বই নিয়ে লেখা এই বিখ্যাত বইগুলো পড়েছেন কি

ধরো, স্কুল বা কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিনের জন্য একটা ছুটি পেয়েছ। তবে এবার সিদ্ধান্ত নিলে, এ ছুটিটা কাটাবে বই পড়ে। এই তো আর এক মাস পরেই ডিসেম্বর। একসময় ঘটা করে স্কুল বা কলেজে শীতের ছুটি দেওয়া হতো। এখন শীতও সময়মতো আর আসে না, তাই ঘটা করে ছুটিটাও ঠিক পাওয়া যায় না। এমন ছুটিতে লেপ বা কম্বলের নিচে শুয়ে বই পড়ার মজাই কিন্তু আলাদা। নতুন একটা বই তুলে নিলে তুমি। কিন্তু পড়তে গিয়ে খেয়াল করলে, আরে, বইয়ের মধ্যে তো আরেকটা বইয়ের গল্প! কেমন হয় এমন হলে?

হয়তো এটুকু শুনেই তোমাদের কিঞ্চিৎ আগ্রহ জন্মাচ্ছে। আমি বই পড়ছি, সে বইয়ের ভেতরে আরেকটা বই আবার কেমন জিনিস? সে গল্পই আজ বলব তোমাদের। সে জন্য একটু ডুব মারতে হবে জাপানি সাহিত্যে।

খেয়াল করে দেখবে, ইদানীং বাংলাদেশে জাপানি সাহিত্য ভীষণ জনপ্রিয়। থ্রিলার থেকে শুরু করে জীবনমুখী গল্পগুলো নিয়মিত পাঠকপ্রিয়তা পাচ্ছে। মানুষ আগ্রহের সঙ্গে জাপানি বই কিনে পড়ছে, বাংলায় অনুবাদও হচ্ছে প্রচুর। আচ্ছা, ভুল বুঝো না কিন্তু। জাপানি বইগুলোও ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। সেগুলোর কথাই বলছি, সরাসরি জাপানি ভাষায় লেখা বই নয়। খেয়াল করে দেখবে, জাপানি সাহিত্যে তারা মূলত নিজেদের ঐতিহ্য ও পছন্দের বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলে। এ জন্য ইদানীং ‘কনটেম্পরারি ফিকশন’ হিসেবে যে বইগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে, তার বিষয়বস্তু হচ্ছে বিড়াল, মিষ্টান্ন, ফুল, লাইব্রেরি, কফি শপ ও বই। বিষণ্নতাও তাদের বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। জাপানি প্রখ্যাত লেখক হারুকি মুরাকামির লেখার প্রধান বিষয়বস্তুর একটি হলো বিড়াল। তো এগুলোর মধ্য থেকে যখন বই অথবা লাইব্রেরির বিষয়গুলো চলে আসে, তখন গল্পটা হয়ে যায় ‘বইয়ের মধ্যে বইয়ের’ মতো।

চলো এমন কয়েকটা বইয়ের খবর নিয়ে আসি।

হোয়াট ইউ আর লুকিং ফর ইজ ইন দ্য লাইব্রেরি (মিচিকো আয়োইয়ামা)

এ বইয়ের গল্প মূলত একটি লাইন ব্যবহার করেই বোঝানো সম্ভব। সেটা হলো, কী খুঁজছ তুমি? গল্প মূলত একটি লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে। বিশাল এক লাইব্রেরি। সেই লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান হচ্ছে সায়ুরি কোমাচি। তার একটা ম্যাজিক্যাল ক্ষমতা আছে। লাইব্রেরিতে যে আসে, তার মন পড়ে ফেলতে পারে সে। তুমি কোনোদিন যদি ওই লাইব্রেরিতে যাও, সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরিয়ান তোমার মনের কথা বুঝে ফেলবে। এভাবে বেশ কয়েকজন চরিত্র ঘটনাক্রমে আসে এ লাইব্রেরিতে। সায়ুরি কোমাচি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলে তাদের মনের কথা। এই চরিত্রগুলো বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। জীবন নিয়ে খুশি নয় তারা। তাদের জীবনে নানা স্বপ্ন; কিন্তু পূরণ করার অবস্থায় তারা নেই অথবা কীভাবে করতে হবে জানা নেই তাদের। সায়ুরি কোমাচি তাদের নির্দিষ্ট কোনো বই পড়ার পরামর্শ দেয়। এক বই সবাইকে আবার দেয় না। একেকজনের জন্য একেক বই। সে বই পড়েই বদলে যায় তাদের জীবন, তাদের চিন্তা।

গল্পটা একদম অন্য রকম, তাই না?

ছোট ছোট বেশ কয়েকটি গল্প নিয়ে এ বইটা। তবে প্রতিটি গল্পে একটা দিক কমন। সেটা কী? আশা করছি ধরতে পেরেছ তোমরা। চাইলে বইটা পড়তে পারো কিন্তু। বাংলাতেও বইটি অনুবাদ করা হয়েছে।

ডেজ অ্যাট দ্য মরিসাকি বুকশপ (সাতোশি ইয়াগিসাওয়া)

লাইব্রেরি হলো, এবার আমরা যাই নীলক্ষেতে। ওহ, নীলক্ষেত তো না, আমাদের যেতে হবে টোকিওর জিমবাচোতে। এখানে আছে একটা কাঠ দিয়ে বানানো পুরোনো বিল্ডিং, যার ভেতরে থরে থরে সাজানো হরেক রকমের বই। এ বইয়ের দোকানের নাম মরিসাকি বুকশপ।

তিন জেনারেশন ধরে তাকাকোর পরিবার এই বইয়ের দোকান চালাচ্ছে। যদিও ২৫ বছর বয়সী তাকাকো বই পড়তে তেমন একটা পছন্দও করে না। কিন্তু এই বুকশপটা তাকাকোর মামা সাতোরুর গর্বের জায়গা। তাকাকোর মামি পাঁচ বছর আগে চলে যাওয়ার পর ওর মামা এই দোকানটাই আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। ঘটনাক্রমে তাকাকো আসে এই দোকানে, থাকা শুরু করে ওপরের তলার ছোট্ট একটা ঘরে। সেই ঘরেও গাদা গাদা পুরোনো বই আর ছাতা পড়া গন্ধ।

মরিসাকি বুকশপে এসে ধীরে ধীরে তাকাকোর জীবনটা পাল্টে যায়। কীভাবে? তার গল্পই লেখক বলেছেন এ বইয়ে।

আরও পড়ুন

মোর ডেজ অ্যাট দ্য মরিসাকি বুকশপ (সাতোশি ইয়াগিসাওয়া)

মোর ডেজ অ্যাট দ্য মরিসাকি বুকশপ হচ্ছে প্রথম বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড, আমরা যাকে বলি সিকুয়েল। প্রথম বই যেখানে শেষ হয়, ঠিক সেখান থেকেই এ বইয়ের গল্প শুরু। মরিসাকি বুকশপ, তাকাকো আর সাতোরুর গল্পটা এগিয়ে যেতে থাকে। বইয়ের দোকানগুলোর মানুষের জীবন, ভালোবাসা, হারানোর ব্যথা আর বইয়ের প্রতি আবেগের বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে প্রতিটি পাতায়। তুমি যদি ভীষণ বইপ্রেমী হও, নীলক্ষেতের দোকানগুলোর পুরোনো বইগুলোর ভেতর মাঝেমধ্যেই ঢুঁ মারো, বইয়ের গন্ধ যদি হয় তোমার ভীষণ পছন্দের, তাহলে এ বই দুটি পড়তে পড়তে মনে হবে, তুমি আসলেই একসময় মরিসাকি বুকশপে চলে গেছ। ঘুমের ঘোরে হয়তো স্বপ্নও দেখতে পারো, সাতোরু মামা আর তাকাকোর সঙ্গে পুরোনো বইয়ের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছ। নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে পুরোনো হয়ে যাওয়া বইয়ের গন্ধ।

এ দুটি বইও বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। তবে ইংরেজি পড়তে চাইলে পছন্দের বুকশপে খোঁজ নিতে পারো। কিন্তু মরিসাকি বুকশপ বই খুঁজতে আবার মরিসাকি বুকশপেই চলে যেও না যেন।

আরও পড়ুন

দ্য ক্যাট হু সেভড বুকস (সোসকে নাতসুকাওয়া)

এই যে দেখো, বইয়ের সঙ্গে এবার বিড়াল চলে এসেছে। জাপানি সাহিত্যে এ দুটো যেন একে অন্যের পরিপূরক।

এ বইটি মূলত আবর্তিত হয়েছে নাতসুকি বইঘর নামের একটা বইয়ের দোকান নিয়ে। দোকানটা রিনতারো নাতসুকির দাদুর। জায়গাটা ভীষণ প্রিয় ওর। বই পড়তে পড়তে রিনতারো কত দারুণ সব মুহূর্ত এখানে পার করেছে। কিন্তু একদিন মারা যায় ওর দাদু। একেবারে ভেঙে পড়ে রিনতারো। বইয়ের দোকানটা এবার বন্ধই করে দিতে হবে হয়তো। এমন সময় একদিন দোকানে একটা বাদামি রঙের বিড়াল এসে উপস্থিত। বিড়ালটা আবার কথা বলে, নাম নাকি টাইগার। বিড়াল কথা বলছে আবার নাম টাইগার, কী একটা অবস্থা দেখো। তো এমন একটা বিড়াল এখানে কী করে? আসলে রিনতারোর কাছে একটা সাহায্য চাইতে এসেছে ও। টাইগার নাকি একটা অভিযানে বের হবে, সেই অভিযানে একজন বইপ্রেমীকে লাগবে তার।

আরও পড়ুন

কী অভিযান তাদের? বইয়ের সাথে তার সম্পর্ক জানতে পড়তে হবে দ্য ক্যাট হু সেভড বুকস বইটি। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। এ বইও অনুবাদ হয়েছে বাংলায়।

দ্য ডোর-টু-ডোর বুকস্টোর (কারস্টেন হেন)

অনেক তো জাপানিজ হলো, এবার না হয় একটু জার্মানিতে ঘুরে আসা যাক। এ বইয়ের গল্প কার্ল ক্রিশ্চিয়ান খলহফ নামের এক বুড়োকে নিয়ে। একেবারে বৃদ্ধ হয়ে গেছে সে। সিটি গেট নামে একটা বইয়ের দোকানে কাজ করে কার্ল। তার কাজ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই ডেলিভারি করা। যাদের কাছে ও বই ডেলিভারি করে, সেই মানুষগুলো বন্ধু তো বটেই, কার্লের সবচেয়ে আপনজনও। কিন্তু বই নেওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই কার্লের চাকরি নিয়েও চলছে টানাটানি।

একদিন তার সঙ্গে দেখা হলো ছোট্ট একটা মেয়ের, নাম সাশা। এই ছোট্ট মেয়ে ও কার্ল মিলে শুরু করল এক নতুন জার্নি।

আরও পড়ুন

বই এবং বন্ধুত্ব সম্পর্কে দারুণ একটা অভিজ্ঞতা দেবে এ বইটি। তবে চাইলে পড়তে হবে ইংরেজিতে। কারণ, বাংলা অনুবাদ এখনো হয়নি।

দ্য মিডনাইট লাইব্রেরি (ম্যাট হেইগ)

পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর তোমাদের মনে হয় না, ইশ্‌! আরেকবার সুযোগ হলে ভালো করে পড়তাম। শিক্ষকের বকুনি খাওয়ার পর মনে হয় না, ইশ্‌! পড়াগুলো করে এলে আর বকুনি খাওয়া লাগত না। ক্রিকেট খেলতে গেছ। ছয় মারতে গিয়ে আউট হয়ে ম্যাচটা হেরে আসার পর মনে হলো, ধ্যাৎ, ছয় না মেরে সিঙ্গেল রান নিলে ম্যাচটা জেতানো যেত। শুধু তোমরা নও, ছেলে–বুড়ো সবাই কিন্তু এ চিন্তাটা জীবনে একবার হলেও করে। ৮০ বছরের বৃদ্ধ, তিনিও কিন্তু চিন্তা করেন; যদি সুযোগ পেতাম তাহলে জীবনটা অন্য রকম করে কাটাতাম। আসলে এই আক্ষেপ আর অনুতাপ আমাদের জীবনের একটা অংশ, এগুলোকে ছাড়া জীবন কাটানোই অচল। কিন্তু যে সিদ্ধান্তের জন্য আমরা অনুতাপে ভুগি, সেই সিদ্ধান্ত যদি পরিবর্তনের সুযোগ আমাদের সামনে আসে, কেমন হয় তাহলে? যদি আমরা দেখতে পারি আমাদের জীবনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ?

দ্য মিডনাইট লাইব্রেরি উপন্যাস এ বিষয়ের ওপরই লিখেছেন ম্যাট হেইগ। ত্রিশের কোঠায় থাকা নোরা সিড নামের এক নারীকে নিয়েই এগোয় এ বইয়ের গল্প। জীবন নিয়ে প্রচণ্ড বিষণ্নতায় ভোগা এই নারীর সামনে আসে অন্য রকম একটা সুযোগ। চাইলে পড়তে পারো এ বইটিও। বেস্টসেলার এ বইটির বাংলা অনুবাদও রয়েছে।

তাহলে ‘বইয়ের মধ্যে বইয়ের গল্প’ ব্যাপারটা বুঝলে তো? আসলে খুঁজলে এই প্লটে আরও বেশ কিছু বই পাওয়া সম্ভব। আমি শুধু জনপ্রিয় কয়েকটি বইয়ের উদাহরণ টেনে এই জনরার সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। আসলে মানে–গুণে জাপানি সাহিত্য কিন্তু অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে। তোমরা চাইলে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করেও দেখতে পারো। আর যদি চাও, পরবর্তী সময়ে আমরা ফুল, কেক, পশুপাখি নিয়ে লেখা জাপানি বইগুলো নিয়েও আলোচনা করতে পারি। তবে তার আগে তোমাদের জন্য একটি বিশেষ কাজ, খুঁজে দেখো তো বাংলাদেশের কোনো লেখক এমন জনরাতে উপন্যাস লিখেছেন কি না!

আরও পড়ুন