্য টেন রিংস) মতো পরিচালক কিংবা ক্রিস্টোফার মার্কাস এবং স্টিফেন ম্যাকফিলির (ক্যাপ্টেন আমেরিকা: উইন্টার সোলজার, ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার, অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার, অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম) মতো চিত্রনাট্য রচয়িতা—একেকটা মুভি আর টিভি সিরিজের জনপ্রিয়তার পেছনে এসব লেখক-পরিচালকের মুনশিয়ানার অনেক বড় ভূমিকা আছে। মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের গল্পের সঙ্গে এসব গল্পের রূপকারেরা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
মার্ভেলের এই দুনিয়ায় যেসব গল্প দর্শক দেখছেন, সেগুলোর অধিকাংশই হয়তো তাদের নিজেদের গল্প। একটা হাইস্কুলপড়ুয়া কিশোর বা কিশোরী পিটার পার্কারের মতোই হয়তো ভাবে, গান শোনে, টেক্সট করে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয় কিংবা নিজের কোনো না কোনো বিষয় অন্য অনেকের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। একটা বড় দুর্ঘটনার পর কেউ হয়তো স্টিফেন স্ট্রেঞ্জের মতোই হতাশা ও যন্ত্রণা বোধ করে। প্রিয় মানুষটাকে সব সময়ের জন্য হারিয়ে ফেলে কেউ হয়তো স্টিভ রজার্সের মতোই বুকে একগাদা হাহাকার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আবার মা–বাবাকে মন খুলে সবকিছু খুলে বলার পর তাঁদের সহযোগিতা পেলে টিনেজ একটা মেয়ে হয়তো কামালা খানের মতোই ভীষণ রকম খুশি হয়। মার্ভেলের এসব চরিত্র, এইসব গল্প আসলে আমাদের সবার জীবনেরই গল্প। এ জন্যই হয়তো মার্ভেলের সুপারহিরোদের এই দুনিয়াকে আমাদের নিজেদেরই দুনিয়া মনে হয়!
সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য হলিউড রিপোর্টার, ভ্যারাইটি